
পাঁচ বছরের তায়েবা হকের কান্না থামছে না। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আইসিইউর সামনে ৭ দিন ধরে মা-বাবা, দাদিসহ স্বজনদের সঙ্গে সে থাকবেই। ছোট্ট তায়েবা বাঁচা-মরা বোঝে না। তার একটাই আকুতি-আইসিইউর ভেতরে যাবে। বোনের সঙ্গে খেলা করবে। ঘুমাবে। পরিবারের সবাই উৎকণ্ঠায়। তায়েবার পরিবারের মতো অন্য পরিবারগুলোও অশ্রুসিক্ত। একটা ভালো খবরের প্রত্যাশা সবার। আইসিইউর গেট দিয়ে ৬ দিনে ১৭ জনের লাশ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ১৩ জন।
রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ জনে। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৪৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মারা যাওয়াদের মধ্যে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১৭ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ১৪ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন, লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে একজন (অজ্ঞাতনামা) এবং ইউনাইটেড হাসপাতালে একজন মারা যান। শনিবার ৩৫ জনের মৃত্যুর খবর বলা হয়েছিল। ডিএনএ পরীক্ষার ভিত্তিতে আগের ৩৫ জন থেকে মৃতের সংখ্যা হালনাগাদ করে ৩৪ জনে দাঁড়াল।
এদিকে সিএমএইচ সূত্র জানায়, ২১ জুলাই দুর্ঘটনার পর মর্চুয়ারিতে ১৫টি বডিব্যাগ গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিকভাবে তুরাগ থানা পুলিশ এগুলোর সুরতহাল প্রতিবেদনে ১১টি সম্পূর্ণ লাশ, দুটি অপূর্ণাঙ্গ লাশ এবং পাঁচটি বিচ্ছিন্ন দেহাংশ শনাক্ত করে। এর মধ্যে নয়টি লাশ স্বজনরা তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করতে পারায় আটটি ২১ জুলাই এবং একটি ২২ জুলাই হস্তান্তর করা হয়। অবশিষ্ট দুটি লাশ, দুটি অপূর্ণাঙ্গ লাশ ও পাঁচটি দেহাংশ নিয়ে শুরু হয় ফরেনসিক বিশ্লেষণ। ২২ জুলাই সিআইডির ফরেনসিক টিম ঘটনাস্থল ও সিএমএইচ থেকে ১৪টি নমুনা সংগ্রহ করে এবং পরিবারের পক্ষ থেকে নেয় ১১টি রেফারেন্স নমুনা। বিশ্লেষণ শেষে জানা যায়, যে বডিব্যাগটিতে পাঁচটি বিচ্ছিন্ন দেহাংশ ছিল, সেগুলো দুজন শিক্ষার্থী লামিয়া আক্তার সোনিয়া ও আফসানা আক্তার প্রিয়ার দেহের অংশবিশেষ। ফলে সেগুলো পৃথক পাঁচজন নয়, বরং দুটি লাশ হিসাবেই গণ্য হয়।
এই ফলাফলের ভিত্তিতে সিএমএইচে সংরক্ষিত লাশের প্রকৃত সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচটি। এদের সঙ্গে আগেই হস্তান্তর হওয়া নয়টি লাশ মিলিয়ে চূড়ান্ত সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪, যা রোববার হালনাগাদ তালিকায় প্রতিফলিত হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক চিঠির মাধ্যমে এই সংশোধিত তথ্য নিশ্চিত করে।
সর্বশেষ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১১২ জন ভুক্তভোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৭৮ জন আহত হয়ে ভর্তি ছিল এবং ৩৪ জন মারা গেছে।
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হয়ে ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিলেন ৫২ জন। রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছে ৩৪ জন রোগী, যাদের মধ্যে ২৮ জন শিশু এবং ৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক। ৪ জন চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। রোববার ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারও মৃত্যু হয়নি। এ দিন আরও ২ জন ছাড়া পেয়ে বাসায় ফিরে গেছেন। এর আগে শনিবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান ২ জন। সব মিলিয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে ৪ জন সংকটাপন্ন (ক্রিটিক্যাল) এবং ৯ জন গুরুতর (সিভিয়ার) অবস্থায় রয়েছেন। ইনহেলেশন ইনজুরিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭ জন এবং শরীরের ৩০ শতাংশ বা এর বেশি পুড়ে যাওয়া রোগীর সংখ্যা ৬ জন।
বার্ন ইনস্টিটিউটে চোখ রাখলে মৃত্যু আর হাহাকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। রোববার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ইনস্টিটিউটটির আইসিইউ, এইচডিইউ এবং পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ড মানে স্বজনদের আর্তচিৎকার। আইসিইউতে ভর্তি রয়েছে শিশু নাবিদ নেওয়াজ, শেয়েল ফারাবি আয়ান, আব্দুর রাহিম ও তাসনীয়া। তাসনীয়ার বাবা নাজমুল হক জানান, একেক করে আইসিইউ থেকে ১৭ জনের লাশ বের হলো। আমার মেয়ে এখনো বেঁচে আছে। তার সঙ্গে রাখা ১৭ জনের প্রাণ চলে গেল। মেয়ের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। আল্লাহ যেন আমার মেয়েকে প্রাণভিক্ষা দেন।
