
রাজধানী ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার পাশাপাশি বিএনপি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে ইসলামপন্থী কিছু দল ও জুলাই আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এমনকি বিএনপির একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসাবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীও বিএনপির বিরুদ্ধে সমালোচনার মাঠে রয়েছে।
এসব সমালোচনার অনেকটাই করা হচ্ছে বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানকে কেন্দ্র করে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনীতিতে বিএনপি অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। তারা বলছেন, চাঁদাবাজি, খুন, দখলের মতো কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ অব্যাহত ছিল। কিন্তু সম্প্রতি নানা বিতর্কিত বা অপরাধমূলক ঘটনায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের নাম আসায় দলটি বড় ধরনের ভাবমূর্তি সংকট তৈরি হয়েছে।
এরই মধ্যে মিটফোর্ড এলাকার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিএনপি বেকায়দায় পড়েছে; প্রশ্নের মুখে পড়েছেন তারেক রহমান। যদিও বিএনপির নেতারা পাল্টা অভিযোগ করে বলেছেন, 'পরিকল্পিতভাবে তাদের দল ও তারেক রহমানের চরিত্র হননের অপচেষ্টা' চালানো হচ্ছে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এদিকে শুক্রবার ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরই রাতেই বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজির অভিযোগ করে বিএনপি ও তারেক রহমানের সমালোচনা করে মিছিলের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উভয় পক্ষ ব্যাপক প্রচার-পাল্টা প্রচারে জড়িয়ে পড়েছেন।
বিএনপি নেতারা দলটির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এসব প্রচারণার জন্য কোনো দলের নাম উল্লেখ না করলেও তাদের কর্মী সমর্থকরা জামায়াত-শিবির ও এনসিপিকে দায়ী করছেন। এমনকি দলটির সহযোগী সংগঠনগুলোর মিছিল সমাবেশ থেকে সরাসরি জামায়াত-শিবির ও এনসিপিকে নিয়ে শ্লোগান দেয়া হয়েছে আজ সোমবারও।
যদিও জামায়াতে ইসলামী বলেছে, এ ধরনের তৎপরতা তাদের দলের কেউ করছে না। আর এনসিপি বলছে তারেক রহমান যেহেতু বিএনপির একক নেতা, সে কারণে দলের কর্মীদের কর্মকাণ্ডের দায় তাকেই নিতে হবে।
বিশ্লেষকরা কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপির সাথে অন্য দলগুলোকে মুখোমুখি করার একটি চেষ্টা অন্য কোনো মহল থেকেও থাকতে পারে। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের জন্য এমন পরিস্থিতি তৈরির উদাহরণ বাংলাদেশে আছে।
প্রসঙ্গত, বুধবারের ওই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিকে ব্যবসায়ী ও যুবদল কর্মী আখ্যায়িত করে এ ঘটনা জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় পাঁচ জনকে বহিষ্কার করেছে বিএনপির সহযোগী সংগঠনগুলো। এর আগে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই সারাদেশে চাঁদাবাজি, দখল ও সন্ত্রাসের বিভিন্ন অভিযোগ বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আসতে থাকে।
দলটি নিজেও অপরাধমূলক ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে অন্তত ৪ হাজার নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বলে জানিয়েছে। যদিও দলটির নেতা তারেক রহমান শনিবার ছাত্রদলের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার সময় 'সরকারই অন্যায়কারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে কি না', সেই প্রশ্ন তুলেছেন।
হত্যাকাণ্ডের জেরে ঘটনাপ্রবাহ
গত কয়েক মাস ধরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা অপরাধমূলক ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের নাম জড়ানোর পর বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা শোনা যাচ্ছিলো।
যদিও দলটির নেতারা অনেক ঘটনায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তারপরেও দলটি কেন তার কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে এসেছে।
