
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বারবার বলছে আগামী ডিসেম্বর (২০২৫) থেকে জুন (২০২৬)-এর মধ্যে নির্বাচন। সর্বশেষ ২৪ মে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি এবং ২৫ মে ইসলামী আন্দোলন, এলডিপি, সিপিবি, বাসদ, গণঅধিকার পরিষদ, এবিপার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্সা পার্টি, নাগরিক এক্য, গণসংহতি আন্দোলনসহ ২০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ৩০ জুনের পর একদিনও ক্ষমতায় থাকবেন না অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের পরিষ্কার বক্তব্যের পরও বিএনপি সন্তুষ্টু হতে পারছে না। তারা বারবার বলছে, আগামী ডিসেম্বর (২০২৫) মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে এবং অনতিবিলম্বে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। নইলে সরকারের প্রতি তাদের যে সমর্থন ও সহযোগিতা, সেটা অব্যাহত রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
মঙ্গলবার (২৭ মে) বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন থেকে বলা হয়েছে তিনিব বলেন, ‘গত ২৪ ও ২৫ মে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের মাধ্যমে সরকারের যে বক্তব্য পাওয়া গেছে তাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো রোড ম্যাপের ঘোষণা না থাকায় বিএনপি হতাশ। ডিসেম্বর ২০২৫ এর মধ্যে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি জানাচ্ছি। এর অন্যথা হলে জনগণের দল হিসেবে বিএনপির পক্ষে এই সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।’
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের এই ‘চরম বার্তা’র পর সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে- রোডম্যাপে কী আছে? কেন রোডম্যাপ চায় বিএনপি? অন্তর্বর্তী সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে কি আস্থা রাখতে পারছে না বিএনপি? আস্থার সংকটটা কোথায়?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রোববার (২৭ মে) রাতে বিএনপির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাদের ভাষ্যমতে, রোডম্যাপ মানেই হচ্ছে শিডিউল। সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০২৬ সালের জুনে নির্বাচন হলেও নির্বাচন কমিশনকে ৯০ দিন সময় দিতে হবে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি-মার্চ মসের মধ্যেই নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করতে হবে। সেই তফসিল ঘোষণার নির্দিষ্ট তারিখটা সরকার প্রধানের মুখ থেকে শুনতে চায় বিএনপি। কিন্তু, সরকার সেটা না করে বারবার একই কথা বলছে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন।
বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশ দেওয়ার দায়িত্বটা সরকারের। এর পরের কাজটুকু নির্বাচন কমিশনের এবং নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলোর। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনের ব্যয় নির্বাহের জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে বাজেট প্রণয়ন, সরকারের পক্ষ থেকে অর্থের যোগান, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ— সবকিছু মিলে একটা বড় সময় হাতে নিয়ে কাজ শুরু করতে না পারলে এত বড় কর্মযজ্ঞ সফল করা কঠিন। সেক্ষেত্রে এখনো যদি সরকারের পক্ষ থেকে রোডম্যাপ ঘোষণা করা না হয়, তাহলে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হবে না। এ কারণেই সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট একটা রোডম্যাপ দাবি করে আসছে বিএনপি।
এ প্রসঙ্গে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সারাবাংলাকে বলেন, “একটা রোডম্যাপ বা শিডিউল ঘোষণা না দিলে তো রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের মনোযোগ দিতে পারবে না। শিডিউল ঘোষণা হলে নানা রকম জোট হতে পারে, অ্যালায়েন্স হতে পারে। কিন্তু, নির্দিষ্ট রোডম্যাপ বা শিডিউল ঘোষণা না করে ওই মুখস্ত গল্প বলে বেড়াচ্ছে ‘ডিসেম্বর থেকে জুন’, ‘ডিসেম্বর থেকে জুন’। জুন তো এ দেশে বর্ষাকাল। আরবান এলাকার মানুষ না হয় আসল ভোট দিতে। তুমি রুরাল এলাকার মানুষকে ভোট দিতে দিবা না?’’
দলীয় সূত্রমতে, দ্রুত রোডম্যাপ চাওয়ার পেছনে ‘আস্থার সংকট’ও কাজ করছে বিএনপির মধ্যে। অন্তর্বর্তী সরকার এবং সরকার প্রধানকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেলেও সরকারে থাকা বেশ কয়েকজন উপদেষ্টার বক্তব্য-বিবৃতি, বিএনপির প্রতি বিষোদগার, তাদের আচার-আচরণ, কথা-বার্তার কারণে বিএনপিতে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে দলটির শীর্ষ নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কথায় আস্থা রাখতে পারছে না। তাছাড়া ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলের প্রতি সরকার ও সরকারের প্রধানের ‘অতিরিক্ত দরদ’, ‘বাড়তি যত্ন’ এবং ‘মনোযোগ’ নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে বিএনপির মধ্যে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈঠকে অসংখ্য নিবন্ধিত দলকে উপেক্ষা করে অনিবন্ধিত নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিকে ডাকা, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের সময় পুরোনো অনেক রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে বারবার এনসিপিকে ডাকা, ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এনসিপি আলাদা গুরুত্ব দেওয়া— ইত্যাদি বিষয়গুলো পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ধরে নিয়ে দ্রুত এর একটা সমাধান চাচ্ছে বিএনপি। আর নির্বাচনি রোডম্যাপকেই তারা একমাত্র সমাধান মনে করছে। কারণ, নির্বাচনি রোডম্যাপ বা শিডিউল ঘোষণা হলে সরকার, নির্বাচন কমিশন বা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করার সুযোগ থাকবে না। তখন যার যার সাংগঠনিক শক্তি ও জনসমর্থনের জোরেই সবকিছু মোকাবিলা করতে হবে।
দলীয় সূত্রমতে, আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে বিএনপি। সেটা হলো— সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামানের চাকরির মেয়াদ। আগামী বছর জুনে অবসরে যাবেন ওয়াকার উজ জামান। নানা উছিলায় আগামী বছর জুন মাসটা পার করতে পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর থেকে সেনাবাহিনীর চাপটা সরে যায়। তখন শেখ হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া ৪ বছর ৩ মাস মেয়াদ অন্তবর্তী সরকার এনজয় করতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে গয়েশ্বরচন্দ্র রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) যেহেতু সেনাপ্রধানকে প্রতিপক্ষ মনে করছে, সেহেতু তিনি থাকা অবস্থায় নির্বাচন দেওয়াটা নিরাপদ মনে নাও করতে পারে। কোনোরকম সেনাপ্রধানের মেয়াদ পার করতে পারলে, তারা হয়তো তাদের অন্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারে।’
‘এসব দিক মাথায় রেখে আমরা তো আর চুপ করে বসে থাকতে পারি না। ১৬ বছর ধরে নির্বাচন চেয়ে আসছি। এখন চাচ্ছি শিডিউল। সেটা দিয়ে দিলেই তো হয়’— বলেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।