
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরকে সামনে রেখে লন্ডনে আসছেন শেখ হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টাকে কালো পতাকা প্রদর্শন এবং বিক্ষোভ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার ১০ জুন লন্ডনে আসার কর্মসূচি রয়েছে। তার আগেই লন্ডনে আসার কথা জয়ের। তিনি লন্ডন থেকে যাবেন ভারতে। ভারতে যাওয়ার আগে লন্ডনে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
শেখ হাসিনা গণভবন ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর এটাই হবে সজীব ওয়াজেদ জয়ের যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো দেশে প্রথম সফর। সন্ত্রাস ও গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সন্ত্রাস, গুম ও গণহত্যায় অভিযুক্ত দলটি লন্ডনে তৎপর রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের লন্ডন আগমনের দিন কালো পতাকা প্রদর্শনসহ বড় শোডাউনের প্রস্তুতি নিয়েছেন গণহত্যায় বিচারের মুখোমুখি শেখ হাসিনার অনুসারী নেতাকর্মীরা। ড. ইউনূস যেসব জায়গায় মিটিং করবেন, সেখানে বিক্ষোভ করবেন তারা। এ বিক্ষোভের মাধ্যমে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারকে কড়া বার্তা দিতে চায়। একই সঙ্গে বিদেশে দলটির শক্তি জানান দিতে চায়। এ লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জড়ো করার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং তার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর তাকে অনুসরণ করে সুবিধাভোগী নেতা ও পতিত সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিরা পালিয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেন। এর মধ্যে অনেকেই এসেছেন যুক্তরাজ্যে। আছেন আরাম-আয়েশে। লুটপাটের টাকায় কেউ বেউ অভিজাত এলাকায় বাড়ি কিনে থাকছেন, কেউরা দামি হোটেলে বসবাস করছেন। তারা এখন লন্ডনে দলীয় কার্যক্রমে সক্রিয়। কেউ কেউ প্রকাশ্যেও আসতে শুরু করেছেন।
ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুর রহমান, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীকে লন্ডনে একাধিক অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে দেখা গেছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী লন্ডনে অবস্থান করছেন। তবে তাকে বাইরে প্রকাশ্যে যেখা যায়নি। সাবেক মন্ত্রী ও বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে রয়েছেন।
পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা ও সুবিধাভোগী লুটেরারা বিদেশে বসে দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে কাজ করছেন। একই সঙ্গে বিদেশে অবস্থানরত নেতাকর্মীদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তাদের মধ্যে কয়েকজনের রাজনৈতিক আশ্রয় চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানা গেছে। সাবেক মন্ত্রী ছাড়াও শেখ পরিবারের শেখ হেলালের ছেলে তন্ময়কে লন্ডনে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। যুক্তরাজ্যের নাগরিক আনোয়ারুজ্জামান সিলেটের মেয়র হয়েছিলেন একতরফা ভোটে। ৫ আগস্টের পর তিনিও দেশ থেকে পালিয়ে লন্ডনে এসেছেন। নিয়মিত বিভিন্ন জায়গায় একত্র হচ্ছেন এবং বৈঠক করছেন তিনি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ৯ জুন দেশ থেকে রওনা দিয়ে ১০ জুন লন্ডনে পৌঁছার কথা রয়েছে। লন্ডন থেকে ফিরবেন ১৩ জুন। প্রধান উপদেষ্টার এ সফরকে সামনে রেখে শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে শোডাউনের জন্য কড়া নির্দেশ রয়েছে বলে জানিয়েছে দলটির একটি সূত্র। শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্যে বসবাসরত আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। খোঁজখবর নিচ্ছেন বিক্ষোভের প্রস্তুতি সম্পর্কেও। বিক্ষোভ যাতে সুসংগঠিত হয়, সেজন্যই লন্ডন আসছেন জয়।
