
রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সমাবেশে নির্বাচন নিয়ে বিশেষ বার্তা দিতে চায় জামায়াতে ইসলামী। একইসঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে নিজেদের শক্তির জানানও দিতে চায় তারা। আজ সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানকে জনসমুদ্রে পরিণত করে এমন বার্তা দেয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে তারা। এজন্য দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে চলছে সাজসাজ রব। সারা দেশ থেকে সড়ক নৌ এবং রেলপথে নেতাকর্মীদের আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে নেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। আসন্ন নির্বাচন এবং সংস্কার বিচারসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলমান মতবিরোধ ও বিতর্কের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জামায়াতের এই জাতীয় সমাবেশ।
এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানামুখী আলোচনা ও কৌতূহল। ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের এ সমাবেশে সভাপতিত্ব করবেন জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান। সংশ্লিষ্টরা জানান, মহাসমাবেশে দলের সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শনের পাশাপাশি সংস্কার বিচার এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতের জোরালো দাবি উত্থাপন করা হবে। তন্মধ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতের বিষয়টি প্রধান দাবি হিসাবে উত্থাপিত হবে। এটা নিশ্চিত না হলে জামায়াত নির্বাচনে যাবে না এবং দেশে সুষ্ঠু কোনো নির্বাচন হবে না মর্মে ঘোষণা আসতে পারে। ইতিমধ্যে দলের দায়িত্বশীল সূত্রে এমন তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
সূত্রের দাবি, ফ্যাসিবাদের পতন হলেও গত ১১ মাসে দেশে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি। জামায়াতের শীর্ষ থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মী সমর্থকরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন এ কথা। গত ৪ঠা জুলাই জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান রংপুরে এবং ৫ই জুলাই কুমিল্লায় পৃথক সমাবেশে দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই বলে দাবি করেন। লালমনিরহাটের একটি থানায় হামলা চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেয়া এবং কুমিল্লায় একটি আলোচিত ধর্ষণ ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি ওইসব এলাকা সফরে যান। এরপর থেকেই নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে আসে। এ ব্যাপারে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ মানবজমিনকে বলেন, সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে নাজুক অবস্থা তাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই। তিনি বলেন, আমাদের দাবি আগে নির্বাচনের কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ বিশেষ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। প্রায় একই সুরে কথা বললেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। তিনি বলেন, একটি দল এখনই যেভাবে মাঠে ময়দানে প্রভাব বিস্তার করে প্রশাসনকে ব্যবহারের চেষ্টা করছে তাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে আমরা বেশ সন্দিহান। অতএব আসন্ন নির্বাচনের আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কোনো বিকল্প নেই। এটা নিশ্চিত না হলে জামায়াত নির্বাচনে যাবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, ৫ই আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজধানীতে এটাই তাদের বড় আকারের সমাবেশ। বিগত ১১ মাসে সারা দেশে জামায়াতের অনেক সভা-সমাবেশ হয়েছে। তবে রাজধানীতে তেমন বড় কোনো সমাবেশ হয়নি। ফলে চলো চলো ঢাকা চলো স্লোগানে সারা দেশে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলের সব জেলা-উপজেলা শাখাও এই প্রচার কাজে যুক্ত হয়েছে। গত ২৮শে জুন সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে চরমোনাই পীরের সংগঠন ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশের পর জামায়াতে ইসলামীর এই জাতীয় সমাবেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ সমমনা ১০ সংগঠনের প্রথম সারির নেতারা অংশ নিলেও বিএনপি’র কোনো নেতাকে দেখা যায়নি। এ পর্যায়ে আজকের জাতীয় সমাবেশে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে, দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের জানিয়েছেন, সমাবেশ সফল করতে এরইমধ্যে লঞ্চ ও ট্রেন বাদ দিয়ে শুধু ১০ হাজার বাস ভাড়া করা হয়েছে। তিনি আশা করছেন ১০ লক্ষাধিক নেতাকর্মীর সমাগম ঘটবে এবং এর জন্য শুধু ছয় হাজার স্বেচ্ছাসেবক সার্বিক শৃঙ্খলা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত থাকবে। এ ছাড়া রাজশাহী সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের নেতাকর্মীদের জন্য ১২টি ট্রেন ভাড়া করা হয়েছে।
জামায়াতের জাতীয় সমাবেশকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় রাখতে ছয় হাজার স্বেচ্ছাসেবক, সমাবেশস্থলে ১৫টি মেডিকেল বুথ ও বিভিন্ন জেলা থেকে আসা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ১৫টি স্পট নির্ধারণের কথা জানান দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি বলেন, সমাবেশ বাস্তবায়নে জামায়াত আটটি উপ-কমিটি গঠন করেছে।
অপরদিকে, জাতীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে সম্ভাব্য যানজট ও জনদুর্ভোগের জন্য আগাম দুঃখ প্রকাশ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি জানান, লাখ লাখ মানুষ রাজধানীতে প্রবেশ করবেন, যার ফলে সাময়িক দুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে। তবে সেই দুর্ভোগ যেন যতটা সম্ভব সীমিত রাখা যায়, সেজন্য দলের পক্ষ থেকে নানা প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
শুক্রবার বিকালে রাজধানীর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি। মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমি সবার কাছে বিশেষ করে রাজধানীবাসীর কাছে সহযোগিতা চাই। আমরা দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই যেন আমাদের সমাবেশটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারি। লাখ লাখ মানুষ রাজধানীতে প্রবেশ করার কারণে হয়তো যানজট হবে, ফলে জনদুর্ভোগ তৈরি হতে পারে। এজন্য আমাদের আমীরে জামায়াতের পক্ষ থেকে রাজধানীবাসীসহ দেশবাসীর কাছে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সমাবেশ সফল করার জন্য দলের পক্ষ থেকে নানা প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল এই ময়দানে আমাদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এখন বর্ষাকাল, তাই আবহাওয়ার বিষয়টিও মাথায় রেখে প্রস্তুতি সাজানো হচ্ছে।
সমাবেশ নির্বিঘ্ন করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে বলেও জানান জামায়াতের এ নেতা। মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, ডিএমপি কমিশনার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, সাধ্য অনুযায়ী প্রশাসনিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা দেবেন।
ঢাকার বাইরের সমর্থকদের আগমনের বিষয়টিও দলটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। তিনি বলেন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে আমাদের নেতারা একাধিকবার বৈঠক করেছেন। ঢাকার বাইরে থেকে আগত বাসগুলো কোন কোন স্থানে থামবে সে বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, স্থল, নৌ, সড়ক ও রেলপথে মানুষ শুক্রবার রাত থেকেই ঢাকায় প্রবেশ শুরু করবে। আমরা চাই, কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন এবং একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে যেন আমাদের জাতীয় সমাবেশটি সম্পন্ন হয়।