Image description

টঙ্গীর বিভিন্ন শিল্পকারখানায় দলের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৬ জুলাই গাজীপুর মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিব উদ্দিন সরকার (পাপ্পু), মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব আবদুল হালিম মোল্লা, মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য জিয়াউল হাসান (স্বপন) ও টঙ্গী পূর্ব থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব সিরাজুল ইসলামকে বহিষ্কার করা হয়। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত চিঠি দিয়ে তাদের বহিষ্কারের কথা জানিয়ে দিয়েছেন বলে সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।
এর আগে ৩০ জুন রাতে মহাখালীর একটি বারে গিয়ে মদ্যপান করেন বনানী থানা যুবদলের আহ্বায়ক মনির হোসেন। পরে বিল পরিশোধকে কেন্দ্র করে তিনি বার ভাঙচুর ও কর্মচারীদের মারধর করেন। এ অভিযোগ বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পৌঁছলে ঘটনার তদন্ত করা হয়। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ৩ জুলাই মনির হোসেনকে বহিষ্কার করে বিএনপি। যুবদল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বহিষ্কৃত নেতার কোনো ধরনের অপকর্মের দায়দায়িত্ব দল নেবে না। 
২৮ জুন সাতক্ষীরা পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ড বিএনপির কার্যালয়ে সার্চ কমিটির যাচাই বাছাই কার্যক্রম চলাকালে পৌর বিএনপির সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মনিরের নেতৃত্বে দলীয় কার্যালয়ের আসবাবপত্র ভাঙচুর ও নবায়ন ফরম লুটপাট করা এবং সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সদস্য শেখ এবাদুল ইসলামসহ অন্যদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২৯ জুন সাতক্ষীরা পৌর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মনির ও পৌর­ বিএনপির সাবেক সদস্য মাসুম বিল্লাহকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। 
শুধু এ ৭ জনকেই নয়, গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দখলবাণিজ্যসহ বিশৃঙ্খলার অভিযোগে দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে ১১ মাসে প্রায় ৬ হাজার নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়। এর মধ্যে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বহিষ্কার করা হয় প্রায় ৪ হাজার নেতাকর্মীকে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে কঠোর অবস্থানে বিএনপি। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নেওয়া হচ্ছে সাংগঠনিক শাস্তির ব্যবস্থা। ছাড় দেওয়া হচ্ছে না কাউকেই। উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর থেকেই বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কিছু নেতাকর্মী এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও দখলবাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হয়।

এতে বিএনপির বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল কঠোর সমালোচনায় লিপ্ত হয়। এ খবর দ্রুতই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে পৌঁছে। সঙ্গে সঙ্গে লন্ডন থেকে তিনি বিশৃঙ্খলায় জড়িত দলের নেতাকর্মীদের শাস্তির নির্দেশ দেন। নির্দেশ পাওয়ার পর শুরু হয় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তি যা এখনো চলছে। প্রায় প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে বহিষ্কার করা হচ্ছে বলে জানা যায়। 
সূত্র জানায়, বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কারও বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলার অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে কারণ দর্শাও নোটিস দেওয়া হয়। এরপর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গঠিত তদন্ত কমিটি দ্রুত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তদন্ত রিপোর্ট পাঠায়। রিপোর্টের ভিত্তিতে দলের কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির মুখপাত্র ও দপ্তরের দায়িত্বে নিয়োজিত সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বহিষ্কারের কথা সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের জানিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে গণমাধ্যমে প্রেরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বহিষ্কারের খবর জানিয়ে দেওয়া হয়। গুরুতর অভিযোগ থাকলে কখনো কখনো অভিযুক্ত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। 
অভিজ্ঞ মহলের মতে, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে, তাদের বহিষ্কার করে দিচ্ছে, এটি রাজনীতিতে ইতিবাচক। মানুষ অন্তত জানতে পারছে এই রাজনৈতিক দলের কোনো নেতাকর্মী অপরাধ করলে পার পাচ্ছে না। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি হাইকমান্ডের এমন সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী। এই ধারা অব্যাহত রাখলে বিএনপির ভারমূর্তি উজ্জ্বল হবে। আর এর প্রভাব ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়বে। 
সূত্র মতে, দীর্ঘ ১৯ বছর বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকায়  মামলা-হামলাসহ বিভিন্নভাবে তৎকালীন সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়। অনেকে নিজেদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে বছরের পর বছর পালিয়ে বেড়ায়। এ পরিস্থিতিতে ৫ আগস্টের পর দেশে বিএনপির জন্য অনুকূল পরিবেশ ফিরে আসে। আর এই সুযোগে বিচ্ছিন্নভাবে দলের কিছু নেতাকর্মী বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে যায়। যদিও দলীয় হাইকমান্ড তাদের কাউকে ছাড় দেয়নি। তবে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলার তেমন অভিযোগ না থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। 
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুসারে নিজেদের প্রভাব বিস্তার ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য তৃণমূল পর্যায়ের কিছু বিএনপি নেতাকর্মী ৫ আগস্টের পর থেকে দলের কমিটি পুনর্গঠন ছাড়াও বিভিন্ন স্থাপনা দখলসহ নানান অপরাধ কর্মে লিপ্ত হয়। আর এ নিয়ে প্রায়ই দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের মধ্যে মারামারি ও হানাহানিতে লিপ্ত হয় তারা। আর এ জন্যই দলের ইমেজ ধরে রাখতে বিএনপি হাইকমান্ড অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করে।