সবশেষ মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের ভিডিও শুক্রবার সন্ধ্যা নাগাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর রাতেই বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের কয়েকটি জায়গায় কোথায় 'ছাত্র-জনতা' আবার কোথাও 'সাধারণ শিক্ষার্থী' পরিচয় দিয়ে প্রতিবাদ মিছিল বের হয়।
কিন্তু এসব মিছিল থেকে এক পর্যায়ে বিএনপির লন্ডনে থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে স্লোগানও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয় বিএনপিতে। তারেক রহমানকে নিয়ে 'কুরুচিপূর্ণ' স্লোগান দেয়া হয়েছে বলে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন দলটির নেতারা।
এসব মিছিলের যেসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে সেখানে 'আগের জুলাইয়ে লীগ তাড়াইছি...এবারে দল তাড়াবো', 'হাসিনা গেছে যে পথে, খালেদা যাবে সেই পথে', 'ঢাকা না লন্ডন.. ঢাকা ঢাকা' এবং 'চাঁদা তোলে পল্টনে... ভাগ যায় লন্ডনে'- এমন সব শ্লোগান শোনা গেছে।
এছাড়া নামে-বেনামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফটোকার্ড দিয়ে লন্ডনে থাকা তারেক রহমানের 'জীবনযাত্রার ব্যয় এবং আয়ের উৎস নিয়েও' নানা ধরনের প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
বিএনপির কর্মীরাও তাদের ভাষায় এসব অপপ্রচারের জন্য জামায়াত ও এনসিপিকে দায়ী বা ইঙ্গিত করে পাল্টা প্রচারণা শুরু করে।
আবার বিএনপির সহযোগী সংগঠনগুলোও এর বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে জামায়াত-শিবিরকে ইঙ্গিত করে 'গোপন তৎপরতায় অভ্যস্ত একটি গুপ্ত সংগঠন কর্তৃক মব সৃষ্টির অপচেষ্টা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিনষ্ট করা এবং সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির' অভিযোগ এনেছে।
এসব প্রচার পাল্টা প্রচারে দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি কিংবা অর্থ আদায়ের জন্য নানা কৌশল অবলম্বনের প্রচার- পাল্টা প্রচার করছেন যেখানে, 'চাঁদাবাজি, ডোনেশন, বাইতুল মাল, হাদিয়া কিংবা বিকাশ' এমন শব্দগুলো তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করছেন।
আবার জামায়াত গত কয়েকমাস ধরেই দেশজুড়ে চাঁদাবাজির জন্য বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে আসছিলো। সেটিই গত কয়েকদিনে আরও জোরালো হতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
যদিও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তাদের দলের কেউ অন্য কোনো দল বা দলের নেতাকে নিয়ে অশ্লীল কোনো শ্লোগান বা বক্তব্য দেয়নি।
"আমরা শুধু দেশজুড়ে চাঁদাবাজি, নিষ্ঠুরতাসহ যেসব অপকর্ম হচ্ছে তার প্রতিবাদ করছি রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে। মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছে একটি গোষ্ঠীর তৎপরতায়। মানুষের কথাটাই আমরা বলছি শুধু," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
এর আগে রবিবারই এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, "তাদের ওপর 'সাইবার অ্যাটাক হয়েছে চতুর্দিক থেকে।...পরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য, বিএনপিকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য"।
এরপর দুপক্ষের মধ্যেই প্রচার-পাল্টা প্রচারে বার বার উঠে আসে তারেক রহমানের নাম।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ সোমবার মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন 'একটি চিহ্নিত মহল পরিকল্পিতভাবে আমাদের দল এবং শীর্ষ নেতৃত্বের শালীনতা ও চরিত্রহননের দুঃসাহস প্রদর্শন করছে'।
তার অভিযোগ, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যই মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হচ্ছে।
