
বিদায়ি অর্থবছরের একেবারে শেষ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। হিসাবের ঘাটতি অর্থায়ন করতে এই ঋণ নিয়ে সমন্বয় করা হয়েছে। তবে এটি নতুন ঋণ নয়, সরকার আগে যে ঋণ নিয়েছিল, তা থেকে অনেক অর্থ পরিশোধ করেছে। কিন্তু অর্থবছরের শেষদিকে সরকারের হিসাবে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় পরিশোধ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বরং আগে পরিশোধ করা অর্থ থেকে সরকার সমপরিমাণ অর্থ অন্য খাতে নিয়ে গেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় সরকারের ঋণ বেড়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ কম করে আয়ের অর্থ অন্য খাতে নিয়ে গেছে। মে মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধের স্থিতি ছিল ৫০ হাজার কোটি টাকা। ১৫ জুনে এসে পরিশোধের স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকায়। বাকি ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ কম করে ঘাটতি সমন্বয় করা হয়েছে। অর্থাৎ ছাপানো টাকায় সরকারের ঋণ কমার পরিবর্তে বেড়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। ১৫ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত হিসাবে নিলে ছাপানো টাকায় সরকারের ঋণ বেড়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
তবে ছাপানো টাকা সরকারের নেওয়া ঋণের বিপরীতে পরবর্তী সময়ে ট্রেজারি বিল ইস্যু করে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা তুলে নিচ্ছে। ফলে ওইসব ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের না হয়ে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে নেওয়া ঋণে পরিণত হচ্ছে।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি হিসাবে টাকার ঘাটতি দেখা দিলে তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক পরিশোধ করে দেবে। ওই ব্যাংক সমপরিমাণ টাকা সোনালী ব্যাংক থেকে নেবে। সোনালী ব্যাংকে সরকারের হিসাবে টাকা না থাকলে তারা ওই টাকা পরিশোধ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে চাইবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের হিসাবে টাকা থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে তা সোনালী ব্যাংককে দিয়ে দেবে। আর সরকারের হিসাবে না থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ সৃষ্টি করে সোনালী ব্যাংককে দিয়ে দেবে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকও যখন সরকারের পক্ষে লেনদেন করে তখন সরকারের হিসাবে টাকা না থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ সৃষ্টি করে লেনদেন নিষ্পত্তি করবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ১৫ জুন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের হিসাবে যথেষ্ট টাকা ছিল না। কিন্তু লেনদেনের চাপ ছিল। যে কারণে আগের পরিশোধ করা অর্থ থেকে নতুন করে সরকারকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। ফলে সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিশোধ কমেছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের স্তিতি বেড়েছে। বিদায়ি অর্থবছরে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রাজস্ব আয় কম হয়েছে। যে কারণে সরকারকে বাড়তি ঋণ নিতে হয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নিয়েছিল। সাড়ে ১৫ বছরে সরকার ছাপানো টাকায় ঋণ নিয়েছিল ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি বেড়ে ১ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকাকে বলা হয় হাইপাওয়ার্ড মানি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক টাকা বাজারে এসে দ্বিগুণের বেশি টাকার সৃষ্টি করে। এতে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায়। এর প্রভাবে বাড়ে পণ্যমূল্য ও কমে টাকার মান। মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির এটি অন্যতম একটি কারণ। যে জন্য আওয়ামী লীগের শেষ দিকে বিশেষ করে করোনার সময় থেকে ছাপানো টাকায় ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ২০২২ সালের বৈশ্বিক মন্দার ধাক্কা সামাল দিতে এ ঋণের প্রবণতা আরও বাড়ে। যে কারণে ওই সরকারের সময়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠেছিল। একই সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২০২২ সালের আগস্ট থেকে চড়া মূল্যস্ফীতির চাপ যে ভোক্তার কাঁধের ওপর পড়ে, সেই চাপ এখনো মোকাবিলা করতে হচ্ছে ভোক্তাকে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন সরকার গঠিত হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় ঋণ নেওয়া বন্ধ করে। আগে লুটপাটের কারণে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ছাপানো টাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্যের জোগান হতো সেটি বন্ধ করা হয়েছে। তবে সীমিত কয়েকটি ব্যাংককে ছাপানো টাকায় কিছু ঋণ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ছাপানো টাকায় নেওয়া ঋণ সরকার পরিশোধ করা শুরু করে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ দেওয়া বাবদ যেসব ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়া হয়েছিল সেগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে নিতে থাকে।
২০২৪ সালের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা। ১৫ মে পর্যন্ত সরকার ৫৮ কোটি টাকা শোধ করে অর্থাৎ ছাপানো টাকায় আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া ঋণ বাবদ ৫৮ কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের স্থিতি কমে লাখ কোটি টাকার নিচে নেমে আসে। অর্থাৎ ১৫ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের স্থিতি ৯৮ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। কিন্তু রাজস্ব ঘাটতির কারণে সরকারের ঋণ আবার বাড়তে থাকে। তখন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিচ্ছিল। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট থাকায় জরুরিভিত্তিতে কিছু ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও নিচ্ছিল। অর্থাৎ আগে যেসব ঋণ পরিশোধ করেছিল সেগুলো থেকে আবার ঋণ নিয়েছে। ফলে জুলাই থেকে মে পর্যন্ত সরকারের ঋণ পরিশোধ কমে দাঁড়ায় ৫০ কোটি টাকা। ১৫ মে থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সরকারের ঋণ বাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের স্থিতি আবার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ওই সময় পর্যন্ত স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। সরকারের রাজস্ব আয় কম হওয়ায় হিসাবে ঘাটতি দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের জোগান বাড়িয়ে দেয়। ফলে ১৫ জুনে সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ কমে দাঁড়ায় ২৩ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত সরকারের ঋণ বাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা। ওই সময়ে ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ ১৫ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত এক মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
গত অর্থবছরের ১৫ জুন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। নন-ব্যাংক খাত থেকে নিট ঋণ নিয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল ৮২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। নন-ব্যাংক খাত থেকে নিয়েছিল ১২ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ে ঘাটতির কারণে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে খরচ কম ও কৃচ্ছ সাধনের পরও ব্যাংক ঋণ বেড়েছে।