
অধ্যাপক আসিফ নজরুল অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা। এক বছরে সরকারের সাফল্য–ব্যর্থতা, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার, ঢালাও মামলা, গ্রেপ্তার, মব–সন্ত্রাস, রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ, সমাজে বৈষম্য, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন কমিশন, নির্বাচন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। ১ আগস্ট আইন উপদেষ্টার সরকারি বাসভবনে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাজীব আহমেদ। আজ পড়ুন প্রথম কিস্তি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। আপনি কি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, সরকারের পতন আসন্ন?
আসিফ নজরুল: ধারণা করতে পেরেছিলাম। মিছিলে, সমাবেশে এমন পরিচিত মানুষদের দেখতে পারছিলাম, যাঁরা আগে কখনো আসেননি। তারপর শত নির্যাতনের পরও ছাত্রনেতাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় মানুষের ঢল, দ্রোহযাত্রা, সেনাসদরে সেনাপ্রধানের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছিল, শেখ হাসিনা এবার আর টিকতে পারবেন না। ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে ছাত্র–জনতার বিশাল সমাবেশে বলেছিলাম, জয় তোমাদের সুনিশ্চিত।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কি আপনার সঙ্গে ৫ আগস্টের আগেই যোগাযোগ করা হয়েছিল? তারা কী বলেছিল?
আসিফ নজরুল: জুলাইয়ের একদম শেষ দিকে রাতের বেলায় সেনাবাহিনীর পরিচয় দিয়ে সিভিল ড্রেসে একজন এসেছিলেন আমাদের পাড়ায়।
আমাকে খুব সাবধানে থাকতে এবং রাতে বাসায় না ঘুমাতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি আদৌ সেনাবাহিনীর কি না, তা নিয়ে তখন সংশয় ছিল। ভয়ে অবশ্য তাঁর পরিচয় ভেরিফাই করার চেষ্টা করিনি। এরপর ৫ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার ফোন করে তাঁর পরিচয় জানিয়ে আমাকে ক্যান্টনমেন্টে আসার আমন্ত্রণ জানান। আমি রিজওয়ানা হাসান আর মির্জা ফখরুল ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমার স্ত্রী খুবই ভয় পেয়েছিল। সে দোয়া পড়ছিল, সেনাবাহিনী যে গাড়ি পাঠিয়েছিল, সে সেটার ছবি তুলে রেখেছিল। তারা তাকে বারবার অভয় দিচ্ছিল। এরপর ৫ তারিখ সারা দিন যে অভিজ্ঞতা হলো, তা অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য।
পার্থক্য হলো, আগের সরকারের সময় সরকার মামলা করত। এখন ভুক্তভোগী মানুষ মামলা করছেন। আগের আমলে পুরো মামলাই ছিল গায়েবি, পুরোপুরি কল্পিত। এখন মামলার অভিযোগটা সত্যি, অনেক লোককে যে জড়ানো হচ্ছে, এটা হয়তো সত্যি নয় অনেক ক্ষেত্রে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তিতে আমি আপনার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন বলেছিলেন, মানুষের নিয়ত যদি সৎ হয়, দেশপ্রেম ও ইচ্ছাশক্তি থাকে, তাহলে যেকোনো কাজ করা সম্ভব। এখন এক বছর পূর্তিতে আমি জানতে চাই, সরকার আসলে কী করতে পারল, আপনার মন্ত্রণালয় কী করতে পারল?
