Image description

বুধবার বেলা ১২টা। একটি অকল্পনীয় দৃশ্যের সাক্ষী হলো রাজধানীর নয়াপল্টন। কয়েক লাখ তরুণের ঢল। খণ্ড খণ্ড মিছিল আর নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাসে ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ পরিণত হয় জনসমুদ্রে। স্মরণকালের সব রেকর্ড ভেঙে এদিন তরুণ-তরুণীদের বড় জমায়েত প্রমাণ করল গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে তারা পিছিয়ে নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ফেরাতে চান জাতীয় নির্বাচন। তারা বলেছেন, তরুণ প্রজন্ম জেগে উঠেছে, ভবিষ্যৎ নিয়ে আর নির্লিপ্ত নয়। ভোট তাদের অধিকার, সেই অধিকার নিশ্চিত করতেই রাজপথে তাদের এই জাগরণ। এজন্য চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই ভোট দিতে চান তারা।

পূর্বঘোষণা অনুযায়ী এদিন নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ‘তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সমাবেশ’ করে দলটির তিন সংগঠন-জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। ঢাকা, সিলেট, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের সমন্বয়ে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। তবে নয়াপল্টনের সমাবেশে দেশে বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীদের দেখা গেছে। আয়োজকরা জানান, এবারের তারুণ্যের সমাবেশের উপস্থিতি অতীতের সব সমাবেশকে ছাড়িয়ে গেছে। এ সমাবেশ থেকে নেতাকর্মীরা নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে নির্বাচনি প্রস্তুতি নেবেন।

এদিন বিকাল সাড়ে ৩টার পর সমাবেশ শুরু হলেও বেলা ১১টার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত তরুণ-তরুণীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নয়াপল্টনে জড়ো হন। যাদের বেশির ভাগই তরুণ-তরুণী। তাদের হাতে ব্যানার, ফেস্টুন, মাথায় জাতীয় পতাকা আর মুখে ছিল স্লোগান। ‘এই মুহূর্তে দরকার, নির্বাচিত সরকার’, ‘ভোটাধিকার ফিরিয়ে দাও, গণতন্ত্র ফেরত দাও’, ‘তারেক রহমান বীরের বেশে, আসবে ফিরে বাংলাদেশে’-সহ নানা আওয়াজে প্রকম্পিত হয় পুরো নয়াপল্টন এলাকা। সবুজ, হলুদ ও লাল রঙের ক্যাপ ও টি-শার্ট পরে তারা সমাবেশে যোগ দেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নয়াপল্টন এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। দুপুর ১২টার মধ্যে সমাবেশস্থল পেরিয়ে তারুণ্যের ঢল নামে বিজয়নগর, পুরানা পল্টন, জিরো পয়েন্ট, ফকিরাপুল, আরামবাগ, মতিঝিল, কাকরাইল, শান্তিনগর, মালিবাগ, মগবাজার, শাহবাগ, মৎস্যভবনসহ বিভিন্ন এলাকায়। এতে নয়াপল্টনের আশপাশের সড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অদূরবর্তী এলাকায় দেখা দেয় তীব্র যানজট। অনেকটা স্থবির সড়কে সাধারণ মানুষকে হেঁটে নিজ নিজ গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। স্লোগান আর গান-নাচে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠে নয়াপল্টনের পরিবেশ। সমাবেশে আসা নেতাকর্মীদের চাঙা রাখতে মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেন জাতীয় পর্যায়ের শিল্পীরা।

তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সমাবেশে ফ্রি চিকিৎসার আয়োজন করেন বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। বিকাল সাড়ে ৩টায় আনুষ্ঠানিকভাবে তারুণ্যের সমাবেশ শুরু হয়। ৪টায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

