
জিয়াউর রহমান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বীর নায়ক। একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরীহ বাঙালিদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। সে সময় পুরো জাতি ছিল দিশাহারা। ঠিক সেই সময় ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে তৎকালীন মেজর জিয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘উই রিভোল্ট’ বলে বিদ্রোহ করেন। এরপর কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ইথারে ভেসে আসা ওই ঘোষণায় দিশাহারা জাতি উজ্জীবিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে তিনি ছিলেন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার মহান বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন।
জিয়াউর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপি ও এর অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠন আট দিনের কর্মসূচি নিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এ উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আজ শুক্রবার সকালে শেরেবাংলা নগরে জিয়াউর রহমানের মাজারে ফাতেহা পাঠ, স্বেচ্ছায় রক্তদান ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন বিএনপি নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ।
জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ার বাগবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মনসুর রহমান এবং মাতার নাম জাহানারা খাতুন ওরফে রানী। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। বিবিসি বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জরিপে ২০ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির মধ্যে জিয়াউর রহমান একজন।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা জিয়া
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তিনি বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদতবার্ষিকীতে আমি তার অম্লান স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি ও বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। শহীদ জিয়ার মহান আদর্শ, দর্শন ও কর্মসূচি আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহতকরণ, বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং দেশীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির রক্ষাকবচ।
মির্জা ফখরুল বলেন, জীবদ্দশায় জাতির চরম দুঃসময়গুলোতে জিয়াউর রহমান দেশ ও জনগণের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। মহান স্বাধীনতার বীরোচিত ঘোষণা, ’৭১-এর মরণপণ লড়াই এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণে তার অনন্য অবদান আমি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। ’৭১ সালের প্রারম্ভে সারা জাতি যখন স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, অথচ রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বিধা ও সিদ্ধান্তহীনতায় দেশের মানুষ দিশাহারা, ঠিক সে মুহূর্তে ২৬ মার্চ মেজর জিয়ার কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা সারা জাতিকে স্বাধীনতাযুদ্ধের অভয়মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। ফলশ্রুতিতে দেশের তরুণ, ছাত্র, শ্রমিক, যুবকসহ নানা স্তরের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হানাদার বাহিনীর ধ্বংসের শক্তিকে প্রতিহত করে দেশবাসী বিজয়ের দিকে ধাবিত হয়। বিজয়লাভের পর দেশীয় শাসকগোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক দমনমূলক শাসন ও শোষণের জাঁতাকলে মানুষের প্রাণ হয় ওষ্ঠাগত, দেশের মানুষের নাগরিক অধিকারগুলো হরণ করা হয়, গণতন্ত্রকে দেওয়া হয় মাটিচাপা। চালু করা হয় নির্মম একদলীয় দুঃশাসন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতাকে উচ্ছেদ করা হয় স্বেচ্ছাতন্ত্রের আক্রমণে। একদলীয় প্রভুত্ববাদের অধীনতার নাগপাশে বন্দি করা হয় সারা জাতিকে। চলমান অরাজকতার সেই সময়ে সিপাহী-জনতার মিলিত শক্তির মিছিলে জিয়াউর রহমান জাতীয় রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হন। রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেই ফিরিয়ে দেন বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং সংবাদপত্রসহ নাগরিক স্বাধীনতা। গণতন্ত্রের ঐতিহাসিক সার্থকতা নিশ্চিত করেন। শুরু করেন উৎপাদনের রাজনীতির মাধ্যমে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী করা। বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির আখ্যা থেকে খাদ্য রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করেন। ব্যক্তিজীবনেও দুর্নীতি, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও সুবিধাবাদের কাছে আত্মসমর্পণকে তিনি ঘৃণা করতেন। তার অন্তর্গত স্বচ্ছতা তাকে দিয়েছে এক অনন্য ঈর্ষণীয় উচ্চতা। তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের কারণেই বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথচলা শুরু হয় এবং অর্থনীতি মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
ফখরুল আরো বলেন, জনমনে ভয় আর আতঙ্ক সৃষ্টি করে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছিল। জনগণের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল। নির্যাতন ও জুলুম ছিল পতিত ফ্যাসিবাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার একমাত্র হাতিয়ার। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে এক মাফিয়া অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করেছিল পরাজিত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠী। এমতাবস্থায় হারানো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ছাত্র-জনতাসহ সব গণতন্ত্রকামী মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ঘটায়। ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়কে এখন পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হবে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, জনগণের কাছে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, পরমতসহিষ্ণুতাসহ সব নাগরিক অধিকার নির্ভয়ে প্রয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে গণতন্ত্র স্থায়ী রূপ লাভ করে। জাতীয় জীবনের সব সংকট, সংগ্রাম ও বিনির্মাণে শহীদ জিয়ার প্রদর্শিত পথ ও আদর্শ বুকে ধারণ করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থ, বহুমাত্রিক গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকার সুরক্ষায় ইস্পাতকঠিন গণঐক্য গড়ে তুলতে হবে।