আসিফ নজরুল: আপনাকে যেটা বলেছিলাম, তা অনেকাংশে সত্যি। যেকোনো কাজ করা সম্ভব না হলেও অনেক কিছু করা যায়। আমার মন্ত্রণালয় কী করেছে, তার একটা হিসাব দিয়েছি ৩১ জুলাই। আমরা ১৬-১৭টি আইন (নতুন ও সংশোধন) করেছি। দেওয়ানি ও ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা, লিগ্যাল এইড সার্ভিসকে সম্প্রসারিত করা, অনলাইন বেল (জামিন) বন্ড দেওয়ার আইন করা, ডিজিটালাইজেশনের পদক্ষেপ—এমন অনেক কিছু আছে। কিছু কাজ আমরা করেছি, যেটা আগের কোনো সরকারের আইন মন্ত্রণালয়কে করতে হয়নি। আমরা ১৬ হাজারের বেশি হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছি। এটা শুধু বৈঠক করে হয় না, মামলার নথি ধরে ধরে পর্যালোচনা করতে হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ রকম নেই যে একটা মন্ত্রণালয় এক বছরে প্রায় পাঁচ হাজার সরকারি আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে, সেটি করেছি।
আমি মনে করি, সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য অর্থনৈতিক খাতের শৃঙ্খলা আনা। আমরা শেখ হাসিনার আমলে শুনতাম, তিনি নিজেও বলেছিলেন, দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে। অর্থনীতিতে ধস নামার লক্ষণ ছিল। সেটা ঠেকানো গেছে। আমি সব সময় শুনতাম যে এ রকম একটা পরিস্থিতিতে বিনিময় হার (ডলারের দাম) অত্যন্ত বেড়ে যায়। সেটা বাড়েনি, বরং এখন কমতির দিকে। আমাদের রিজার্ভ (বৈদেশিক মুদ্রার মজুত) বেড়েছে, ব্যবস্থাপনা ভালো হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা আসছে, মানুষের আস্থা ফিরছে। রোজার মাসে দ্রব্যমূল্য কিছু কিছু কম রাখা গেছে। হজ ব্যবস্থাপনার উন্নতি হয়েছে। অপচয় কমানো গেছে। ফাওজুল কবির ভাইয়ের (বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান) হাতে যেসব মন্ত্রণালয় আছে, সেখান থেকে তিনি ৪৫ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করেছেন। এটা অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কাটছাঁট ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে করা হয়েছে।
বিপ্লব-উত্তর পরিস্থিতিতে যে বিশৃঙ্খল একটা অবস্থা থাকে, সেটা যদি না থাকত, আরও বেশি কিছু করা যেত।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আপনি ৩০ বছর বিভিন্ন সরকারের অন্যায় কাজের সমালোচনা করেছেন। এখন সরকারে আছেন। আসলে কী করতে পারেননি?
আসিফ নজরুল: আমাদের দুটি বড় ব্যর্থতা হচ্ছে ‘মব–সন্ত্রাস’ ও ঢালাও মামলা। মব–সন্ত্রাস দমন করার ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, পুলিশ মোরাল (নৈতিক অবস্থান) ছিল না। যে পুলিশ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিপক্ষ ছিল, সেই পুলিশ যখন দেখে গণ-অভ্যুত্থানের দাবিদার বলে কিছু মহল মব করছে, তখন সেটা দমন করতে পারেনি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অসহায় হয়ে মাঝেমধ্যে বলেন, ‘আপনারা আমাকে ক্লিয়ারলি (পরিষ্কারভাবে) বলেন কী করব, বল প্রয়োগ করব, নাকি করব না।’ আমরা পুলিশের ভয়াবহ বলপ্রয়োগের স্মৃতির পর সেটা করতে বলতে পারি না। দেখবেন, অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ উল্টো মার খেয়েছে। গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লব-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে শৃঙ্খলা একটু কমে যায়। কারণ, তারা একটা অন্য রকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট রেজিমের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। হঠাৎ করে সবাই সুশৃঙ্খল হয়ে যায় না। আপনি মহান মুক্তিযুদ্ধের পরের অবস্থা দেখেন, সেখানে তো একটা দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল। তারপরও তো শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। তবে আমরা বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি।
আপনি মুক্তিযুদ্ধের পরের কথা বললেন। সেটার মাশুল তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দিতে হয়েছে। তাঁর সরকার খুব দ্রুত অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছিল। পরবর্তী সময়ে তিনি নৃশংস হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হন।
