
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের পর বাংলাদেশকে নতুন করে কল্পনা করা সহজ নয়। এটা শুধু তার এই দীর্ঘ সময়ের কর্তৃত্বের জন্য নয়, বরং এ কারণেও যে- বাংলাদেশের মানুষ এখনো অপেক্ষায় আছেন, কী রূপে তারা নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে তাদের দেশকে পুনর্গঠিত করতে পারবেন। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে যে ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়, তা ভুলে যাওয়ার সুযোগ মেলেনি। এমনকি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীনও না। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে দ্য উইক-এর ঢাকা সফরের সময় দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনের ভেঙে পড়া প্রাচীর এবং শহরজুড়ে ছড়ানো গ্রাফিতি যেন এটাই জানান দেয়: এবার সময় এসেছে, জনগণই ঠিক করবে তাদের শাসনব্যবস্থা কেমন হবে, সমস্যা কীভাবে সমাধান হবে এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কীভাবে গড়ে উঠবে।
শেখ হাসিনার সেই বাসভবনকে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। নাম দেয়া হয়েছে: ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’। এই ভিআইপি কমপ্লেক্সটি তৈরি করেন শেখ হাসিনার পিতা, বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু আজ সেই দেয়ালের গায়ে জর্জরিত ক্ষতের চিহ্নই সাক্ষ্য দেয়, কীভাবে আন্দোলনের ঢেউ সরাসরি হাসিনার দোরগোড়ায় পৌঁছে এবং তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করে। ধারণা করা হয়, বর্তমানে তিনি দিল্লির একটি অজ্ঞাত স্থানে অবস্থান করছেন।
নতুন খেলোয়াড়, নতুন কৌশল
বাংলাদেশে এখন রাজনীতির মঞ্চে নতুন শক্তিগুলি সক্রিয়। সবচেয়ে আগে নজর পড়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। এ বিষয়ে বুধবার থেকেই পদক্ষেপ নেয়া শুরু হবে বলে তিনি জানিয়েছেন জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে। ইউনূসের প্রস্তাবিত পথ- সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন। কিন্তু মূল চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে- এই সব প্রতিশ্রুতি এবং স্বপ্নের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা, যেখানে বিপরীতমুখী স্বার্থ ও আদর্শ একসাথে অবস্থান করছে। এই সুযোগে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), যারা গত ১৫ বছর রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা ছিল, তারা নতুন উদ্যমে নিজেদের সংগঠিত করছে। দলটি ইতিমধ্যে ‘৩১ দফা সংস্কার সনদ’ উপস্থাপন করেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করিয়ে দেন, এই সনদ প্রথম ২০১৬ সালেই তারা প্রকাশ করেন। তার দাবি, বিএনপিই ১৯৭৫ সালে বহুদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করে এবং ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। এখন তারা চায়- যত দ্রুত সম্ভব একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক।
জামায়াতের ফিরে আসা এবং উদ্বেগ
শেখ হাসিনার শাসনামলে নিষিদ্ধ থাকা জামায়াতে ইসলামীর ঘরোয়া রাজনীতি এখন আবার উন্মুক্ত হয়েছে। তবে তারা আদৌ কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, সেটি নির্ভর করছে পরবর্তী পদক্ষেপগুলোর ওপর। দলটির আমির ড. শফিকুর রহমান বলেছেন, জামায়াত গঠনমূলক রাজনীতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার পক্ষে- এবং তারা চান সহিংসতার বদলে শান্তিপূর্ণ সমাধান, আর সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে।
ছাত্রদের দল এনসিপি: এক নতুন সূর্যোদয়
২০২৪ সালের জুলাইয়ের ছাত্রআন্দোলনের অংশগ্রহণকারীরা গঠন করেছে নতুন রাজনৈতিক দল- ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি)। দলটির নেতাদের বয়স ২০ থেকে ৩০-এর কোঠায় এবং তাদেরকে দেখা হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠস্বর হিসেবে। এর নেত্রী তাসনিম জারা এবং নেতা নাহিদ ইসলাম পুরোনো রাজনৈতিক ধরনে বিশ্বাসী নন। তারা কাজ চালান অস্থায়ী অফিস থেকে, বৈঠক করেন মার্কেট, ইউনিয়ন হল কিংবা গ্রামের হাটে। তাসনিম বলেন, একদিন আমরা পরিবর্তন আনবো- এই আশাতেই পথ চলা। তাদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো- ঢাকার বাইরে প্রভাব বিস্তার এবং গ্রামাঞ্চলের ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে জাতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা।
আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি: এক নিরব প্রতিধ্বনি
গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া। শুধু শারীরিক অনুপস্থিতি নয়, যেন রাজনৈতিক আবহ থেকেই এক নিঃশব্দ নিষ্ক্রমণ ঘটেছে। সেই নিস্তব্ধতা ভাঙবে কীভাবে? এর একমাত্র উপায়- একটি মুক্ত, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এমন একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়েই নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠতে পারে- যেখানে জনগণকে বাদ দিয়ে শাসন আর চলবে না, কিংবা বিরোধী কণ্ঠকে দমন করেও কেউ টিকে থাকতে পারবে না। নাগাল্যান্ডের ভারতীয় নৃতত্ত্ববিদ আব্রাহাম লোথা একদা বলেছেন, যদি আপনি জনগণের কথা না শুনেন, তাহলে আপনি তাদের হয়ে লড়ার অধিকারও হারান। এই শিক্ষা ব্রহ্মপুত্রের দুই তীরেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
(দ্য উইক থেকে অনুবাদ)