Image description
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

জুলাই আন্দোলন দমনে হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের নির্দেশদাতা শেখ হাসিনাসহ মূল অপরাধীদের বিচার চলতি বছরের মধ্যেই সম্পন্ন হতে পারে। তবে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের পর কতোদিনের মধ্যে তার বিচার হতে হবে, সে সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংশ্লিষ্ট আইনে কিছু উল্লেখ নেই। ইতিমধ্যে প্রসিকিউশন অফিস ৪টি মামলার আনুষ্ঠানিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাবেক ১৩ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এসব মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে গণহত্যায় হাসিনার সরাসরি নির্দেশনার প্রমাণ মিলেছে। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, সাংবাদিকসহ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া অনেক সমন্বয়ক।

সাবেক এসব মন্ত্রী-আমলাদের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের ফরেনসিক প্রতিবেদন ব্যবহার হতে পারে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের একটি আইফোন ও দু’টি স্যামসাং ফোন উদ্ধার করে ইতিমধ্যে ফরেনসিক সম্পন্ন হয়েছে। অধিকাংশ আসামির মোবাইল ফোন উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি বলে মানবজমিনকে জানিয়েছেন প্রসিকিউশন।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ই আগস্ট দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য নির্ধারণ করা হয়। শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ৩ আসামিকে নির্দেশদাতা উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে আনা ৫টি অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আগামী ৩রা আগস্ট হাসিনার আমলে নির্যাতিত সাংবাদিক ‘আমার দেশ’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপেনিং সাক্ষ্যদানের মাধ্যমে শুরু হবে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ। রাজধানীর চানখাঁরপুলে মামলায় অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ওপেনিং সাক্ষ্য দেবেন। এ ছাড়াও গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়া নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, জুলাই আন্দোলনে আহত ও শহীদ পরিবারের সদস্য, ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সাক্ষী দেবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায়। কয়েক ধাপে নেয়া হবে এসব সাক্ষ্য। কেউ দেশের পূর্ব ইতিহাস, স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস, আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের ইতিহাস, এ ছাড়াও জুলাই আন্দোলনে সরাসরি অংশ নেয়া জুলাইযোদ্ধারা করবেন আন্দোলনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের বর্ণনা। 

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো দ্বারা গুম, খুন ও জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এখন পর্যন্ত ২৭টি মামলা দায়ের হয়েছে। এরমধ্যে গুমের অভিযোগে ৫টি মামলার বিচারকাজ চলমান। বাকি ২৫টি মামলা জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে চলা হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা। এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ৪টি মামলার ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়েছে। বিবিধ মামলা হিসেবে ২৫টি মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার ৭৬ জন। এদের মধ্যে ৮ জনকে একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ১৩২ জন পলাতক। কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন ১ জন। এ ছাড়াও ২০৬ জনের বিভিন্ন অভিযোগে বিচার চলমান।

হাসিনাকে নির্দেশদাতা উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে আনা ৫টি অভিযোগ আমলে নিয়ে আগামী ৩রা আগস্ট মামলার ওপেনিং সাক্ষী ও ৪ঠা আগস্ট থেকে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে। এ মামলায় গ্রেপ্তারকৃত একমাত্র আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ট্রাইব্যুনালে দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন। মামলায় ২০-২৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ নেয়া হবে। ওপেনিং সাক্ষ্যগ্রহণে সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান সাক্ষ্য দেবেন। তিনি আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বর্ণনা করবেন। এদিন ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে তা সরাসরি সম্প্রচার হতে পারে। এ ছাড়াও লেখক, গবেষক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর, শিবিরের সাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আলী আহসান জুনায়েদ মামলায় সাক্ষ্য দিবেন।

এদিকে, রাজধানীর চানখাঁরপুলে ৬ জন তরুণকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ৮ জন আসামির বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আগামী ১০ই আগস্ট প্রসিকিউশন সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করবেন। ১১ই আগস্ট সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১। গত ৫ই আগস্ট চানখাঁরপুলে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সেদিন তিনি কী দেখেছেন, তা ট্রাইব্যুনালের সামনে তুলে ধরবেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম মানবজমিনকে বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা বিচারের প্রথম শর্ত হচ্ছে, ট্রাইব্যুনালের সামনে ঘটনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে হবে। হঠাৎ করে ঘটা কোনো ঘটনা মানবতাবিরোধী অপরাধ নয়। ট্রাইব্যুনালের সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া মূলত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই প্রক্রিয়ায়, সাক্ষীগণ আদালতে এসে ঘটনার বিবরণ দেন, যা বিচারকার্যে সহায়তা করবে। সাক্ষীরা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বা ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহ করবেন। মূলত বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের বর্ণনা দিয়ে তারা সাক্ষ্য দেবেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের পতনের ইতিহাস সাক্ষীদের সাক্ষ্যে ফুটে উঠবে।

এ ছাড়া জুলাই আন্দোলনে সরাসরি অংশ নেয়া আহত জুলাইযোদ্ধারা ঘটনার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করবেন। তারা কীভাবে আহত হয়েছিলেন তা বর্ণনা করবেন। অনেক আন্দোলনকারী একসঙ্গে আন্দোলনে গিয়ে বন্ধু কিংবা স্বজন হারিয়েছেন। তারা প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ঘটনার বর্ণনা দেবেন বলে জানান তিনি।

তামিম বলেন, ন্যায়বিচারের স্বার্থে ট্রাইব্যুনাল যে কারও সাক্ষ্য নিতে পারেন। তবে ঘটনা প্রমাণ করতে ২০/২৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণই যথেষ্ট। সাক্ষীদের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের নাম- পরিচয় প্রকাশ করা হবে না। সাক্ষ্যগ্রহণের পূর্বে আদালতের আদেশের প্রেক্ষিতে সাক্ষীদের কাছে সমন জারি করা হবে। এ ছাড়াও তদন্ত সংস্থা সাক্ষীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী দেয়ার জন্য বলতে পারবেন।