Image description

শুক্রবার ঈদুল আজহার প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্রিটেনের মুসলিম সম্প্রদায়। কিন্তু এই আনন্দঘন সময়ের প্রাক্কালে দেশটির মুসলিম নারীদের মধ্যে, বিশেষ করে ব্রিটিশ বাংলাদেশি, পাকিস্তানি ও আরব বংশোদ্ভূত নারীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপজুড়ে বোরকা নিষিদ্ধ করার আহ্বান জোরালো হচ্ছে এবং ব্রিটেনেও এই নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই পরিস্থিতি পবিত্র উৎসবের আনন্দে ছায়া ফেলেছে।

সর্বশেষ উত্তেজনার সূত্রপাত হয়েছে ডেনমার্ক থেকে। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন জানিয়েছেন, তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান বোরকা নিষেধাজ্ঞা আরও সম্প্রসারিত করতে চান। তিনি বলেছেন, শিক্ষাঙ্গনে ধর্মীয় প্রতীক ও আচরণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ‘প্রয়োজন’। তার মতে, স্কুলে মুসলিম সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও নারীর দমন রোধ করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ বক্তব্য ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নারীর অধিকারের পক্ষে কাজ করা ব্যক্তিদের মধ্যে হতাশা ও শঙ্কা তৈরি করেছে।

বোরকাকে নিপীড়নের প্রতীক হিসেবে দেখার ধারণার বিরোধিতা করছেন বহু মুসলিম নারী। তাদের মতে, বোরকা বা নিকাব পরা একটি সচেতন ও স্বতঃস্ফূর্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত— যা ধর্মীয় বিশ্বাস, শালীনতা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের গভীর প্রকাশ। এটি চাপিয়ে দেওয়া কোনও নিয়ম নয় বরং তাদের আত্মিক যাত্রা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন।

অনেক মুসলিম নারী বলেন, এই পোশাক আল্লাহর প্রতি ভক্তি প্রকাশের মাধ্যম এবং এমন এক বিশ্বে নারীদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপায়, যেখানে নারীদের প্রায়শই বস্তুগত দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়।

মানবাধিকারের প্রশ্নে বৈশ্বিক অবস্থান

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বরাবরই এই ধরনের নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে আসছে। সংস্থাটি স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, এসব নিষেধাজ্ঞা নারীদের পোশাক পছন্দের অধিকার লঙ্ঘন করে। ২০১৮ সালেই তারা বলেছিল, প্রত্যেক নারীরই তার পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরার এবং নিজের বিশ্বাস বা পরিচয় প্রকাশ করার অধিকার থাকা উচিত।

এই অবস্থান ব্যক্তিগত স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ দিককে তুলে ধরে— ক্ষমতায়ন মানে নারীদের কী পরতে হবে তা নির্ধারণ করা নয়, বরং তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নিশ্চিত করা।

প্রতিরোধের মুখে ধর্মীয় স্বাধীনতা

ডেনমার্কের শিক্ষাঙ্গনে প্রার্থনা কক্ষ তুলে দেওয়ার প্রস্তাবসহ ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার প্রচেষ্টা ব্যক্তিগত ধর্মচর্চায় হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ফ্রেডেরিকসেনের বক্তব্য, ‘আপনি আপনার ধর্ম রাখতে পারেন, কিন্তু স্কুলে আপনি এসেছেন শিক্ষালাভের জন্য, অনেক ব্রিটিশ মুসলিমের কাছে ধর্ম ও পরিচয়ের প্রতি অবজ্ঞার শামিল। শিক্ষাঙ্গনের মতো জায়গাতেও ধর্মীয় বিশ্বাস অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে তাদের জীবনের সঙ্গে।

ঈদের আগে চাপের ছায়া

ব্রিটিশ বাংলাদেশি, পাকিস্তানি ও আরব বংশোদ্ভূত মুসলিম নারীদের অনেকে মনে করছেন, তাদের পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতা এখন ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এমনকি ঈদের মতো আনন্দের সময়েও তারা নিজেদের নিরাপত্তা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শঙ্কিত।

লন্ডনের তরুণী সাবরিন আহমেদ বলেন, ‘প্রতিবার যখন এই নিষেধাজ্ঞার কথা শুনি, মনে হয় এবার আমার পালা কবে আসবে। আমার পর্দা আমার সত্তার অংশ। এটিকে কেউ নিপীড়নের প্রতীক ভাবে, এটা অত্যন্ত কষ্টদায়ক ও বৈষম্যমূলক। ঈদের ঠিক আগে এমন চাপ মানসিকভাবে ভীষণ ক্লান্তিকর।’

বার্মিংহামের শিক্ষক ফাতেমা আলীও বলেন, ‘আমি কী নিরাপদে রাস্তায় হাঁটতে পারবো? আমার মেয়েরা কী হিজাব বা নিকাব পরার কারণে সুযোগ হারাবে? এ ধরনের বিতর্ক আমাদের ধর্মীয় পরিচয়কে সমস্যা হিসেবে তুলে ধরে, অধিকার হিসেবে নয়। এই চাপের মধ্যে ঈদ উদযাপন কঠিন হয়ে পড়ে।’

ব্রিটিশ আরব মুসলিম নারীরাও এই উদ্বেগ ভাগ করে নিচ্ছেন। আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘এটা জননিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, বরং নারীদের নিয়ন্ত্রণ করা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করার একটি কৌশল। এই নিষেধাজ্ঞাগুলো স্পষ্ট বার্তা দেয় যে আমাদের উপস্থিতি ও বিশ্বাস এখানে অবাঞ্ছিত।’

যুক্তরাজ্যে বিতর্ক অব্যাহত

এই বিতর্ক ইতোমধ্যে ব্রিটেনের পার্লামেন্টেও পৌঁছেছে। ৪ জুন নবনির্বাচিত রিফর্ম ইউকে এমপি সারাহ পোচিন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে বোরকা নিষিদ্ধ করার কথা বিবেচনা করতে বলেন। তিনি ফ্রান্স, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ডের উদাহরণ টানেন, যারা ইতোমধ্যে এমন নিষেধাজ্ঞা চালু করেছে। তার বক্তব্যে পার্লামেন্টে অসন্তোষের ঝড় ওঠে— অনেকেই ‘লজ্জা!’ বলে প্রতিবাদ জানান।

প্রধানমন্ত্রী স্টারমার অবশ্য এই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান এবং রিফর্ম ইউকে’র অর্থনৈতিক নীতির সমালোচনায় মনোযোগ দেন।

পোশাকের স্বাধীনতা মানে মৌলিক অধিকার

রাজনৈতিক বিতর্ক চলতে থাকলেও যুক্তরাজ্যের অনেকেই ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত পছন্দের অধিকারে অটল রয়েছেন। মুসলিম নারীদের এই উদ্বেগ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়— আইনি নিষেধাজ্ঞার বাস্তব প্রভাব শুধু ধর্মচর্চা নয়, মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও আত্মপ্রকাশের অধিকারকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

এক্ষেত্রে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংগঠনের দৃঢ় অবস্থান, নারীদের পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতা রক্ষা করা— এই বাড়তে থাকা ইউরোপীয় প্রবণতার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদী কণ্ঠ হয়ে উঠেছে।