৫ আগস্টের পর থেকে পালিয়ে ভারতে অবস্থান করা শেখ হাসিনা অডিও বার্তা ও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপে যুক্ত হয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন। আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের দেখে নেওয়ার হুমকিও দিচ্ছেন। বিভিন্ন অডিও বার্তা ও দলীয় নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত টেলিফোন কথোপকথন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাসছে। এসব কথোপকথনেও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি তার চরম বিরাগের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে।
অন্যদিকে ৫ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পরপরই ভিডিও বার্তা দেওয়া শুরু করেন জয়। পাশাপাশি ফেসবুকেও সরকারের বিভিন্ন কাজের কঠোর সমালোচনা করছেন। লন্ডন সফর শেষে জয় সোজা ভারতে যাবেন। লন্ডন থেকে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও জয়ের সঙ্গে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দলটির সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, রাজা চার্লসের অনুষ্ঠান ছাড়া বাকি সব জায়গায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কালো পতাকা দেখানো হবে। এয়ারপোর্ট এবং যে হোটেলে তিনি অবস্থান করবেন, সেখানেও বিক্ষোভ করবে নিষিদ্ধ ঘোষিত দলটি।
ব্রিটেনের অত্যন্ত মযাদাপূর্ণ কিং চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড-২০২৫-এর জন্য মনোনীত হয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাজা চার্লসের আমন্ত্রণে তিনি ব্রিটেনে আসছেন। রাজপরিবারের পক্ষ থেকে ১২ জুন এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ অ্যাওয়ার্ড হস্তান্তর করা হবে। রাজা নিজে অ্যাওয়ার্ডটি তুলে দেবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে।
এদিকে রাজপরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া পুরস্কার গ্রহণের জন্য ব্রিটেনে এলেও তিনি রাষ্ট্রীয় উচ্চপর্যায়ের একাধিক বৈঠকও করতে পারেন বলে জানা গেছে।
ব্রিটেনের হাইকমিশনের একটি সূত্র জানায়, অন্যান্য কর্মসূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে বেশকিছু বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন ব্রিটেনের রাজপরিবারের মর্যাদাপূর্ণ অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করতে আসছেন, ঠিক একই সময়ে তাকে কালো পতাকা প্রদর্শন এবং বিক্ষোভ দেখানোর কর্মসূচি নিয়ে হাজির হচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যার অভিযোগে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলটি।
আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, লন্ডনে বিক্ষোভের মাধ্যমে সরকারকে কঠোর বার্তা দিতে চায় দলটি। এ ছাড়া জুলাই-আগস্টে সুবিধামতো সময়ে দেশেও মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত দলটি। এ লক্ষ্যে দলকে সংগঠিত করছেন শেখ হাসিনা নিজেই। তিনি নিয়মিত দেশ ও বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং নির্দেশনা দিচ্ছেন। দলকে সংগঠিত করতে এবং মাঠে নামার প্রস্তুতি নিতে দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনার চাপে দলের অনেকেই জুন-জুলাইয়ের মধ্যে দেশে ফেরার কথাও ভাবছেন।
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পক্ষে বিভিন্ন দেশে লবিংয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের বিরুদ্ধে বিদেশিদের কাছে নালিশের মিশনে নেমেছেন মুনা। তার মিশন হচ্ছে ফ্যাসিবাদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করা।
মুনা আওয়ামী লীগের সময় টানা ছয় বছর যুক্তরাজ্যে হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। কোনো কূটনীতিককে তিন বছরের বেশি সময় এক জায়গায় রাখা হয় না। কিন্তু শেখ হাসিনার অতিবিশ্বস্ত মুনাকে রীতি ভেঙে ছয় বছর যুক্তরাজ্যে রাখা হয়। তিনি যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ হাইকমিশনকে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে রূপান্তর করেছিলেন। এই কূটনীতিক এখন শেখ হাসিনার হয়ে যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপে লবিংয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। ৫ আগস্টের পর তাকে নিয়ে সমালোচনা উঠলে ঢাকায় ফেরানোর জন্য নোটিস করা হয়েছিল।