
এসব দাবির আড়ালে তারা নির্বাচনকে প্রলম্বিত করতে চাইছে, নাকি বিএনপির বিপক্ষে একটি জোট গড়ে তোলার প্রক্রিয়া জোরদার করছে- সেই আলোচনাও আছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
আমরা নির্বাচন পেছানো, না করা -এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য কখনো রাখি নাই। আমরা নির্বাচন নিরপেক্ষ চাই, বিচার চাই, সংস্কার চাই, আমরা স্থানীয় সরকার আগে চাই, আনুপাতিক নির্বাচন চাই, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চাই’।
সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার
আগামী ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময় হতে পারে বলে এর মধ্যেই সরকার ও বিএনপি একমত হয়েছে। শুধু বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে এ ধরনের ঘোষণা আসার পরপরই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল।
প্রসঙ্গত, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর তাদের যৌথ ঘোষণায় ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে বলে বলা হয়েছিল।
জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামি দলগুলোর নেতারা বলেন, ‘মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে- এমন পরিবেশ নেই’। তাদের মতে, ‘পুলিশ ও প্রশাসন এখন বিএনপির নিয়ন্ত্রণে’।
জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘এটি শুধু আমাদের কথা নয়, এটি দেশের মানুষের কথা বলে আমরা মনে করি’।
ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘লন্ডন বৈঠকের পর থেকেই মনে হচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায়। এ অবস্থায় নির্বাচন কিভাবে হবে’।
আরেকটি ইসলামি দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মুখপাত্র ও যুগ্ম মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসনের যে অবস্থা তাতে মানুষ ভোট দিবে কীভাবে। এ অবস্থায় মানুষ চাইছে ইসলামপন্থিরা এক হোক। সেই চেষ্টাই করছি আমরা’।
যদিও এই নেতারা দাবি করছেন, তারা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন কিংবা পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্য জন্য নয়, বরং তারা মনে করেন আগের পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তাতে সত্যিকার অর্থে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে না।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দৈনিক নয়া দিগন্তের সম্পাদক সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর বলছেন, পিআর নিয়ে জামায়াত কতটা সিরিয়াস সেটি পরিষ্কার নয়, কিন্তু দেশজুড়ে একটি দলের কর্তৃত্ব দৃশ্যমান থাকায় নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে, তা নিয়ে জামায়াতসহ ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে উদ্বেগ আছে বলে মনে করেন তিনি।
আসলে কী চাইছে দলগুলো
গত বছরের ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই এক সময়ের মিত্র জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় বিএনপির। এরপর রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিকে সামনে রেখে ধর্মভিত্তিক অন্য দলগুলোকে কাছে টানার উদ্যোগ নেয় জামায়াতে ইসলামী।
দলটি কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো পর্দার অন্তরালে দফায় দফায় আলোচনা ও বৈঠক করেছে ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসসহ আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে।
এর মধ্যেই সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে–– এই প্রশ্নে বিরোধ আরও বাড়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। এ সময় উভয় পক্ষের পালটাপালটি বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে আলোচনার বিষয় হয়েছে বারবার।
আবার ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে কাছে টানা নিয়েও দল দুটির মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখা গেছে চলতি বছরের শুরুর দিকে।
অনেকগুলো ধর্মভিত্তিক দল বিএনপির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চললেও কয়েকটি দল আবার ইঙ্গিত দিচ্ছে যে – আগামী নির্বাচনে ‘ইসলামপন্থি ভোট’ এক জায়গায় রাখার জন্য নিজেদের মধ্যে ঐক্যের দিকে এগিয়ে গেছে তারা।
কিন্তু সবশেষ সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপি নেতা তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টার মধ্যকার বৈঠকের পর জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলো ‘নির্বাচনের পরিবেশ নেই’ এবং সংখ্যানুপাতিক বা পিআর নির্বাচন পদ্ধতির দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে।
এ দলগুলোর এমন তৎপরতার প্রতিক্রিয়ায় বক্তব্য এসেছে বিএনপির দিক থেকেও। গত ১৮ জুন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ভোট হলে যাদের আর গুরুত্ব থাকবে না, তারাই এখন ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের ঘোষণায় নাখোশ হয়েছে।
পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য কতটা উপযোগী সেটা ভেবে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই।
তবে ইসলামি দলগুলো বলছে, তারা এখন পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে আরও সোচ্চার হয়ে ওঠবে এবং একই সঙ্গে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর একটি জোট গঠন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
গত ২৮ জুন এ দাবিতে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করেছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন। সেই সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন জামায়াতের নেতারাও। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও ওই সমাবেশে গেলেও সেখানে বিএনপির কাউকে দেখা যায়নি।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতেই আগামী ১৯ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছে জামায়াতে ইসলামীও।
দলটির মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘ইসলামপন্থি’ সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হওয়ার জন্যই তার দল এখন কাজ করছে। একই সঙ্গে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ থেকেই তারা বিষয়টি তুলে ধরছে।
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম বিএনপি কর্মীদের থানায় হামলা করে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আকন্দ বলেন, থানা থেকে আসামিকে ছিনিয়ে আনা শুধু নয়, এমন অনেক ঘটনা ঘটছে। তাহলে সাধারণ মানুষ ভোট দিতে যাবে কিভাবে। এটিই শুধু জামায়াত নয়, দেশের মানুষের প্রশ্ন।
কিন্তু নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে দেওয়া এসব বক্তব্যকে অনেকে ‘নির্বাচন প্রলম্বিত করার’ চেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করছেন।
যদিও দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার আজই ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, আমরা নির্বাচন পেছানো, না করা -এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য কখনো রাখি নাই। আমরা নির্বাচন নিরপেক্ষ চাই, বিচার চাই, সংস্কার চাই, আমরা স্থানীয় সরকার আগে চাই, আনুপাতিক নির্বাচন চাই, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চাই’।
তিনি বলেন, সরকারের ভূমিকায় এখনো জনগণ সংশয়ের মধ্যে রয়েছে কারণ তারা মনে করেন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখন নাই। তিনি আরও বলেন, এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন আমরা মেনে নিতে পারি না। আর যারা যেনতেন নির্বাচন করবেন, আমরা তাদেরকেও মেনে নেব না।
চাপ তৈরি করতেই কি বিভিন্ন দাবি?
ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, যেনতেন নির্বাচন হয়ে লাভ কী।
তিনি বলেন, এখন যে পরিবেশ। থানায় শাস্তিপ্রাপ্ত। বিএনপি নেতাকর্মীরা জোর করে নিয়ে গেল। থানা আক্রমণ করল। এমন ঘটনা ঘটছে। এদের নিয়ন্ত্রণ না করে সুষ্ঠু নির্বাচন কিভাবে হবে।
গাজী আতাউর রহমান আরও বলেন, তারা অনেক আগে থেকেই সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি করে আসছেন। এখন আমাদের জোট নিয়ে কাজ চলছে। মানুষ চায় ঐক্যবদ্ধ হোক ইসলামপন্থিরা। ভোট যেন ভাগ না হয়। প্রতিটি আসনে একক প্রার্থী নিশ্চিত করার কৌশল নিয়েই কাজ করছি আমরা।
আর খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘ইসলামপন্থি’ সব দল এক হয়ে নির্বাচনি মাঠে নামার চেষ্টা করবেন তারা, কিন্তু সেজন্য নির্বাচন বিলম্বিত করার কোনো ইচ্ছে তাদের নেই।
তিনি বলেন, মূল বিষয় হলো সংস্কার ও বিচার দৃশ্যমান হওয়ার পরই নির্বাচন হওয়া উচিত। এ মূহুর্তে নির্বাচন হলে প্রশাসন ও পুলিশের যে অবস্থা – মানুষ যাকে ইচ্ছে ভোট দেবে- সেই পরিস্থিতি নেই।
কিন্তু দলগুলো যাই বলুক অনেকেই মনে করেন, মাঠ পর্যায়ে বিএনপি একক অবস্থানের মধ্যে নির্বাচনে গেলে ইসলামি দলগুলোর জন্য পরিস্থিতি সুখকর নাও হতে পারে এবং সে কারণেই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের ইস্যুটিকে তারা সবাই মিলে সামনে নিয়ে আসতে চান।
দৈনিক নয়া দিগন্তের সম্পাদক সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর বলছেন, নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টার কোনো লক্ষণ তিনি এখনো দেখছেন না। তার মতে, জামায়াত ‘ইসলামপন্থিদের’ নিয়ে জোট গড়তে চাইছে যাতে করে ‘ইসলামপন্থি’ ভোট ভাগ না হয়।
তিনি আরও বলেন, আর নির্বাচনের পরিবেশ ও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর ইস্যুটি হয়তো সরকারের ওপর চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে বলা হচ্ছে- যাতে করে সত্যিকার অর্থে ফ্রি ও ফেয়ার নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়।