আসিফ নজরুল: সেই সময় তো অনেক সন্ত্রাস হয়েছে সরকারের স্বার্থ পূরণের জন্য। যেমন রক্ষীবাহিনীর কর্মকাণ্ড বা সিরাজ শিকদারের মতো নেতাদের হত্যা। এখনকার সময়ে আপনি কী দেখেছেন, আসিফ নজরুল বা অন্য কোনো উপদেষ্টা মব–সন্ত্রাস করাচ্ছেন? কিংবা ক্ষমতায় থাকার জন্য আমরা বাহিনী লেলিয়ে দিচ্ছি। তখন এক দলের দুঃশাসন ছিল। এখন তো পার্সপেকটিভটা ডিফারেন্ট (পটভূমি ভিন্ন)।
আসিফ নজরুলকে মব করাতে দেখিনি, তবে আমরা দেখেছি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তারা মব দমন করতে চেয়েছেন। পরে তাঁদের প্রত্যাহার করা হয়েছে।
আসিফ নজরুল: দু-একটা ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্বার্থে প্রত্যাহার করতে হয়েছে। আপনি তো জানেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন কী রকম বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়। এমন পরিস্থিতিতে কোনো কোনো কর্মকর্তাকে আরও ভালো জায়গায় (প্রত্যাহার করে) নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এটা শাস্তি হিসেবে নয়।
ঢালাও মামলার কথা আপনি বলছিলেন।
আসিফ নজরুল: দেখেন, মামলা সরকার করেনি, করেছেন ভুক্তভোগীরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে মামলা–বাণিজ্যের প্রত্যাশী একশ্রেণির আইনজীবী জুটে গেছেন।
কিছু দলের কিছু নেতাও জড়িত।
আসিফ নজরুল: প্রশ্ন হলো, পুলিশ ফিল্টার (যাচাই করে আসামি করা) করতে পারে না কেন? প্রথম দিকে পুলিশকে আমরা বলেছিলাম। পুলিশ যখন ফিল্টার করতে গেছে, তখন তাদের বলা হয়েছে যে তারা সারা জীবন ২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েছে। এখন সমস্যা কী? পুলিশের ওই নৈতিক মনোবলটাই নেই। সারা হোসেন (সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী) বললেন, ‘আপনারা পারছেন না কেন?’ আমি বললাম, আপনি আমাকে সলিউশন (সমাধান) দেন। আজকে তিন মাস হয়ে গেছে। তারপর আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করেছি।
দুঃখিত স্যার। আপনাকে থামিয়ে একটা প্রশ্ন করি। সেটা হলো, আপনি বলছেন সরকার একটা মামলাও করেনি। কিন্তু সরকারের পাবলিক প্রসিকিউটর, সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল মামলাগুলোয় জামিনের বিরোধিতা করছেন। কেউ হাইকোর্টে জামিন পেলে আপিল করে আটকে দেওয়া হচ্ছে। এক মামলায় জামিন পেলে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
আসিফ নজরুল: মামলাগুলো হত্যার ঘটনার। এসব মামলায় আওয়ামী লীগের লোকেদের সংশ্লিষ্টতা বা মদদ নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ কম। কিন্তু এর বাইরে যাঁরা নিরীহ সাধারণ মানুষ আছেন, তাঁদের অনেকে জামিন পাচ্ছেন। কয়েকজন নেতাও পেয়েছেন। আমি কয়েকটা নাম চট করে বলি, প্রফেসর আবদুল মান্নান জামিন পেয়েছেন, সাবের হোসেন চৌধুরী জামিন পেয়েছেন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে গ্রেপ্তারই করা হয়নি। এ রকম কিছু উদাহরণ কিন্তু আছে।
আমিও যোগ করি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকও জামিন পেয়েছেন। এ রকম কয়েকটি ঘটনা আছে। কিন্তু সেটা সমালোচনা হওয়ার পর। এটাও বলা হয় যে বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকদের তো হত্যা মামলায় আটকে রাখার কারণ নেই। তাঁদের দুর্নীতি বা অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি খতিয়ে দেখাই সমীচীন।
আসিফ নজরুল: বোধ হয় শতাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমার জানামতে, সাত-আটজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। আপনাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলছি, মামলাগুলোর পেছনে সরকারের কোনো পক্ষের মদদ নেই। এখন আপনাকে বলি, ধরেন, যারা সাধারণ ভুক্তভোগী, তারা যখন দেখেছে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, তখন কোনো সাংবাদিক যদি রক্তপিপাসু প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘আপনি যা করছেন ঠিক আছে। আমরা আপনার সঙ্গে আছি,’ সেটা কি মদদ নয়?
