Image description
আদালতে নূরুল হুদার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি । তৎকালীন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন মাঠপর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করে । গোয়েন্দা সংস্থা আগেই ফিল্ড দখল করে দিনের ভোট রাতে করতে সহযোগিতা করেছে । দায়িত্বে থাকা পুলিশ, রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের সহযোগিতায় এভাবে ভোট হয়েছে । ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে গোপন বৈঠক । অনুতপ্ত নূরুল হুদা নিজেকে নির্দোষ দাবি।

‘সরকার ও বিভিন্ন বাহিনীর চাপে ২০১৮ সালে প্রহসনের নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছি। সেসময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসাররা মিলে দিনের ভোট রাতেই করে ফেলেন। যখন দেখলাম কিছু কিছু কেন্দ্রে ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে, তখন আমি বুঝে গেলাম দিনের ভোট রাতেই হয়ে গেছে। তৎকালীন সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপে এসব সংঘটিত হয়েছে।’ সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরল হুদা মঙ্গলবার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এমন কথা বলেন।

রাষ্ট্রদ্রোহ ও জনগণের ভোট ছাড়া নির্বাচন সম্পন্ন করার অভিযোগে বিএনপির করা মামলায় সম্প্রতি তাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর দুই দফায় আট দিনের রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই-এর পরিদর্শক সৈয়দ সাজেদুর রহমান কেএম নূরল হুদাকে আদালতে হাজির করেন। এ সময় ‘স্বেচ্ছায়’ জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় তা রেকর্ডের জন্য আবেদন করা হয়। এরপর ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াদুর রহমান তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।

জবানবন্দিতে সাবেক এই সিইসি আরও বলেন, ‘আমি তফশিল ঘোষণা করে নির্বাচন দিয়েছি। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর জানতে পারি, অনেক কেন্দ্রে ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে, যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। আমি আরও জানতে পারি, অনেক ব্যালট বাক্স রাতেই ভরে গেছে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তাদের কর্মীবাহিনী দ্বারা দায়িত্বে থাকা পুলিশ, রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের সহযোগিতায় এমন কাণ্ড ঘটেছে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ ঘটনার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী।’

তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার লোকদের অন্ধকারে রেখে এমন অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ভোটে অনিয়ম করা হয়েছে। আমি এ নিয়ে অনেক অনুতপ্ত ছিলাম। যেহেতু গেজেট প্রকাশ হয়ে গেছে, তখন আমি নির্বাচন বাতিল করতে পারি না। তখন আমার হাতে ক্ষমতাও নেই। এ বিষয়ে আমি অনেকবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছি এবং মিডিয়ার সামনে বলেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘রিটার্নিং অফিসার এবং সহকারী রিটার্নিং অফিসাররা নির্বাচন পরিচালনা করেন। তারা নির্বাচন কমিশনারকে অন্ধকারে রেখে এভাবে সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। এ প্রক্রিয়ার পুরোটাই হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের মাধ্যমে। আর গোয়েন্দা সংস্থা আগেই ফিল্ড দখল করে দিনের ভোট রাতে করতে সহযোগিতা করছে।’

সাবেক নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদার ভাগিনা এসএম শাহজাদা সাজু আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করেন। এ বিষয়ে তিনি জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমার ভাগিনা নির্বাচন করেছিল, তবে ভাগিনার নির্বাচনে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। কিন্তু সে যেহেতু আমার ভাগিনা, সেক্ষেত্রে কিছুটা প্রাধান্য পেয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় মাঠপর্যায়ের সব কর্মকর্তা তৎকালীন ইসি সচিব হেলালুদ্দীনের অধীনে ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের হয়ে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন। অ্যাডমিন অফিসাররাই রিটার্নিং অফিসার এবং সহকারী রিটার্নিং অফিসার থাকেন। তৎকালীন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন কোনো না কোনোভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আমার একার পক্ষে কিছুই করার ছিল না।’

সূত্র জানায়, সন্ধ্যায় জবানবন্দি রেকর্ড শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

প্রসঙ্গত, ২২ জুন নূরুল হুদাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। এরপর শুক্রবার তাকে আবারও চারদিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়। অপরদিকে ২৫ জুন মগবাজার এলাকা থেকে আরেক সাবেক সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালকে গ্রেফতার করা হয়। পরের দিন তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শেষে রোববার তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

এর আগে ২২ জুন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং মামলা, গুম, খুন ও তথ্য সংরক্ষণ সমন্বয়ক সালাহ উদ্দিন খান শেরেবাংলা নগর থানায় এ মামলা করেন। মামলায় ২০১৪ সালের নির্বাচনের সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ, ২০১৮ সালের নির্বাচনে সিইসি কেএম নূরুল হুদা এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের পাশাপাশি তাদের সময়ের নির্বাচন কমিশনারদের আসামি করা হয়। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার, একেএম শহীদুল হক, জাবেদ পাটোয়ারী, বেনজীর আহমেদ ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে আসামি করা হয়। পরে রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ যুক্ত হয়েছে এ মামলায়।

