
সরকারি চাকরির কোটা ঘিরে গত বছর আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে বিসিএসের কোটা ঘিরে এই আন্দোলনের শুরু। পরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তৎকালীন সরকারের পতন হয়। সেই বিসিএসেই এখন বঞ্চনা চলছে বলে অভিযোগ করছেন চাকরিপ্রার্থী ও জুলাই আন্দোলনকারীরা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সরকারি চাকরিতে বর্তমানে ১৯ লাখ ১৯ হাজার ১১১টি অনুমোদিত পদ রয়েছে। এর বিপরীতে ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৮৯১ জন কর্মরত আছেন; চার লাখ ৬৮ হাজার ২২০টি পদ শূন্য। এর মধ্যে প্রথম থেকে নবম গ্রেডের দুই লাখ ৫৯ হাজার ৬৫৭টি অনুমোদিত পদ রয়েছে।
আগের কয়েকটি বিসিএস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৩৮, ৪০, ৪১ ও ৪৩তম বিসিএসে বিজ্ঞাপিত পদের চেয়ে বেশি প্রার্থী সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু ৪৪তম বিসিএসে ৪৩০টি পদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলেও এতে সায় দেয়নি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। ফলে বিজ্ঞাপিত পদ ধরেই গত সোমবার রাতে ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)।
পিএসসি সূত্র জানায়, ৪৪তম বিসিএসে বিজ্ঞাপিত পদ ছিল এক হাজার ৭১০টি, কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারে ২০ জন যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় এক হাজার ৬৯০টি সুপারিশ করা হয়েছে। তবে ৪৩তম বিসিএসে বিজ্ঞাপিত পদ ছিল এক হাজার ৮১৪টি, সুপারিশ করা হয়েছে দুই হাজার ১৬৩টি পদে। ৪১তম বিসিএসে বিজ্ঞাপিত পদ ছিল দুই হাজার ১৬৬টি, সুপারিশ করা হয়েছে দুই হাজার ৫২০ পদে। ৪০তম বিসিএসে বিজ্ঞাপিত পদ ছিল এক হাজার ৯০৩টি, সুপারিশ করা হয়েছে এক হাজার ৯৬৩ পদে। ৩৮তম বিসিএসে বিজ্ঞাপিত পদ ছিল দুই হাজার ২৪টি, সুপারিশ করা হয়েছে দুই হাজার ২০৪টি পদে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পিএসসিতে দীর্ঘ জটের কারণে একটি বিসিএস শেষ হতে তিন-চার বছর সময় লেগে যায়। এতে একটি বিসিএসের বিজ্ঞপ্তির সময় যত শূন্য পদ থাকে, ওই বিসিএসের ফল প্রকাশের সময় অনেক বেশি পদ শূন্য হয়ে যায়। ফলে সাধারণত পরবর্তী বিসিএসের জন্য ঘোষণা দেওয়া পদগুলো হাতে রেখে সুপারিশের সময় পদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে মেধাবী শিক্ষার্থীরা চাকরির সুযোগ পান। অন্যদিকে আবার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে খুব বেশি শূন্যতার সৃষ্টি হয় না।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে কয়েকটা বিসিএস জমে গেছে। এখন যদি ক্যালকুলেশন করে দেখা যায়, পদ শূন্য আছে, কিন্তু অন্য বিসিএসে ইফেক্ট করবে না, তাহলে সরকার চাইলে নতুন পদ যুক্ত করতে পারে। এতে একদিকে কিছু মেধাবীর চাকরির সংস্থান হবে, আবার শূন্য পদগুলোও পূরণ হবে।’
সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৪৪ ও ৪৫তম বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগের প্রক্রিয়াধীন শূন্য পদসংখ্যা পর্যালোচনা ও সমন্বয় করে একটি প্রস্তাব তৈরি করে, যা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সেই প্রস্তাবে দেখা যায়, ৪৪তম বিসিএসে ৪৩০টি পদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে বিসিএস সাধারণ শিক্ষায় ১৮৭টি পদ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে স্বাস্থ্য (পরিবার ও পরিকল্পনা) ৫৪টি পদ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে বিসিএস (কর) ৫৪টি পদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বিসিএস (মৎস্য) ৩০টি পদ, কৃষি মন্ত্রণালয়ে বিসিএস (কৃষি) ৬৮টি পদ, রেলপথ মন্ত্রণালয়ে বিসিএস (রেলওয়ে পরিবহন ও বাণিজ্যিক) দুটি পদ ও বিসিএস (রেলওয়ে প্রকৌশল) ৯টি পদ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে বিসিএস (সড়ক ও জনপথ) ২৬টি পদ। ৪৪তম বিসিএসে এই ৪৩০টি পদ বাড়ানোর প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার বিবেচনা ও অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। এই সারসংক্ষেপে গত ১৯ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান স্বাক্ষর করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ৪৪তম বিসিএসের জন্য ৪৩০টি পদ বাড়ানোর প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হলেও এতে সাড়া মেলেনি। ফলে ৪৪তম বিসিএসে বিজ্ঞাপিত পদ ধরেই ফল প্রস্তুত করে পিএসসি।
