
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার বিষয়টি এবারও সিন্ডিকেটের চক্করে পড়েছে। দরপত্রের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট করে কয়েকজন মুদ্রণকারী সক্ষমতার বাইরে কাজ নিয়েছে। এতে ডিসেম্বরের মধ্যে বই ছাপা শেষ করা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একই সমস্যার কারণে চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই পৌঁছাতে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আওয়ামী সিন্ডিডেট। নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক ডাক ও টেলিযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ছোট ভাই আনন্দ প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী মো. রাব্বানি জব্বার। তিনি মুদ্রণ সমিতিরও সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান। যদিও গত রবিবার ওই সমিতি ভেঙে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, নতুন শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকে প্রায় ৯ কোটি ও মাধ্যমিকে প্রায় ২১ কোটি বই ছাপা হবে। এ জন্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা থাকাটা মূল ব্যাপার। আমাদের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাই করে। আমাদের নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার অনুযায়ী কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমরা বইয়ের কাজ শেষ করতে পারব।’
জানা যায়, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ছোট ভাই রাব্বানি জব্বার সরাসরি আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি ২০২১ সালে নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির চেয়ারম্যানের পদও অনেকটা জোর করে দখলে নিয়েছেন। গত ১৫ বছর এনসিটিবির বই ছাপায় একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ছিল তাঁর।
বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে রাব্বানি জব্বারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
এদিকে সদস্যদের দীর্ঘদিনের চাওয়া ও নানা আইনি তৎপরতার পর অবশেষে বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতিতে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। গত রবিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একজন উপসচিবকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পতিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসরদের সিন্ডিকেট ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত হলেও এনসিটিবির আগামী শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার কাজ তাদের হাতেই রয়ে গেছে।
মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটি বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত; সেহেতু বাণিজ্য সংগঠন আইন ২০২২-এর ১৭ ধারা মোতাবেক সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদ বাতিলপূর্বক সরকারের অনুমোদনক্রমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সন্দ্বীপ কুমার সরকারকে বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করা হলো। তিনি ১২০ দিনের মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে ও দায়িত্ব হস্তান্তর করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবেন।
বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রক ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগের সরকারের সময় যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে, এখনো তারাই কাজ পাচ্ছে। আবার নিম্নমানের বই দিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠানকে কোনো শাস্তি পেতে হয়নি। তারা কোনো না কোনোভাবে পার পেয়ে গেছে। অর্থাৎ এখনো আগের সিন্ডিকেট বহাল আছে। তারা গত ১৫ বছর কাজ করেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষেও করেছে, আগামী শিক্ষাবর্ষেও কাজ পাচ্ছে।’
জানা যায়, চলতি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপায় ৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বহিষ্কৃত নেতা গাজী সালাউদ্দিন আহমেদ তানভীরসহ ৩৬ প্রেস মালিকের বিষয়ে এনসিটিবির কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য নেওয়া হয়েছে।
এনসিটিবির একটি সূত্র বলছে, গত ২৪ জুন এনসিটিবিকে চিঠি দেয় দুদক। চিঠিতে বই ছাপায় নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার, দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, অতিরিক্ত বই ছাপিয়ে অর্থ আত্মসাৎ এবং শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির নামে ৩৩ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে দুদক। তারা অনুসন্ধানের জন্য ছয় ধরনের তথ্য চেয়ে এনসিটিবিকে চিঠি দিয়েছে।
চিঠিতে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে দরপত্রের কার্যাদেশ, চুক্তিপত্র, বই গ্রহণ, প্রিন্টার্সদের সঙ্গে চুক্তির পরও তৃতীয় কোনো পক্ষের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে কি না এসংক্রান্ত রেকর্ডপত্র, মুদ্রণকারীদের বিল পরিশোধ, আমদানি করা মুদ্রণ কাগজের পোর্ট ড্যামারেজ, নিম্নমানের পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ এবং ৩৬টি প্রেস মালিকের গত ১০ বছরের কাজের বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে। এর মধ্যে এনসিটিবি এসব তথ্য দুদকে পাঠিয়েছে।