
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করেছে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। নিম্নচাপের দরুন দেশের ১৭ জেলায় বিভিন্ন মাত্রায় জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা করেছে আবহাওয়া অফিস। জানা গেছে, গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত উপকূলের অন্তত ১০ জেলায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। সাগর ছিল উত্তাল। উপকূলীয় জেলাগুলোর বিভিন্ন এলাকা ছিল যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। নোয়াখালীর হাতিয়া, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ছিল বিচ্ছিন্ন। ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকা ছিল বিদ্যুৎবিহীন। রাজধানী ঢাকায় বর্ষণে জনভোগান্তি ছিল চরমে।
গতকাল গভীর সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। গতকাল চট্টগ্রামে সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। আনোয়ারা উপজেলার জুঁইদণ্ডী ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢোকে জোয়ারের পানি। পাহাড়ি ঢলে হাটহাজারী উপজেলার কয়েকটি সড়ক পানিতে তলিয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে চট্টগ্রামের বঙ্গোপসাগরবেষ্টিত সন্দ্বীপ উপজেলা। সাগর উত্তাল থাকায় উপজেলায় চলাচলের সব কয়টি নৌপথ বন্ধ রাখে প্রশাসন। ভোলার বিভিন্ন এলাকাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। গভীর নিম্নচাপটি বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করার সময় উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায়। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে নিম্নচাপটি বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করা শুরু করে।
তার প্রভাবে ১৭ জেলার বিভিন্ন স্থানে দুই থেকে চার ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে। গতকাল বিকেলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের বুলেটিনে বলা হয়, অমাবস্যা ও গভীর নিম্নচাপে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ দুই থেকে চার ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৮ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গতকাল দেশের চার সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর এবং নৌবন্দরগুলোকে ২ নম্বর সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। সেই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব ধরনের মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানিয়েছেন, আজ শুক্রবার ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ জায়গায় এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতিভারি বর্ষণ হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও এর কাছাকাছি এলাকায় থাকা গভীর নিম্নচাপটি আরো উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ এবং বাংলাদেশের খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম শুরু করে। এটি আরো উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে আজ (গতকাল) সন্ধ্যা নাগাদ উপকূল অতিক্রম শেষ করেছে। এরপর এটি ধীরে ধীরে দুর্বল হতে পারে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্রবন্দরগুলোর ওপর দিয়ে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
প্লাবিত সুন্দরবন, হরিণ উদ্ধার : বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে গত বুধবার রাত থেকে থেমে থেমে হালকা ও ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। নিম্নচাপের কারণে সাগর উত্তাল রয়েছে। সেই সঙ্গে অমাবস্যার কারণে জেলার সব নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্লাবিত হয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের করমজল, দুবলার চর, কটকা, কচিখালী, শেলার চরসহ বেশ কিছু এলাকা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে সুন্দরবনের করমজল পর্যটনকেন্দ্রসহ বনের বিস্তীর্ণ এলাকা দুই থেকে তিন ফুট উচ্চতায় প্লাবিত হয়। এর মধ্যে সুন্দরবনের শেলার চর টহল ফাঁড়ি এলাকা থেকে নদীতে ভেসে যাওয়ার সময় একটি হরিণ উদ্ধার করেছেন বনরক্ষীরা।
খুলনা অফিস জানায়, খুলনা মহনগরীসহ উপকূলীয় এলাকায় থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। বিশেষ করে জেলার উপকূলীয় কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটাসংলগ্ন নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি পায়। স্থানীয়রা জানিয়েছে, স্বাভাবিকের তুলনায় নদীগুলোতে পানি বেড়েছে। এ ছাড়া মহানগরীর নিম্নাঞ্চল হিসেবে পরিচিত নতুনবাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড এলাকায় রূপসা নদীর পানি উপচে প্রবেশ করছে।
কক্সবাজার : সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে কক্সবাজারের উপকূলজুড়ে সকাল থেকে থেমে থেমে বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। সাগরে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত করে দিয়েছে বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা। জোয়ারের পানিতে ডুবে মহেশখালী দ্বীপের ঘটিভাঙ্গা এলাকায় এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া লবণবোঝাই একটি বোটডুবিতে আটজন মাঝিমাল্লা নিখোঁজ হয়ে পড়েছেন। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে কুতুবদিয়া ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপের নিম্নাঞ্চল।
কুতুবদিয়া দ্বীপের আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের বায়ুবিদ্যুৎ এলাকাসহ তবলর চর ও কাজীরপাড়া এলাকার ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়েছে দ্বীপে। ওদিকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্বপাড়া এলাকাটি ব্যাপক প্লাবিত হয়েছে সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে। কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছাড় এলাকাসহ আরো কয়েক স্থানে জোয়ারের পানিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বরিশাল অফিস জানায়, বরিশালে বৃহস্পতিবার ভোররাত থেকে টানা বৃষ্টি হয়। বৈরী আবহাওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ সব রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে নদীবন্দরগুলোতে ২ নম্বর সতর্কসংকেত জারি করা হয়। টানা বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় দ্বীপজেলা ভোলা ও আশপাশের নদীবেষ্টিত এলাকাগুলোর সঙ্গে বরিশালের নৌযোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
বরগুনা প্রতিনিধি জানান, বরগুনার প্রধান নদ-নদী পায়রা-বিষখালীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহিত হয়। বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বরগুনার নদ-নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে সর্বোচ্চ ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহিত হয়েছে। বরগুনা সদর উপজেলার অংশে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। নদীর তীরবর্তী বড়ইতলী, পোটকাখালী, মাঝের চর, বাওয়ালকারসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পুরাকাটা ও বড়ইতলী ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে তলিয়ে গেছে।
ভোলা প্রতিনিধি জানান, সকাল থেকে সারা দিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন অবস্থায় ছিল। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। চরফ্যাশনের ঢালচর, চরপাতিলা, চরনিজাম, মনপুরার কলাতলীর চরসহ বেশ কয়েকটি চরের ২০ হাজারের বেশি বাসিন্দা পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, চাঁদপুর থেকে নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে বিআইডব্লিউটিএ। নৌপথে দুর্ঘটনা এড়াতে বিকেল ৫টা থেকে যাত্রীবাহী লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
মেঘনায় রড-সিমেন্ট বোঝাই ট্রলারডুবি : নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার মেঘনা নদীতে এমভি প্রাহিম নামের একটি মালপত্রবোঝাই ট্রলার ডুবে গেছে। এতে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। গতকাল বিকেলে উপজেলার চানন্দী ইউনিয়নের ভূমিহীন বাজারের পূর্ব-দক্ষিণে চর মহিউদ্দিন মার্কেটসংলগ্ন মেঘনা নদীতে ট্রলারডুবির এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ট্রলারের কেউ নিখোঁজ হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।