
চলতি বছর প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই অংশ নিতে পারবে। এ ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এতে কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি স্কুলের প্রায় ৮৫ লাখ শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষায় রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মনিপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হলি ক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বেসরকারি স্কুলগুলোরই প্রাধান্য থাকত।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা চালুর পর বন্ধ হয়ে যায় বৃত্তি পরীক্ষা। পিইসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতেই দেওয়া হতো বৃত্তি।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার এ বছর থেকে আবার বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী ২১ থেকে ২৪ ডিসেম্বর এই পরীক্ষা হবে। তবে এবারের বৃত্তি পরীক্ষায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পিটিআই-সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয় ও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। ফলে বাদ যাচ্ছে কিন্ডারগার্টেন ও সব ধরনের বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষার সুযোগের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এক লাখ ১৪ হাজার ৫৩৯। এতে পড়াশোনা করে দুই কোটি পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার ৯১ শিশু। তবে সরকারি ৬৫ হাজার ৫৬৫ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এক কোটি ১৯ লাখ ৯৫ হাজার ২২২ শিশু। অর্থাৎ বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে ৮৫ লাখ ৫০ হাজার ৮৬৯ শিশু। বেসরকারি স্কুলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৬ হাজার ৪৭৮টি কিন্ডারগার্টেনে পড়ে ৪৬ লাখ আট হাজার ৬৭৯ শিশু। এর বাইরে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইবতেদায়ি মাদরাসা, এনজিও পরিচালিত স্কুল, উচ্চ বিদ্যালয় ও মাদরাসা সংযুক্ত স্কুল, শিশুকল্যাণ ট্রাস্ট স্কুল এবং আরো বিভিন্ন ধরনের স্কুল রয়েছে।
গত সোমবার রংপুরে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, ‘বাচ্চাদের শিক্ষার মানোন্নয়নে আমরা নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি। এরই একটা হচ্ছে বৃত্তি পরীক্ষা। যেখানে কিন্ডারগার্টেন ক্লাস টু থেকে ফাইভ পর্যন্ত বৃত্তি পরীক্ষা নেয়। কিন্তু আমরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তা করছি না, শুধু ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষা নিচ্ছি। এটা আমরা সীমিত রাখছি শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘আইনে বলা আছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। ফলে সরকার প্রত্যেক বাচ্চার দায়িত্ব নিতে বাধ্য। সবাই যদি আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়, তাহলে আমরা সবার দায়িত্ব নেব।’
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ এম ইকবাল বাহার চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৃত্তি শুধু একটি আর্থিক অনুদান নয়, এটি একটি শিশুর আত্মবিশ্বাস, সামাজিক স্বীকৃতি এবং শিক্ষাগত অগ্রগতির অনুপ্রেরণা। যখন একটি শিশু দেখবে তার বন্ধুরা বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে; কিন্তু সে নিতে পারছে না শুধু তার বিদ্যালয়ের শিক্ষার ধরন ভিন্ন বলে, তখন তার মনোবলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যা জাতীয় শিক্ষানীতিরও পরিপন্থী। এতে শিক্ষার্থী ও পরিবার যে মানসিক চাপ ও যন্ত্রণার মুখোমুখি হবে, এর সব দায় সরকারকে নিতে হবে।’
সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নিম্নবিত্ত পরিবারের। অন্যদিকে কিন্ডারগার্টেনে অধ্যয়নরত বেশির ভাগ শিক্ষার্থী তুলনামূলকভাবে সচ্ছল পরিবারের। ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বৃত্তি পরীক্ষা’—নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর সন্তানদের শিক্ষার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে একটি আর্থিক প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭(ক) অনুচ্ছেদ এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন, ১৯৯০ অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী সব শিশুর অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ নীতি কার্যকর নেই। গত সোমবার প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশ নেওয়ার সুযোগ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। চার সপ্তাহের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও উপবৃত্তি বিভাগের পরিচালককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
রিট আবেদনকারী আরিফুর রহমান মুরাদ ভূঁইয়া বলেন, ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় সরকারি, বেসরকারিসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে পারত। কিন্তু গত ১৭ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে দুটি সার্কুলার জারি করা হয়। সেখানে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। এ কারণে বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের করি।