সেটার বিচার তো ট্রাইব্যুনালে হতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট হত্যা মামলায় তাঁদের আসামি করা কি যৌক্তিক?
আসিফ নজরুল: যাঁরা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে অভিযুক্ত, তাঁদের ক্ষেত্রে তো কমান্ড রেসপনসিবিলিটির ব্যাপার আসবে। কিন্তু তার বাইরে যেটা আছে, এই ইনস্টিগেশন করা (উসকানি দেওয়া), এটা কেউ কেউ করেছে। এটা তো গুরুতর অপরাধ।
তাহলে আপনি কি বলছেন, বিচার যত দিন চলবে, তাঁরা কারাগারে থাকবেন?
আসিফ নজরুল: সেটা তো আমি বলতে পারব না। বিচার চলাকালে যদি বিচারক মনে করেন...এটা বিচারকের বিবেচনার বিষয়।
১৫ বছর বিচারকদের ভয়ের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করা হয়েছে। বলে দেওয়া হয়েছে, কাকে জামিন দেবেন, কাকে দেবেন না। সেই বিচারকেরও নিজের অতীতের কথা মনে পড়ে যে অতীতে আমি কী করেছি বা কীভাবে ইউজড (ব্যবহৃত) হয়েছি। ১৫ বছর ভয়ের পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে এবং ওই রাজনৈতিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দিয়ে এখন হঠাৎ করে তাঁর মানসজগতে নিজের অতীত বিবেচনা বা বর্তমান পরিস্থিতির বিবেচনা উঠে যাবে, এটা সবার ক্ষেত্রে না–ও হতে পারে।
বিচারক কি স্বাধীনভাবে রায় দিতে পারেন? বলা হচ্ছে, বিচারালয়ে ভয়ের পরিবেশ আছে। ধরুন, আজকে বিচারক সাংবাদিক শ্যামল দত্তকে জামিন দিলেন। পরের দিন বিচারক মবের শিকার হবেন না, সেটা নিশ্চিত?
আসিফ নজরুল: আমি তো বিচারকের মানসিক অবস্থা বলতে পারব না। তবে আপনাকে একটা জিনিস বলি, ১৫ বছর বিচারকদের ভয়ের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করা হয়েছে। বলে দেওয়া হয়েছে, কাকে জামিন দেবেন, কাকে দেবেন না। সেই বিচারকেরও নিজের অতীতের কথা মনে পড়ে যে অতীতে আমি কী করেছি বা কীভাবে ইউজড (ব্যবহৃত) হয়েছি। ১৫ বছর ভয়ের পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে এবং ওই রাজনৈতিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দিয়ে এখন হঠাৎ করে তাঁর মানসজগতে নিজের অতীত বিবেচনা বা বর্তমান পরিস্থিতির বিবেচনা উঠে যাবে, এটা সবার ক্ষেত্রে না–ও হতে পারে।
কিন্তু স্যার, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের তো একটা বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল ন্যায়বিচার।
আসিফ নজরুল: ন্যায়বিচারের সংজ্ঞা কার কাছে কী? কমপক্ষে হাজার লোক মারা গেছেন, কমপক্ষে এক লাখ কোনো না কোনোভাবে আহত হয়েছেন, ১৫ বছরে লাখ লাখ মানুষ জীবিকা থেকে বঞ্চিত হওয়া, গুমসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তাঁরা যদি মনে করেন, এটাই (মামলায় আসামি করা) তো আমার এখন ন্যায়বিচার। আমাকে একটা আইন দেখান যে আমরা কাউকে মামলা করা থেকে বিরত করতে পারি। আপনাকে আবার বলি, পুলিশ কেন স্ক্রুটিনি (যাচাই-বাছাই) করে না। আগের আমলে পুলিশ এক পক্ষের মামলা নিত, আরেক পক্ষের নিত না। এখন পুলিশ মামলা নিচ্ছে। ১৫ বছরের যে অপরাধবোধ, যে সংস্কৃতি, সেই একই পুলিশ, একই বিচারালয়, রাতারাতি মুক্ত হয়ে যাবে, এটা এত সহজ না। আরেকটা কথা আপনাকে বলি, মামলা তো ভুয়া না। আপনি অভিযোগ করতে পারেন যে মামলায় অনেক লোককে জড়ানো হয়েছে, যাঁরা এই মামলায় জড়িত হওয়ার কথা নয় এবং এর মাধ্যমে বাণিজ্য করা হচ্ছে।
