
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্লাব পরিচালনায় ২০২৫-২৬ কার্যকরী পরিষদে (জুলাই ২০২৫ থেকে জুন ২০২৬) ১৫ সদস্যবিশিষ্ট নতুন কমিটিতে সাত জন আওয়ামী লীগপন্থী নীল দলের শিক্ষককে মনোনীত করে ফ্যাসিস্টের দোসরদের পুনর্বাসনের অভিযোগ উঠেছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় বিএনপিপন্থী শিক্ষক সাদা দলের নেতাদের ভূমিকা রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে এবং বিভিন্ন মহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের কার্যকরী পরিষদ এক বছরের জন্য গঠিত হয়। গতকাল সোমবার (৩০ জুন) ছিল আগের (২০২৪-২৫) কমিটির শেষ কার্যদিবস। এই কার্যকরী পরিষদের সভাপতি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) আওয়ামীপন্থী অধ্যাপক ফজলুর রহমান ও সম্পাদক ছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বিএনপিপন্থী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, গত ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ সব ধরনের নির্বাচন-নেতৃত্বে নির্বাচন বন্ধ থাকলেও ক্লাবের নতুন করে কমিটি গঠনের পেছনের কারণ ছিল সাদা দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ। ড. মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী সাদা দলের অপর অংশে (৫ আগস্টের পর সাদা দল দুই ভাগের বিভক্ত হয়েছে) থাকায় তাকে ক্লাবের বাইরে রাখতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সংকটে ক্লাবের কমিটির মেয়াদ দুই বছরে রাখার নজির ছিল। সে ক্ষেত্রে ২০২৪-২৫ সালের কার্যকরী পরিষদের কমিটিকে আরেক বছর রাখা যেত।
জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘গত কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। তাই আমি বিদায় নিয়েছি।’
জানা গেছে, গতকাল রাতে কলা অনুষদের ডিন ও সাদা দলের সাবেক নেতা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর খান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ক্লাবের ১৫ সদস্যের কার্যকরী কমিটি ঘোষণা করেন। তিনি জানান, সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান এবং নীল দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. আমজাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের মাধ্যমে এ সর্বসম্মত কমিটি গঠিত হয়েছে।
ঘোষিত এ কমিটিতে সভাপতি হয়েছেন শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ; সহ-সভাপতি ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এম এ কাউসার এবং অধ্যাপক ড. এস এম রেজাউল করিম; কোষাধ্যক্ষ ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহিদুল ইসলাম এবং রসায়ন বিভাগের মো. কামরুল ইসলাম; যুগ্ম সম্পাদক ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. রাদ মুজিব লালন এবং নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম আরিফ মাহমুদ।
এ ছাড়া সদস্য হিসেবে রয়েছেন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হুমায়ুন কবীর, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম আকন্দ, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খালেদ মাহমুদ, গ্রাফিকস ডিজাইন বিভাগের মো. ইসরাফিল প্রাং, গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জাভীদ ইকবাল বাঙালী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ড. তাহমিনা ইসলাম, কারুশিল্প বিভাগের মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, ট্রেজারার অফিসের মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম। কমিটির সাতজন আওয়ামীপন্থী শিক্ষক এবং সাতজন বিএনপিপন্থী শিক্ষক এবং অপরজন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ।
এর মধ্যে কমিটির সম্পাদক রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক কামরুল আহসান আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের প্যানেল নীল দলের হয়ে শিক্ষক সমিতিতে দুবারের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। কেউ কেউ বলছেন, তিনি ঢাবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম নীল দলের হয়ে সিনেট সদস্য ছিলেন। যুগ্ম সম্পাদক ড. রাদ মুজিব লালন এনআরবিসি ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এ নিয়োগ আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে হয়েছিল। এ ছাড়া তিনি চাকরিচ্যুত বিচারক এস এম মুজিবুর রহমানের ছেলে।
