
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) জন্য বরাদ্দ চার হাজার ৭০০ কোটি টাকার ভর্তুকি আটকে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরের লোকসান পূরণে এই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। তবে অর্থ বিভাগ সম্প্রতি বিপিডিবিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে, এই অর্থ আর দেওয়া হবে না।
অর্থ বিভাগ বলছে, করোনা-পরবর্তী সময়ে বিপিডিবি তাদের বরাদ্দ পাওয়া পুরো অর্থ ব্যয় করেনি। অব্যবহৃত অর্থ সরকারি কোষাগারে উদ্বৃত্ত হিসেবে জমা দেওয়া হয়েছে, যা প্রচলিত বিধি অনুযায়ী বৈধ।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, বিপিডিবি ভুল করেছে। প্রতিষ্ঠানটি দেশের জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) নির্ধারিত কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে গিয়ে গত কয়েক বছরে ৮৫ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকার বেশি লোকসানে পড়েছে। এর পরও বরাদ্দ পাওয়া পুরো অর্থ ব্যবহার করতে পারেনি তারা।
এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় অর্থ বিভাগকে চিঠি দিয়ে দ্রুত আটকে থাকা অর্থ ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, বিপিডিবি বর্তমানে চরম আর্থিক সংকটে রয়েছে। প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানটিকে প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং বকেয়া পরিশোধের জন্য এ অর্থ জরুরি।
তবে অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, সংবিধানের ৯০(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোষাগারে জমা দেওয়া অর্থ ফেরত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর জন্য নতুন আইন পাস এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রয়োজন।
বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা অর্থ বিভাগের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, শেষ পর্যন্ত এ অর্থ পাওয়া যাবে।’
বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ১২ টাকা ১৫ পয়সা হলেও পাইকারি মূল্য ৭ টাকা ৪ পয়সা।
ভর্তুকি কমাতে রোডম্যাপ
বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়েই আগামী তিন অর্থবছরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি কমাতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে।
রোডম্যাপ অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ৬২ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এই মুহূর্তে সরকারের নেই।
বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয়মূল্যের ফারাক কমানোর মাধ্যমে ভর্তুকি হ্রাসের চেষ্টা চলছে। এর জন্য অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার সংস্কার, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি পর্যালোচনা এবং খাতভিত্তিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের কথা ভাবা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতে ভুল নীতি আর নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দিনে দিনে ব্যয় বেড়েছে এবং এখনো বাড়ছে। অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনাগত দুর্বলতার কারণে এ খাতে ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বর্তমানে বসিয়ে রাখা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য সরকারকে বছরে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়ে আসছে। সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি বিভাগ, বিপিডিবিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আইএমএফের শর্ত মানতে গেলে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করতে হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দাম না বাড়িয়ে বিকল্প উপায়ে ভর্তুকি সমন্বয়ের চেষ্টা করছে। বিদ্যুতের দাম যদি বাড়াতেই হয় তাহলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লোকসান কমাতে হলে ভর্তুকি কমাতেই হবে। দাম না বাড়িয়ে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন এবং খাতভিত্তিক সংস্কারের মাধ্যমে ভর্তুকি কমানোর সুযোগ রয়েছে। আমরা সেই পথেই এগোচ্ছি।’