প্রথমে সন্দেহভাজন সবাইকে কারণ দর্শাও নোটিস দিলেও পরে শুধু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আর  যাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, তাদের আর কখনো দলে ফিরিয়ে আনা হবে না বলে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের কাছে কেন্দ্র থেকে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। 
অভিযুক্তরা দলের যে স্তরের নেতাকর্মীই হোক না কেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের কারণে দেশব্যাপী যাতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরতে না হয়, সে জন্যই দলীয় হাইকমান্ড আগেভাগেই সাংগঠনিক শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। দলীয় হাইকমান্ড জানিয়েছে, যত বড় ত্যাগী নেতাই হোন না কেন, বিএনপির নাম ব্যবহার করে কেউ অপরাধ-বিশৃঙ্খলায় জড়িত হলে  দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে।

 

হাইকমান্ডের নির্দেশ কার্যকর হওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ের বিএনপি নেতাকর্মীদের অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা আস্তে আস্তে কমে আসছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যাতে নেতাকর্মীদের এই বিশৃঙ্খলা বন্ধ করা যায়, সেজন্য দলীয় হাইকমান্ড নানা কৌশলে বিরামহীনভাবে কাজ করছে বলে বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান। 
জানা যায়, কারা অপরাধ-বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িয়ে দলের ইমেজ নষ্ট করতে চায়, তা পর্যবেক্ষণে দলের কজন সিনিয়র নেতা ছাড়াও লন্ডন থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সর্বদা খোঁজ-খবর রাখছেন। যে কারণে, অভিযোগ উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই বিশৃঙ্খলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। 
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, দলের নাম ভাঙিয়ে যারাই কোনো অপকর্মে জড়িত হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিএনপি একটি বড় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। তাই বিচ্ছিন্নভাবে দলের কোনো কোনো নেতাকর্মী বিশৃঙ্খলা করছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে। তবে অভিযোগ প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। অপরাধ করে কেউ পার পাচ্ছে না।   
বিএনপির মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ অনিয়ম-দুর্নীতি করলে তাকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কারণ দর্শাও নোটিস দেওয়া হচ্ছে। পরে তদন্ত সাপেক্ষে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একটি অঙ্গ-সংগঠনের সিনিয়র নেতা জনকণ্ঠকে জানান, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে বিএনপি কঠোর অবস্থানে। ৫ আগস্টের পর ইতোমধ্যেই প্রায় ৪ হাজার তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যার বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ আসছে, সঙ্গে সঙ্গেই সাংগঠনিকভাবে শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।