রাতের ভোটের সেই গোপন মিটিং : এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর সন্ধ্যায় বেইলি রোডের অফিসার্স ক্লাবের একটি কক্ষে বিসিএস প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থার গোপন বৈঠক হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সচিব সাজ্জাদুল হাসান, সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহমদ, সাবেক নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সাবেক ডিজি ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহণ সচিব মহিবুল হক, সাবেক ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার (প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সাবেক ডিজি) আলী আজম এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-১ কাজী নিশাত রসুল (যিনি শেখ মুজিব হত্যা মামলার জজ কাজী গোলাম রসুলের মেয়ে)। এছাড়াও পুলিশের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন র?্যাবের তৎকালীন ডিজি বেনজীর আহমেদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, তৎকালীন ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজমের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম, তৎকালীন পুলিশ হেডকোয়োর্টারের ডিআইজি প্রশাসন হাবিবুর রহমান, তৎকালীন ডিএমপির ডিসি প্রলয় জোয়ার্দার (শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার)-সহ আরও কর্মকর্তারা।

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে আড়াই ঘণ্টা চলা এ মিটিংয়ে সারা দেশের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং সেট-আপ ও পরিকল্পনা রিভিউ করা হয়। বৈঠকে ডিআইজি হাবিব জানান, পুলিশ সূত্রের খবর অনুযায়ী ৩৩টি সিট নৌকার কনফার্ম আছে এবং ৬০-৬৫টিতে কনটেস্ট হবে, বাকি আর কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজেই সাংঘাতিক কিছু করা ছাড়া এ খেলা উতরানো যাবে না। ওই সভায় সারা দেশের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং সেট-আপ ও পরিকল্পনা রিভিউ করা হয়। বিস্তারিত আলোচনা শেষে মূল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, নির্বাচন কমিশন থেকে বিএনপি-ফ্রন্টকে চরম অসহযোগিতা করা হবে, যতই চাপ দেওয়া হোক, প্রশাসনে হাত দেওয়া যাবে না। ধরপাকড় বাড়ানো হবে। প্রার্থী গুম-খুন করে এমন অবস্থা তৈরি করা হবে, যাতে তারা নির্বাচন থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন। আর শেষ পর্যন্ত ভোটে থেকে গেলে ভোটের দিন পর্যন্ত ধরপাকড়ের তাণ্ডব চালানো হবে নির্দয়ভাবে, যেন ভোটকেন্দ্রে কেউ হাজির হতে সাহস না করেন। আর যদি ভোটের ফ্লো ঠেকানো না যায়, তবে মিডিয়া ক্যু করে নৌকাকে জেতানো হবে। বিটিভির মাধ্যমে ফলাফল ঘোষণা করে সব মিডিয়ায় তা রিলে করার ব্যবস্থা করা হবে। একবার ফল ঘোষণা করতে পারলে তারপর নির্মমভাবে সব ঠান্ডা করা হবে।

সূত্র জানায়, উন্নয়ন প্রকল্প তদারকির নামে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে ৮ জন আওয়ামী দলীয় কর্মকর্তা দিয়ে মনিটরিং সেল গঠন করে পুলিশ সদর দপ্তর। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান ৪৫ জন সিনিয়র কর্মকর্তাকে ৬৪ জেলার উপদেষ্টা (মেনটর) নিয়োগ করে একটি নজিরবিহীন সরকারি আদেশ জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ নিয়ে বিএনপির লিখিত আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে তা বাতিল করতে বাধ্য হয়। কিন্তু গোপনে ওইসব কর্মকর্তা জেলায় জেলায় মনিটরিংয়ের কাজ চালিয়ে যান। এর বাইরে সারা দেশে ভোট ইঞ্জিনিয়ারিং করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনা প্রথম তালিকার ৬ জন সচিবকে নিয়ে একটি গোপন কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে। মূলত ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে সব ধরনের অফিসারের গমনাগমন ঘটে থাকে। তাই বিরোধী পক্ষের চোখ এড়ানো সহজ হবে মনে করে জনবহুল এ স্থানে সভাটি করা হয়।

যে সাজা হতে পারে : বিএনপির করা এ মামলায় প্রথমে দণ্ডবিধির সাতটি ধারায় অভিযোগ আনা হয়। পরে এর সঙ্গে আরও তিনটি ধারা যুক্ত করা হয়। এসব ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহ, অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ, প্রতারণা ও নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে দণ্ডবিধির ১২৪(ক) ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে সাবেক নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে।

এ ধারায় সর্বনিম্ন ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে তাদের। এছাড়াও মামলাটিতে দণ্ডবিধি আইনের ৪০৬ ধারায় বর্ণিত অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ধারায় সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। মামলায় দণ্ডবিধির ৪২০ ধারাটিও যুক্ত করা হয়েছে। প্রতারণা সংক্রান্ত এ ধারাটির অভিযোগ মামলার বিচারে প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ৭ বছরের সাজা হতে পারে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনারদের।