Image description

কয়েক দিন ধরেই প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছিলেন জয়নাল আবেদিন (৪২)। বরগুনা সদর হাসপাতালে নিলে পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। সেই সঙ্গে শুরু হয় তাঁর তীব্র শ্বাসকষ্ট। এমন পরিস্থিতিতে তাঁকে হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না।

অবস্থা গুরুতর হলে ১৬ জুন বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন স্বজনরা। কিন্তু তীব্র শ্বাসকষ্টে পথেই তিনি মারা যান।

শুধু জয়নাল আবেদিন নন, বরগুনা সদর হাসপাতালেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ বছর মারা গেছেন ছয়জন, যাঁদের বেশির ভাগই তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। বরগুনা ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ নেই।

হাসপাতালের আইসিইউ সুবিধাসংবলিত অ্যাম্বুল্যান্সটিও অকেজো। এতে গুরুতর রোগীদের বরিশাল বা ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে সাধারণ অ্যাম্বুল্যান্সেই, ঝুঁকিপূর্ণভাবে। দক্ষিণের চিকিৎসায় ভরসা শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। সেখানেও রয়েছে আইসিইউসংকট।
দুটি আরটি-পিসিআর মেশিন, আইসিইউ শয্যা ৭২টি। কিন্তু তার বেশির ভাগই অচল। দ্বীপজেলা ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল (সদর) হাসপাতালের আরটি-পিসিআর ল্যাব ও আইসিইউ ইউনিট অচল পড়ে আছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও দক্ষ জনবলের অভাবে চালু করা যাচ্ছে না গুরুত্বপূর্ণ এ ইউনিটগুলো। বরিশাল, পিরোজপুর আর ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে নেই আইসিইউ শয্যা।

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল জানান, ভোলা সদর হাসপাতালে ছয়টি, পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঁচটি আর বরিশালে ৭২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। করোনার পর সেগুলো আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। তা ছাড়া এ বছর সাতজন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাঁদের কাউকেই হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়নি। তার পরও স্বাস্থ্য বিভাগ এ ব্যাপারে সচেষ্ট রয়েছে। আরটি-পিসিআর ল্যাবের ব্যাপারে তারা খোঁজ রাখছে। অন্য হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ শয্যা স্থাপনের ব্যাপারে তারা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।

বরগুনা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রেজোয়ান আলম বলেন, ৫০টি শয্যায় ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ১৮৩ জন রোগী মঙ্গলবার ভর্তি রয়েছেন। চলতি বছর এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই হাজার ৭৩০ জন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা গেছেন ছয়জন রোগী।

বরগুনার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ বলেন, ‘হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনের বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এসংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানো হবে।’

বরিশালে করোনার প্রস্তুতি অপ্রতুল

২০২০ সালের ১৭ মার্চ শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ড চালু করা হয়। শুরুতে শয্যা ছিল ৫০টি। গত বছর রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় শয্যাসংখ্যা ২০০ করা হয়। পরে রোগীর চাপে আরো দুই দফা ৫০টি করে শয্যা বাড়ানো হয়।

২০২০ সালের ১২ এপ্রিল করোনা পরীক্ষার জন্য একটি আরটি-পিসিআর ল্যাব চালু করা হয়। সেই থেকে সরকারি বরাদ্দের পাশাপাশি ব্যক্তি অনুদানে হাসপাতালে আরটি-পিসিআর মেশিন দুটি, আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৭২টি। ৬৮টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা এবং ৮০০টি অক্সিজেন পয়েন্ট।

করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে সরকারি বরাদ্দে দুই শতাধিক অক্সিজেন সিলিন্ডার, ৬১টি ভেন্টিলেটর, ৪১টি কার্ডিয়াক মনিটর, চারটি অক্সিজেন প্লান্টসহ আনুষঙ্গিক মেশিনারিজ স্থাপন করা হয়। করোনা মহামারির পর ৯৫ শতাংশ হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা অচল পড়ে আছে। ২৮টি আইসিইউ শয্যাও বেহাল। শয্যার সঙ্গে সংযুক্ত বেশ কয়েকটি মনিটর নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।

করোনাকালে দুটি আরটি-পিসিআর মেশিন দিয়ে প্রায় সোয়া লাখ রোগীর নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় ১৬ হাজার ৫০০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। অথচ প্রায় দুই বছর ধরে মেশিন দুটি অচল।

হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা মেশিনের মাধ্যমে রোগীদের অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া হয়। মেশিনের ভেতরে একটি ডিভাইস রয়েছে, তিন মাস পর পর যা পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে করোনা শেষ হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ডিভাইসগুলো পরিবর্তন না করায় সব মেশিন অচল পড়ে আছে।

শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও আরটি-পিসিআর ল্যাব প্রধান এ কে এম আকবর কবীর বলেন, ‘২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আরটি-পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষা করেছি। পরে কিটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে আমরা আর পরীক্ষা করিনি। প্রতিবছর বায়োসেফটি কেবিনেট কেলিব্রেশন করতে হয়। আরটি-পিসিআর মেশিনগুলোর কিছুই করা হয়নি। এসব করা হলে বলা যাবে যে এই মেশিন দিয়ে সামনে করোনায় কতটা কাজ করা যাবে।’

হাসপাতালের উপপরিচালক এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘করোনা ওয়ার্ডের মেশিনগুলো ২০২২ সালের পর আর সচল নেই। ওটা এখন মেডিসিন ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মেশিনগুলো স্টোরে ছিল, দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হয়নি। নতুন করে করোনার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় আমরা মেশিনগুলো ওপেন করছি। এর মধ্যে কিছু ভালো আছে, কিছুর সংস্কার প্রয়োজন।’

ভোলায় করোনার সবকিছুই অচল

দ্বীপজেলা ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল (সদর) হাসপাতালের আরটি-পিসিআর ল্যাব ও আইসিইউ ইউনিট দক্ষ জনবলের অভাবে চালু করা যাচ্ছে না।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে হাসপাতালটিতে ছয়টি আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া পাঁচটি ভেন্টিলেটর, সাতটি অক্সিজেন কনসেনটেটর ও ছয়টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সরবরাহ করা হয়। তবে জনবলের অভাবে গত চার বছরেও আইসিইউ ইউনিটটি চালু হয়নি। করোনার প্রভাব কমে যাওয়ার পর বন্ধ করা আরটি-পিসিআর ল্যাবটিও আর চালু হয়নি।

ভোলা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. তায়েবুর রহমান বলেন, ‘কনসালট্যান্ট পদ ফাঁকা রয়েছে। হাসপাতালে পরিপূর্ণভাবে সিসিইউ ও আইসিউ চালু করা গেলে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া যেত।’

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ সুফিয়ান রুস্তম বলেন, পূর্ণ লোকবল ও সেটআপ ছাড়া আইসিউ ও সিসিইউ ইউনিট চালু করা খুবই কঠিন। হাসপাতালের আরটি-পিসিআর ল্যাব বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আট হাজারের বেশি রোগীর করোনা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু আইসিইউ ইউনিটে এখন পর্যন্ত একজন রোগীরও চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।