সকাল থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত তীব্র রোদ উপেক্ষা করে উপস্থিত নেতাকর্মীরা বক্তব্য শুনেন। ৪টার দিকে পল্টনসহ আশপাশের এলাকায় শুরু হয় বৃষ্টি। তবে নেতাকর্মীরা বৃষ্টিতে ভিজেই দীর্ঘ সময় উপস্থিত ছিলেন।

তারুণ্যের সমাবেশে আসা নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর বিভাগের সমন্বেয়ে সমাবেশ হলেও সারা দেশ থেকে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নিয়েছেন। তাদের কেউ এসেছেন একদিন আগে, কেউ ভোরে, কেউবা সকালে। বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে তারা তারুণ্যের সমাবেশে যোগ দেন। ঢাকঢোল বাজিয়ে নেতাকর্মীরা এসেছেন দলবদ্ধ হয়ে।

৫ শতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে নয়াপল্টনে তারুণ্যের সমাবেশে যোগ দেন বরিশাল জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব কামরুল ইসলাম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমাদের কর্মসূচি খুলনায় হয়েছে। সেখানে লাখ লাখ নেতাকর্মীর সমাগম ঘটেছে। ঢাকায় তারুণ্যের ডাকে বরিশালে বসে থাকতে পারিনি। তাই নেতাকর্মীদের নিয়ে লঞ্চ ও বাসে ঢাকায় এসে তারুণ্যের সমাবেশে যোগ দিয়েছে। আমাদের অধিকার আদায়ের সময় এসেছে। ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্য দিয়েই আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাই। চলতি বছরের মধ্যেই আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট দিতে চাই।

স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা কাজী মোকতার হোসাইন বলেন, এই সমাবেশে শুধু রাজনৈতিক কর্মসূচিই নয়। ছিল ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে গভীর চিন্তা, তারুণ্যের প্রত্যয় আর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দৃঢ়সংকল্প। তারুণ্যের সমাবেশ ঘিরে নয়াপল্টন যেন হয়ে উঠেছিল মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক। তরুণ প্রজন্মের এ উত্তাল উপস্থিতি নতুন করে উসকে দিচ্ছে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত। তরুণরা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায়। সেই লক্ষ্যে এ সমাবেশ থেকে আমাদের নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু হবে।

বগুড়া শিবগঞ্জে থেকে আসা অ্যাডভোকেট আব্দুল ওহাব বলেন, আমার উপজেলা থেকে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের সহস্রাধিক নেতাকর্মী নয়াপল্টনের সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। আমিও তাদের সঙ্গে এসেছি। আমরা চাই তারুণ্যের অধিকার। দীর্ঘ ১৬ বছর দেশের গণতন্ত্র বিলুপ্ত হয়েছে। তারুণ্যের এই সমাবেশে, তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে আমরা একত্র হয়েছি। তারুণ্যের সমাবেশ ব্যাপক জনসমাগমই প্রমাণ করে দেশের তরুণরা বিএনপির পতাকাতলে আছে। তারা তাদের ভোটের অধিকার ফেরত চায়।

ময়মনসিংহ থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মো. আল-আমিন বলেন, ভবিষ্যৎ যদি অনিশ্চিত হয়, তবে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। আমি আমার ভোটের অধিকার ফিরে পেতে এই সমাবেশে এসেছি। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করলেও আমরা ভোটের অধিকার ফিরে পাইনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার নামে নানা টালবাহানা করছে। রাজনৈতিক দলগুলো চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাইলেও সরকার সংস্কার ইস্যুতে সময়ক্ষেপণ করেছে। আমাদের তরুণসমাজের একটাই দাবি-সবার আগে ভোটাধিকার ফিরে দেওয়া হোক। নেত্রকোনো থেকে আসা কলেজছাত্রী শারমিন আক্তার বলেন, নারী হিসাবে আমরা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগী। এর বড় কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনির্বাচিত সরকার। আমি চেয়েছি সরাসরি রাজপথে এসে আওয়াজ তুলতে। দেশের এই অস্থিরতা দূর করতে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। এজন্য নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চাই।