১৪ বছর বয়সি বোন তাসনীয়া সোমবার থেকেই ওই আইসিইউতে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।
সে জানে না ওখানে শিশুদের যাওয়া নিষেধ। মা তাহমিনা দুই হাত তুলে মোনাজাত করছিলেন। পাশে থাকা শাশুড়ি সুরাইয়া বেগম তসবিহ পড়ছেন। আর ছোট্ট তায়েবা বারবার আইসিইউর গেটে গিয়ে চিৎকার করছিল গেট খুলে দিতে। বারবার চিৎকার করে বলছিল তার বোনের কাছে নিয়ে যেতে। বোনকে দেখতে ব্যাকুল হয়ে আছে সে। বাবা নাজমুলের ভাষ্য, ৭ দিন ধরেই তার ছোট্ট কন্যা তায়েবা এখানে আছে। তাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না। আইসিইউতে শিশুদের যাওয়া নিষেধ। সারাক্ষণ কান্না করছে। তারা থাকেন উত্তরায়। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর।
আইসিইউর সামনে টানা বিলাপ করছিলেন শিশু নাবিলের বাবা বিল্পব, মা মিতুসহ স্বজনরা। তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। নাবিলের চাচাতো ভাই সাইদুল জানান, একমাত্র ছেলের জন্য বাবা-মা, স্বজনরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। দেশবাসীর কাছে নাবিলের জন্য দোয়া চান। সাইদুল জানান, দুর্ঘটনার সময় নাবিল নিচে একা বের না হয়ে বন্ধুদের বের করছিল। একসময় সে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায়। যখন তাকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল, ওই সময়ও বন্ধুদের খবর নিচ্ছিল সে। পুড়ে যাওয়া বন্ধুদের কীভাবে বাঁচানো যায় বারবার সে অনুরোধ করছিল নাবিল।
রোববার বিকালে ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাসির উদ্দিন জানান, বর্তমানে ভর্তি থাকা ৩৪ জন রোগীর মধ্যে চারজন রয়েছেন আইসিইউতে। তাদের মধ্যে দুজন লাইফ সাপোর্টে (ভেন্টিলেটর)। এরা হলো-১৪ বছর বয়সি আয়ান, যার শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে এবং ইনহেলেশন ইনজুরিও রয়েছে। আরেকজন নাবিদ নেওয়াজ যার ৫৩ শতাংশ দগ্ধ ও ইনহেলেশন ইনজুরিতে আক্রান্ত। এছাড়াও মেডিকেল এইচডিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছে ৩ জন, ফিমেল এইচডিইউতে ৬ জন, পোস্ট-অপারেটিভ ওয়ার্ডে ৮ জন এবং কেবিনে আছে ১২ জন। ছাড়প্রাপ্তদের একজন উদ্ধারকারী কাজী আমজাদ সাইদ, যিনি দুর্ঘটনার সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধারকাজে অংশ নেন। অপরজন সবুজা আক্তার, যিনি ছিলেন মাইলস্টোন স্কুলের একজন নারী কর্মী (আয়া)।
রোববার নতুন করে আইসিইউতে কাউকে ভর্তি করা হয়নি। তবে চারজন রোগীর অবস্থা গুরুতর থেকে সংকটাপন্ন পর্যায়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এদের মধ্যে আছেন ১৫ বছর বয়সি তাসনিয়া, যিনি ৩৫ শতাংশ বার্ন ও ইনহেলেশন ইনজুরিতে আক্রান্ত; ১০ বছর বয়সি আবিদুর রহিম, যিনি ২২ শতাংশ বার্নে আক্রান্ত; আগে থেকেই আইসিইউতে থাকা নাবিদ নেওয়াজ এবং সেহেল ফারাবি আয়ানের শরীর ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে। রোববার হাসপাতাল চত্বরে সাধারণ মানুষের ভিড় লেগে ছিল। অনেকেই এসেছেন রক্ত দিতে। স্বজন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। মৃত্যু আর ঝলসে যাওয়ার দৃশ্যপটে ভেসে উঠছে তাদের চোখে-মুখে। হাসপাতালের ভেতরে থাকা স্বজনরা উৎকণ্ঠায়।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি অধিকাংশ রোগীই শিশু, যাদের শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক পুনর্বাসনের প্রয়োজন রয়েছে। চিকিৎসকদের মতে, এই রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি পরিচর্যা, সেলাই, স্কিন গ্রাফটিং, ইনফেকশন প্রতিরোধ ও ফিজিওথেরাপিসহ নানা চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন। ফলে ৪ জনের ছাড়পত্র সাময়িক স্বস্তি দিলেও তারা সুস্থ হয়ে কবে ফিরবেন, সামনে এখনো লম্বা ও কঠিন চিকিৎসা প্রক্রিয়া অপেক্ষা করছে। রোগীর অবস্থা সংকটজনক হলে ইনটেনসিভ কেয়ারে সবরকমের সাপোর্ট দিয়ে রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাই আইসিইউ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। কিন্তু পোড়া রোগীর ক্ষেত্রে আইসিইউতে যাওয়া রোগীদের প্রায় ৯৫ শতাংশ বাঁচানো সম্ভব হয় না।