মামলা ভুয়া, সেটা বলছি না। আগের সরকারের আমলে ছিল ‘গায়েবি মামলা’। এখন ‘ইচ্ছেমতো’ আসামি।
আসিফ নজরুল: হ্যাঁ, বলতে পারেন। তবে পার্থক্য হলো, আগের সরকারের সময় সরকার মামলা করত। এখন ভুক্তভোগী মানুষ মামলা করছেন। আগের আমলে পুরো মামলাই ছিল গায়েবি, পুরোপুরি কল্পিত। এখন মামলার অভিযোগটা সত্যি, অনেক লোককে যে জড়ানো হচ্ছে, এটা হয়তো সত্যি নয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু স্যার, বিগত সরকারের আমলে মামলা দিয়ে দিনের পর দিন জেলে আটকে রাখা হতো, জামিন দেওয়া হতো না, এখনো আমরা সেটাই দেখি।
আসিফ নজরুল: পার্থক্য আছে। আগের সরকারের আমলে গায়েবি মামলা দিয়ে অনেক আসামি করা এবং প্রচুর আসামিকে ধরা হতো। আমরা পুলিশকে কড়াভাবে বলে দিয়েছি, প্রমাণ পেলেই কেবল আসামি ধরা যাবে। আমার ধারণা, আমাদের সরকারের সময় মোট আসামির বড়জোর ১০ শতাংশকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সর্বশেষ উদাহরণটি দেখি। একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি (খায়রুল হক), যাঁর বিরুদ্ধে চরম বিতর্কিত রায় দেওয়া, রায় পরিবর্তনের অভিযোগ আছে। কিন্তু হত্যা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা কি যৌক্তিক মনে হচ্ছে?
আসিফ নজরুল: ওনার বিরুদ্ধে তিনটা মামলা রয়েছে। পুলিশ তাঁকে আদালতে তুলেছে হত্যা মামলায়। পরে তাঁকে রায় পরিবর্তন–সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং রিমান্ডও এই মামলায় শুধু চাওয়া হয়েছে। আপনাকে একটা কথা বলি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে চূড়ান্ত রায় যাঁরা লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে দুজন বিচারপতি লিখেছেন, বিচারপতি খায়রুল হক সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ের ব্যত্যয় করেছেন। এটা তো আইনসিদ্ধ নয়। তাই তাঁকে গ্রেপ্তার করা, রিমান্ডে নেওয়া নিয়ে আপনি প্রশ্ন তুলতে পারেন না।
না স্যার, তাঁকে গ্রেপ্তার-রিমান্ড নিয়ে আমার প্রশ্ন নেই। আমার প্রশ্ন, কেন রায় জালিয়াতির বদলে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার?
আসিফ নজরুল: ১৫ বছর পুলিশ নিয়োগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিবেচনা ছিল আওয়ামী লীগ করে কি না, অনেক ক্ষেত্রে গোপালগঞ্জ বাড়ি কি না। সেই পুলিশের সবাই আমাদের জন্য শতভাগ আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করবে—এটা বোধ হয় একটু বেশি চাওয়া। পুলিশে দক্ষতার ঘাটতিও আছে। পুলিশে আবার অনেকেই আছেন, যাঁরা দায়িত্বশীল ও আন্তরিক।
জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। বিচার কতটা এগোল?
আসিফ নজরুল: দুই জায়গায় বিচার হচ্ছে। একটা হলো সাধারণ আদালতে। অন্যটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা যথেষ্ট ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের তদন্ত ও প্রসিকিউশন দলের কাছে প্রথম থেকে প্রত্যাশা ছিল, মামলা যেন যেনতেনভাবে পরিচালিত না করা হয়। শক্ত প্রমাণ যাতে থাকে এবং তা নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে। আপিলের আদালতে রায় যেন টিকে থাকে। শেখ হাসিনার আমলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যে বিচার হয়েছিল, সেখানে টেলিফোনে-স্কাইপে রায় লিখে নিয়ে আসত। এখানে এ রকম কিছু হবে না। আমরা গত নভেম্বরে কাজ শুরু করেছি। আট মাসের মাথায় মামলার বিচার শুনানি পর্যায়ে চলে গেছে। আমি মনে করি, এটা যথেষ্ট অগ্রগতি।
আমি জানি, আপনি প্রশ্ন করবেন যে আমি বলছি বিচার এত দিনে হয়ে যাবে। দেখেন, এ বিষয়ে আমি আমার ধারণা ও প্রত্যাশার ভিত্তিতে কথা বলি। যখন শহীদ পরিবারগুলো কাঁদতে থাকে, তখন খুব ইচ্ছা করে যে আমি নিজের ধারণার কথা বলি। প্রসিকিউশন টিমের সঙ্গে আমি যোগাযোগ রাখি। আমি জানি, মামলা কোন জায়গায় রয়েছে। সেটার ভিত্তিতে অ্যানালাইজ করে (বিশ্লেষণ) বলেছি। প্রথমবার বিচারে যথেষ্ট অগ্রগতি ছাড়াই বলেছি, অক্টোবরের মধ্যে হয়তো রায় হবে। এখন বিচারের গতি দেখে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, অক্টোবরে না হলেও ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে হবে। আমি যখন অক্টোবরের মধ্যে বলেছিলাম, তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারপতিরা আমাকে সতর্ক করেছিলেন। এটাই তো প্রমাণ যে আমাদের আদালত কতটা নিরপেক্ষ।
বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয়ের অগ্রগতি কতটা?
আসিফ নজরুল: পৃথক সচিবালয় মানে শুধু চেয়ার-টেবিল দেওয়া নয়। কয়েক দিন আগে একটা রুলস (বিধি) পাস হয়েছে, যেখানে বিচার বিভাগের পদ সৃজন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে হওয়ার কথা বলা হয়েছে। পদায়ন বিধিমালা হয়েছে। আরও কিছু বিধিমালা করতে হবে। আমি মনে করি, আমাদের যে গতিপথ ও কর্মপরিকল্পনা রয়েছে, এটা (পৃথক সচিবালয়) ডিসেম্বরের আগে হয়ে যাবে।
আচ্ছা, পৃথিবীতে কোন দেশে সরকারের ভেতর সরকার থাকে না? পৃথিবীর সব সরকারের ভেতরে সরকার থাকে, যাকে ‘কিচেন কেবিনেট’ (যাঁদের প্রভাব বেশি) বলা হয়। তবে সরকারের বাইরের কেউ সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরে গণ-অভ্যুত্থান হলো। সমাজে যে আয়বৈষম্য ও বৈষম্য, সেটা কমাতে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সারা জীবন দরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে সরকারের কি আরও ভূমিকা রাখা উচিত ছিল? এই সরকার এক বছরে দরিদ্র মানুষের জন্য বাড়তি কী করেছে?
