
নজিরবিহীন সঙ্কটের মুখে দেশের সংবাদপত্র শিল্প। ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যাপক প্রসার, কাগজসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় এবং আমদানি করা ও দেশি কাঁচামালের মূল্য শতভাগ বৃদ্ধি পাওয়ায় এ শিল্পের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সংবাদপত্র শিল্পের এই সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতিতে শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। পাশাপাশি পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্ট ও হকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ শিল্পের পাশে থাকার আহ্বান তাদের।
সেবা শিল্প হিসেবে ঘোষিত সংবাদপত্র শিল্প দীর্ঘদিন ধরেই সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রি মূল্যের ব্যবধান একটা প্রধান কারণ। বর্তমানে বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে সংবাদপত্রের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যেরও মূল্য এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যার কারণে এই সেবা শিল্প আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়েছে। বলা যায়, এটি এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে।
সংবাদপত্র সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে এক কপি সংবাদপত্র তৈরিতে ব্যয় হয় গড়ে ২২ থেকে ২৪ টাকার মতো। সেখানে এর বিক্রিমূল্য মাত্র ১২ টাকা, অর্থাৎ উৎপাদন খরচের অর্ধেক। তারপরও এই বিক্রিত মূল্যের শতকরা ৩৫ ভাগ হকারদের হাতে চলে যায়। মালিক বা প্রকাশকের হাতে থাকে উৎপাদন খরচের হিসাবে মাত্র ১৫ ভাগ। এই যে বিপুল পরিমাণ ঘাটতি তা বিজ্ঞাপনের আয় থেকে পূরণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ পত্রিকার ক্ষেত্রে এই উৎপাদন-খরচ ও বিক্রিমূল্যের পার্থক্য মেটানো সম্ভব হয় না।
রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভখ্যাত এই গণমাধ্যমকে সংকটে রেখে দেশে কখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তারা বলছেন সংবাদপত্রের এই সঙ্কটকালে সরকারের উচিত এর পাশে দাঁড়ানো। সে ক্ষেত্রে সরকার বিজ্ঞাপনের রেট বৃদ্ধির মাধ্যমে সংবাদপত্র শিল্পের পাশে দাঁড়াতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম শামীম রেজা বলেন, সংবাদপত্রে প্রতিনিয়ত উঠে আসে সমাজের বহুমুখী সঙ্কটের চিত্র। অথচ সংবাদ মাধ্যমেই আজ বড় সঙ্কটের মুখে। তাদের টিকে থাকাটাই আজ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সঙ্কট ক্রমাগত আরো তীব্র হচ্ছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অন্যতম শর্ত হচ্ছে আর্থিক সচ্ছলতা। এটি একেবারেই এ শিল্পে নেই। সংবাদপত্রের এই সংকটের সুযোগ নিয়ে একটি অসাধু শ্রেণি তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ স্বাধীন সংবাদপত্র ছাড়া একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সরকারকে সংবাদপত্রের পাশে দাঁড়ানো জরুরি। এ ক্ষেত্রে এককালীন কোনো প্রণোদনা নয়, বরং সরকারের দেয়া বিজ্ঞাপনের রেট ও পরিমাণ বাড়িয়ে সংবাদপত্র শিল্পের সঙ্কট দূর করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও তদারকির ক্ষেত্রেও বেশকিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশের সব ধরনের গণমাধ্যমের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, তদারকি ও মূল্যায়নের জন্য এখনো কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। বিষয়টি বিবেচনা করে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছে। বাংলাদেশে সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা বাড়িয়ে দেখানোর একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। প্রচারসংখ্যা বাড়ানোর পেছনে মূলত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, বিজ্ঞাপনের জন্য বাড়তি দর আদায়; দ্বিতীয়ত, কম শুল্কে নিউজপ্রিন্ট আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে বাড়তি আয় করা। এসব অসংগতি বন্ধে সংবাদপত্রের সঠিক প্রচারসংখ্যা নির্ধারণ করা খুবই জরুরি। সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা তদারকির দায়িত্বে রয়েছে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর (ডিএফপি)। কিন্তু বাস্তবতা হলো প্রতিষ্ঠানটি এখনো মুদ্রিত সংবাদপত্রের বিশ্বাসযোগ্য প্রচারসংখ্যা নিশ্চিত করতে পারেনি বা পারে না। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচার সংখ্যা বিবেচনায় না নিয়ে একটি পত্রিকার গ্রহণযোগ্যতা ও তার ঐতিহ্যকে বিবেচনায় নিয়ে বিজ্ঞাপনের পরিমাণ নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেমনটা উন্নত বিশ্বে হয়ে থাকে।
তবে আশার বিষয় হলো, সম্প্রতি তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম সংবাদপত্রের গুণগত মানোন্নয়নে টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। উপদেষ্টার ভাষ্য অনুযায়ী, এই টাস্কফোর্স স্বচ্ছতার সঙ্গে সংবাদপত্রের প্রকৃত প্রচারসংখ্যা নির্ধারণ, ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন, বিজ্ঞাপন হার নির্ধারণসহ সংবাদপত্রের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করবে।
এ বিষয়ে সম্পাদক পরিষদ সম্প্রতি তাদের এক বিবৃতিতে বলেছে, বৈশ্বিক নানান কারণে দেশের সংবাদপত্র শিল্প এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। সংবাদপত্র জগতে এই নজিরবিহীন পরিস্থিতিতে শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্ট ও হকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে পাশে থাকার তারা আহ্বান জানিয়েছে।
অন্যদিকে সংবাদপত্রে সঙ্কট নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)। সম্প্রতি নোয়াবের সভাপতি এ কে আজাদের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, নোয়াব’র সাম্প্রতিকতম সভায় সংবাদপত্র শিল্পের সংকটাপন্ন অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিশেষ করে, বিভিন্ন প্রয়োজনীয় এবং আমদানি করা ও দেশি কাঁচামালের মূল্য শতভাগ বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই সভায় সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবাই শঙ্কা প্রকাশ করেন। পাশাপাশি এ শিল্প রক্ষায় বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও ভ্যাট কমানো বা রহিত করার দাবি জানান। একই সাথে বিজ্ঞাপনের রেট ও পরিমাণ বাড়িয়ে এই সঙ্কটাপন্ন শিল্পের পাশে সরকারকে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।