মির্জা ফখরুল আলমগীর মুখে কোনো দলের নাম উচ্চারণ না করলেও তার দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর কর্মসূচিতে 'তারেক রহমান বিরোধী প্রচারের জন্য' জামায়াত-শিবির ও এনসিপিকে দায়ী করেই বক্তব্য দিয়েছেন এসব সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরোয়ার বিবিসি বাংলার সাথে আলাপকালে এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তবে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলছেন, বিএনপি আগের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় তারেক রহমানকে রাজনৈতিক কাল্ট হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে।
‘‘একটা দলের ভালো কাজের ক্রেডিট যখন দলের অন্যান্য নেতাদের না দিয়ে শুধু তাকে দেওয়া হয়, তখন দলের খারাপ কাজ বা অন্যায়ের দায়ও তার উপর যায়। তার দলের কেউ কোনো অন্যায় করলে জনগণ তার সমালোচনা করছে বা তাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছে-গণতন্ত্রে এটা তো স্বাভাবিক।’’
বিএনপি মহাসচিব সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে তার দল সরকার পরিচালনার দায়িত্বে না থাকা সত্ত্বেও দল ও তার প্রধান নেতৃত্বকে দায়ী করে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন করেছেন।
জবাবে আরিফুল ইসলাম আদীব বলছেন, ৫ অগাস্টের পর গণমাধ্যম থেকে শুরু করে রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য এস্টাবলিশমেন্টে বিএনপি পরোক্ষভাবে সবকিছুতেই নিয়ন্ত্রণ বা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে।
তারেক রহমানকে মিছিল সমাবেশের বিষয়ে এনসিপির এই মুখপাত্র বলেন, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কর্মসূচিসহ সবকিছুতেই দেখবেন উনি (তারেক রহমান) সবকিছুর ঊর্ধ্বে। গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে জনগণ ও শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করা শিখে গিয়েছে। সুতরাং, তার দলের লোকজনের কর্মকাণ্ডের দায় সেজন্য শিক্ষার্থী বা জনগণ এখন প্রশ্ন তুলছে।
তার মতে, কোনো ব্যক্তিরই এখন আর প্রশ্ন আর জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকার সুযোগ নেই। এর আগে শনিবার দলের এক অনুষ্ঠানে ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেছেন, রাজধানীতে পাথর ছুড়ে প্রকাশ্যে যুবক হত্যার দায়-দায়িত্ব বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেই নিতে হবে।
বিএনপি কতটা বেকায়দায়?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলছেন, মিটফোর্ডের ঘটনার পর বিএনপি বিরোধী একটি ক্যাম্পেইন চলছে এবং এতে রাজনৈতিক সংকীর্ণতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে বলে মনে করেন তিনি।
‘‘তবে এর কোনো পক্ষের সাথে যদি বাইরের ইন্ধন থাকে এবং সেটি যদি বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের পরিকল্পনা থেকে হয়, তাহলে তা দেশকে অস্থিতিশীল করবে’’।
রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে নজর রাখেন এমন অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের মত দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, অপরাধমূলক ঘটনাগুলোর সুযোগ নিয়ে বিএনপিকে কোণঠাসা করাই কারও কারও লক্ষ্য হতে পারে বলে তারা মনে করেন।
মাহবুব উল্লাহ বলছেন, রাজনৈতিক সুবিধার জন্য এগুলো করা হলেও এসব কাজ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়াবে বা অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে। বিএনপিকে কোণঠাসা করার জন্য এটি হতে পারে, যাতে দলটি আত্মরক্ষামূলক অবস্থায় যায়। এটা সফল হলে বিএনপির সমালোচকরা ফায়দা বেশি পাবে যা তারা স্বাভাবিক অবস্থায় পারবে না।
কিন্তু তারা কারা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সবাই সেটি জানে। তবে এটি কোনো রাষ্ট্রীয় সংস্থা হলে তা দেশের জন্য ভালো হবে না। তাই এগুলো না করে দেশকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেয়া উচিত।
আরেকজন বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, কিছু বিষয়ে বিএনপি কিছুটা 'আইসোলেটেড' হয়ে পড়েছে কিন্তু এটি আসলে নির্বাচনি রাজনীতি। আবার ভোটের মাঠে যারা সুবিধা করতে পারবেন না তারা অনেক সময় এগুলো করে। কিছু ক্ষেত্রে গোয়েন্দারাও এগুলো করায় মাঠ ঘোলা করার জন্য।