এ ছাড়া কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. খালেদ মাহমুদ ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট নীল দলের আহ্বায়ক, কারুশিল্প বিভাগের জাহাঙ্গীর হোসেন চারুকলা অনুষদ নীল দলের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং আরেক সদস্য গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জাভীদ ইকবাল বাঙালী ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন। জুলাই আন্দোলনের বিরোধিতা করায় তিনি শিক্ষার্থীদের বয়কটের মুখে পড়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, এই কমিটি গঠনের মাধ্যমে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফ্যাসিস্টদের দোসরদের পুনর্বাসনের পথ প্রশস্ত হলো। বিশেষ করে জুলাই-আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের উৎপত্তিস্থল এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই জুলাইয়ের চেতনার কবর রচনা করা হল সাদা দলের মাধ্যমে।
আওয়ামী লীগের আমলেও ভাগাভাগি হতো পদ
৫ আগস্ট-পূর্ববর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের দীর্ঘদিনের রীতি অনুযায়ী, এটির নেতৃত্ব নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগপন্থী উভয় পক্ষেরই শিক্ষকদের সমতা নিশ্চিত করা হয়। অর্থাৎ উভয় পক্ষ নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এ কমিটির পদ ভাগাভাগি করে থাকে। তবে কোনো পদে একাধিক প্রার্থী থাকলে কণ্ঠ ভোট প্রদানের প্রচলন রয়েছে। তবে জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিলুপ্তির প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হওয়ার মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের জনতার মধ্যে এ ক্লাবের প্রচলিত রীতি পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার উদ্ভব হলেও তাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, যা নিয়ে অনেকে আপত্তি তুলেছেন।
এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আবদুল কাদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে জুলাই শুরু করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ক্লাব। নবগঠিত কমিটির ১৫টি পদ অর্ধেক অর্ধেক করে ভাগ করে নিয়েছেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগপন্থী নীল দলের শিক্ষকরা। দেশে আবারও নতুন করে ফ্যাসিস্ট তৈরি করার ক্ষেত্রে বা লীগকে নানারূপে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা থাকবে এই নামধারী সুবিধাবাদী শিক্ষকদের। বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে ওনারা কেবল নিজের পদ-পদবি আর পদন্নোতির জন্য ক্যাম্পাসকে, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের লীগের কাছে ইজারা দিয়ে দিয়েছিলেন, নিজের ব্যক্তিত্ব আর মনুষ্যত্ব বিকিয়ে দিয়েছিল। এখনো সেইম। তবে তাদের এসব অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতে দেওয়া হবে না। স্বার্থান্বেষী গাদ্দারদের সেই সুযোগ আমরা দেব না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গত ১৭ বছরে শেখ হাসিনার শাসনকে যেসব গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি বৈধতা দিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক সংগঠন ‘নীল দল’। এ দলটি শুধু শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতাই করেনি; বরং ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিয়ে এবং সেসব কর্মকাণ্ডকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য সমাজে বুদ্ধিজীবী সেজে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের মূল সংগঠন এবং ছাত্রলীগের অঙ্গসংগঠনের পাশাপাশি নীল দলও শেখ হাসিনার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে, যখন আন্দোলনে হাজারো শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়, তখন এই গোষ্ঠী কোনো অনুশোচনা না করে নতুন নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে শুরু করে। সমালোচনার মুখে আবু আহসানের নাম বাদ দিলেও মাকসুদ কামালের সহযোগীদের পুনর্বাসন করেছেন সাদা দলের কতিপয় নেতা। এটা জুলাই বিপ্লবের শহীদদের সঙ্গে গাদ্দারির শামিল। এ ঘটনার মাধ্যমে গণ-অভ্যুত্থাণের সূতিকাগার এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে জুলাই চেতনাকে কবর দেওয়া হলো।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, ‘আমাদের নীল দল, সাদা দল কোনো দলীয় সংগঠন নয়, রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনও নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের নির্বাচনে সবসময় শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে এই কাজ করা হয়ে থাকে। এ বছর তা করা হয়েছে। আমি নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি এবং আমাদের কাছে একটা প্যানেলই জমা হয়েছে। শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনা করে কেউ কেউ দায়িত্ব নিয়ে এটি সম্পন্ন করেন। এটাই এবারও হয়েছে।’