আসিফ নজরুল: আমি আসলে অর্থনৈতিক বিষয়টা খুব কম বুঝি। কিন্তু আমি সব সময় দেখতাম, বলা হতো যাতে কোনোভাবেই দ্রব্যমূল্য না বাড়ে। আর কর্মসংস্থান যেন বৃদ্ধি পায়। দুটি জিনিস উনি (অধ্যাপক ইউনূস) সব সময় বলতেন। এখন ধরেন দ্রব্যমূল্য তো অনেক ক্ষেত্রে সহনীয় রাখা গেছে।
মূল্যবৃদ্ধি আগে হতো ১১-১২ শতাংশ, এখন সেটা ৮ শতাংশে নেমেছে।
আসিফ নজরুল: এটা সাকসেস (সফলতা) নয়?
সফলতা নয়, সেটা বলছি না। বলছি, দরিদ্রদের জন্য এই মূল্যস্ফীতিও সহনীয় নয়।
আসিফ নজরুল: কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, আমাদের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগপদ্ধতিতে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। এখানে হয়তো আমাদের আরও কিছু করার ছিল।
বাজেটে আমরা দেখলাম, দরিদ্র মানুষের ভাতা বেড়েছে ৫০ টাকা, কোনো ক্ষেত্রে ১০০ টাকা; যে হারে শেখ হাসিনাও বাড়াতেন। শ্রম কমিশনের প্রতিবেদন হিমাগারে পড়ে আছে।
আসিফ নজরুল: অনেকেই প্রশ্নটা তোলেন যে এই পাঁচটা কমিশন করা হলো কেন (জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় না থাকা পাঁচ কমিশন—নারী, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রম ও স্থানীয় সরকার)। এসব কমিশনের আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ আমি নিজে স্যারের (অধ্যাপক ইউনূস) নির্দেশে দু-এক মাস আগে মন্ত্রণালয়গুলোয় পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, এটা ফলোআপ করার এখতিয়ার আমার নেই। তবে স্যার উপদেষ্টাদের সঙ্গে কিছুদিন পরপর বসছেন এবং জিজ্ঞাসা করছেন যে তাঁদের ক্ষেত্রে সংস্কারকাজের অগ্রগতি কী।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি প্রাণ দিয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ ও শিক্ষার্থীরা। সরকারি চাকরিজীবীরা বিগত সরকারকে শেষ সময়েও অসহযোগিতা করেননি। আমলাদের হাতে রাখতে শেখ হাসিনা গাড়ি কেনা, ফ্ল্যাট কেনায় ঋণসুবিধা দিয়েছিলেন। আপনারা সেটা বাতিল করেননি। আপনারা এসে সরকারি চাকরিজীবীদের বাড়তি ইনক্রিমেন্ট (বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি) দিলেন, এখন আবার বেতন কমিশন গঠন করা হলো। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো হোক, কিন্তু শ্রমজীবীদের জন্য কী করেছেন?
আসিফ নজরুল: বেতন কমিশনের বিষয়ে আমি আপনাকে ঠিক বলতে পারব না। কারণ, এটা জনপ্রশাসনের ব্যাপার। আর এই সরকারের প্রতি সবার (আমলাদের মধ্যে) লয়ালিটি (আনুগত্য) নিয়ে প্রশ্ন আছে, দক্ষতা ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এখন হঠাৎ করে বলব, আপনার ব্যবহৃত গাড়ি-বাড়ি সব ফেরত দেন, এটা কি বাংলাদেশের বাস্তবতায় সম্ভব?
প্রকল্পের যে গাড়ি সরকারের পরিবহন পুলে জমা না দিয়ে আমলারা ব্যবহার করেন, সেগুলো তো ফেরত নিতে পারতেন।
আসিফ নজরুল: এটার ডিটেইল (বিস্তারিত) তথ্য আপনাকে দিতে পারব না। কিন্তু প্রকল্পের গাড়ির ক্ষেত্রে খুবই কড়া মনোভাব আমাদের রয়েছে।
সরকারের ভেতরে কি কোনো সরকার আছে?
আসিফ নজরুল: আচ্ছা, পৃথিবীতে কোন দেশে সরকারের ভেতর সরকার থাকে না? পৃথিবীর সব সরকারের ভেতরে সরকার থাকে, যাকে ‘কিচেন কেবিনেট’ (যাঁদের প্রভাব বেশি) বলা হয়। তবে সরকারের বাইরের কেউ সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করে না।