পিএসসির সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখানে পিএসসির করার কিছু নেই। যদি পিএসসিতে নতুন প্রস্তাবিত পদ অনুমোদন হয়ে আসত, তাহলে সে অনুযায়ী ফল প্রস্তুত করা হতো। যেহেতু আমাদের কাছে ৪৪তম বিসিএসের পদ বাড়ানোর কোনো চিঠি আসেনি, তাই বিজ্ঞাপিত পদ ধরেই ফল প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষায় কৃতকার্য হলেও যাঁরা ক্যাডার পদে মনোনয়ন পাননি, তাঁদের বিধি অনুযায়ী নন-ক্যাডারের শূন্য পদ থাকা সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে সুপারিশের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
সূত্র জানায়, এক হাজার ৭১০টি ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর ৪৪তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এতে আবেদন করেন প্রায় তিন লাখ ৫০ হাজার প্রার্থী। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৫ হাজার ৭০৮ জন। এরপর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন প্রায় চার হাজার প্রার্থী। তাঁদের মধ্য থেকে চূড়ান্তভাবে বিভিন্ন ক্যাডারে এক হাজার ৬৯০ জনকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়।
চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, যে চার হাজার প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন তাঁদের প্রায় সবাই মেধাবী ও ক্যাডার পদের জন্য যোগ্য। অথচ তাঁদের মধ্যে প্রায় দুই হাজার ৩০০ জন প্রার্থী বঞ্চিত হলেন। তবে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ও আগের রেওয়াজ অনুযায়ী চাইলে আরো ৪৩০ জন মেধাবী সুযোগ পেতে পারতেন, যা থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হলো।
এদিকে গত সোমবার ৪৪তম বিসিএসের ফল প্রকাশের দিন দুপুরের দিকে পদ বৃদ্ধির দাবি নিয়ে রমনা পার্কের গেট দিয়ে বের হয়ে ‘যমুনা’র সামনে রাস্তা অবরোধের চেষ্টা করেন চাকরিপ্রার্থীরা। তবে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেয়।
ওই দিনই জাতীয় নাগরিক কমিটির সাবেক সহমুখপাত্র ও অ্যাক্টিভিস্ট মোহাম্মদ মিরাজ মিয়া তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে বলেন, ‘আমার মনে হয়, এ দেশে শিগগিরই আরেকটি বড় আন্দোলন হতে যাচ্ছে, সেটাও হবে চাকরির পরীক্ষাগুলোকে কেন্দ্র করেই! আপনারা জানেন, ৪৪তম বিসিএসের প্রায় ১২ হাজার ক্যান্ডিডেটের সঙ্গে এই রাষ্ট্র আরেকটা বড় প্রতারণা করতে যাচ্ছে।’ তাঁর ওই পোস্টটি শেয়ার করেছেন এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহসহ আরো অনেকে।
ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলের গত ৪০তম, ৪১তম ও ৪৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগে পদসংখ্যা বাড়ানো হলেও জুলাইয়ের রক্তের ওপর মাড়িয়ে গঠিত হওয়া সরকারের আমলে পদসংখ্যা বাড়ানোর কোনো ইতিবাচক লক্ষণ না দেখে সবাই সত্যিকার অর্থেই শঙ্কিত হচ্ছে। এই দায় প্রধান উপদেষ্টাকেই নিতে হবে। তাঁর কার্যালয়ে জনপ্রশাসন সচিব থেকে পদসংখ্যা বৃদ্ধির চিঠি গেলেও সেটাতে প্রধান উপদেষ্টা স্বাক্ষর করেননি বলে এখন সবার কাছে বিবেচিত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে যে ধারণা গ্রো করছে, সেটার প্রভাব ভয়াবহ হবে। সবার মধ্যে ধারণা তৈরি হচ্ছে, হয়তো আবার সব কিছু দলীয়করণ হতে যাচ্ছে। জেনারেল ক্যাডার ও শিক্ষা ক্যাডারে যথেষ্ট পদ থাকার পরও ক্যাডার পোস্ট বৃদ্ধি না করার পেছনে কোনো যুক্তি তো নেই! সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়া যোগ্য ক্যান্ডিডেটও আছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদও খালি আছে। কিন্তু এখন আপনি নিয়োগ দিচ্ছেন না! এটা তো চরম অন্যায়। ইন্টেরিম আমলেই একটা বিশালসংখ্যক পরীক্ষার্থীকে স্বচ্ছতার সঙ্গে রাষ্ট্রের শূন্য পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারত। সেটাও হয়নি।’