Image description

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের যারা পদত্যাগ করেছে, যারা বিদ্রোহী বা বিপ্লবী ছাত্রলীগ ছিল, তাদের একটা অবদান আছে। তারা বের না হলে এই আন্দোলন কঠিন হতো।

একদফার যে সিদ্ধান্ত জনগণই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিয়েছিল বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

শনিবার (১৫ মার্চ) রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় যাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার ‘জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরতে গিয়ে এসব কথা বলেন।  

নাহিদ বলেন, ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে জনগণই স্বতঃস্ফূর্তভাবে একদফার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেদিন শহীদ মিনার থেকে এক দফার বাইরে অন্য কিছু করার সক্ষমতা আমাদের ছিল না।

জুলাইয়ের ঘটনা তুলে ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘একদফার ঘোষক’ নাহিদ ইসলাম বলেন, অল্প কথা বা একটা খণ্ডিত ঘটনা বললে অনেক ধরনের ব্যাখ্যা আসে। কার অবদান বলা হলো, কারটা বাদ গেল, বা কারটা বেশি বলা হলো- এটা একটা টেনশনের বিষয়। জুলাই নিয়ে আমি গত ৭ মাসে কম বলার চেষ্টা করেছি। যারা আন্দোলনে ছিলাম, তাদের এখনো কথা বলার সময় আসেনি। আন্দোলন পরিকল্পিত ছিল নাকি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল- অভ্যুত্থানের পরে এটি নিয়ে বিতর্ক সামনে এসেছে। আমি এই দুটিকে বিরোধাত্মক মনে করি না। আন্দোলন একটি পরিকল্পনার মধ্য দিয়েই এগিয়েছে। আবার এখানে পরিকল্পনার বাইরেও ঘটনাপ্রবাহ ঘটেছে। মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংযুক্ত করতে হবে, এটাই শুরু থেকে আন্দোলনের মূল পরিকল্পনা ছিল।

তিনি বলেন, আমাদের একটি ছাত্র সংগঠন ছিল গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি। সংগঠনটির আহ্বায়ক ছিলেন ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ আখতার হোসেন। কিন্তু আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল আখতার হোসেন সামনে থাকবে না। এমনকি আমারও সামনে আসার কথা ছিল না। কথা ছিল, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসিফ মাহমুদ, আবু বাকেররা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু যেহেতু এটি কোটা সংস্কার আন্দোলন, চাকরিপ্রত্যাশী আমার ব্যাচের অনেকেই আন্দোলনে এসেছে; তাই আমাকেও আসতে হয়েছে। আখতার ভাই, মাহফুজ ভাই পেছনে থেকে কাজ করেছেন। ১৭ তারিখ আখতার ভাই গ্রেপ্তার হন। আমরা যেহেতু বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলাম, তাই আন্দোলনের একটি সংকট মুহূর্ত আসবে, হামলা-নিপীড়ন আসবে, এটা আমরা জানতাম। তখন আখতার ও মাহফুজ ভাই পেছন থেকে এসে ভূমিকা রাখবেন।

নাহিদ বলেন, আমাদের আরেকটি পরিকল্পনা ছিল, আন্দোলনটা ছাত্রশক্তি থেকে বের হয়ে করতে হবে। তখন আমরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ করি। আমরা পরিসর বিস্তৃত করি। সেই ধারাবাহিকতায় হাসনাত, সারজিস, মাহিনরা এসে যুক্ত হয়। আমি ইতিহাসটা কম বলতে চাই। যেহেতু এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান এবং নানা মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। আমরা নিজেরাও জানি না, কোথা থেকে কত সাপোর্ট এসেছিল। আমি বললে সেটা আমার গল্প হবে। আসিফ মাহমুদ যে বই লিখেছে, এটা তার গল্প হবে। এভাবে আমাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা গল্প আছে।

নাহিদ বলেন, আমরা যখন বলেছি, তখন এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক গল্প। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসার শিক্ষার্থীরা নেমে এসেছিল। আমরা এখনো জানি না, কুমিল্লায়, নরসিংদীতে, ঢাকার বাইরে কীভাবে আন্দোলনটি সংগঠিত হয়েছে। তাদের গল্পগুলো আরও বেশি করে আসা দরকার। আন্দোলনে ১৯ তারিখ থেকে ১ তারিখ পর্যন্ত আমরা (নাহিদ, আসিফসহ ৬ সমন্বয়ক) কিন্তু মাঠে ছিলাম না। ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন বন্ধ হয়ে যায়, আন্দোলনের নেতৃত্ব সাধারণ জনগণের হাতে চলে যায়। আমরা যখন ডিবি অফিসে ছিলাম, তখন রিফাত রশীদরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি নেতৃত্বের জায়গা নেয়।

আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ততা রাখার চেষ্টা ছিল
অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ বলেন, আমাদের আরেকটি ব্যাপার ছিল আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ততা রাখতে হবে। মানুষও যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে, তারা কীভাবে কর্মসূচি করবে। মানুষের জনমত যাচাইয়ে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের কাছে ছিল। আমরা তখন মূলত আন্দোলনকে সহযোগিতা করব। আমরা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেব না। আমরা সমন্বয় করব। সেখান থেকেই সমন্বয়ক শব্দটা এসেছে।

তিনি বলেন, ১৬ তারিখ আমরা বুঝেছি, এই আন্দোলন সরকার বিরোধী আন্দোলনের দিকেই যাবে। কারণ এই সরকারের হাতে রক্তের দাগ লেগে গেছে। সেদিন ৬ জন মানুষকে হত্যা করা হয়, তার আগেরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের হামলা করা হয়। এরপর ৯ দফা দেওয়া হলো; সেখানেই এক দফার বার্তাটা ছিল। কিন্তু আমরা শুরুতেই একদফায় যাইনি। আমরা ভেবেছি, সরকার পতন বা একদফার বিষয়টি জনগণের কাছ থেকে আসতে হবে। আমরা তখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেব এবং এমনই হয়েছিল।

এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, ৩ তারিখ আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল। শহীদ মিনারে এক দফার বাইরে অন্যকিছু করার সক্ষমতা আমাদেরও ছিল না। গণভবন ঘেরাওয়ের কোনো আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি ছিল না। কর্মসূচি ছিল ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ অর্থাৎ ঢাকায় আসতে হবে। কিন্তু ঢাকায় এসে কী করবে, এটা জনগণই ঠিক করবে। মানুষই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা গণভবনে যাবে। আমরা তাদের সঙ্গে গিয়েছি। আমাদের কাজ ছিল এতটুকুই।

তিনি আরও বলেন, আন্দোলনে নানাবিধ অংশীজন ও সাধারণ মানুষ থেকে সহায়তা এসেছে। ছাত্রশিবির, ছাত্রদল, বাম সংগঠনগুলো; তাদের একটা ভূমিকা ছিল এবং একটা বোঝাপড়া ছিল। ক্যাম্পাসগুলোয় আমাদের বেশিরভাগ আন্দোলনে ভণ্ডুল হয়ে যায়, নেতৃত্বের একটি কাড়াকাড়ির কারণে বা আন্দোলনের ব্যানারবাজির কারণে। এখানে তা ছিল না। সব ছাত্রসংগঠন তাদের মতো করে লোকবল পাঠিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটা অলিখিত সমঝোতা ছিল। বিএনপি শুরু থেকেই বলেছে, এটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন; আমাদের নৈতিক অবস্থান আছে। তারা কখনই বলেনি, এটা তাদের আন্দোলন।

নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা বলেছি, এটা ছাত্রদের আন্দোলন। তবে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত কেউ এই আন্দোলনে আসতে পারবে না, এমন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো শর্ত আমরা আরোপ করিনি। ২৩ তারিখের সংবাদ সম্মেলনে আমাদেরকে ডিজিএফএই থেকে বলা হয়েছিল, এটা বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন এবং সব অগ্নিসন্ত্রাস তারা করছে-এমনটা বলতে। সংবাদ সম্মেলন থেকে আমি বলি-বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, আমরা তার নিন্দা জানাচ্ছি। এখানে একধরনের মিথস্ক্রিয়া ছিল। ৫ তারিখ পর্যন্ত আমরা অনেক ভুল করলেও তাদের সঠিক হয়েছে। এটা আল্লাহর এখানে সহায়তা ছিল। এটাকে ‘মুনসুন রেভ্যুলিউশন’ বলা হয়, কিন্তু এমন বৃষ্টি হয়নি যে মানুষ রাস্তায় নামতে পারবে না। আমরা দলমত নির্বিশেষে সবার সমর্থন পেয়েছি। এই আন্দোলনে ছাত্রলীগের যারা পদত্যাগ করেছে, বিদ্রোহী বা বিপ্লবী ছাত্রলীগ ছিল তাদের একটা অবদান আছে। তারা বের না হলে এই আন্দোলন টাফ (কঠিন) হতো। আন্দোলনে ব্লকেড কর্মসূচির একটি ভূমিকা ছিল।

তিনি আরও বলেন, আন্দোলনের বিষয়ে একটা সাধারণ বক্তব্য শোনা যায়, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় এবং যখন হামলা নিপীড়ন হয়, তখন মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে নেমে আসে। এটা সত্য। কিন্তু এখানে অনেকগুলো ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলেই একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। ব্লকেড কর্মসূচির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয়েছে এবং ঢাকা শহরের মধ্যে একটি গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। আমরা যখন একটি একটি করে ব্যারিকেড ভেঙে আগাচ্ছিলাম। মানুষের ভিশন বাড়ছিল, আমরা গণভবন পর্যন্ত যেতে পারি। ব্যারিকেড ভাঙার সাহস ব্লকেড কর্মসূচি থেকে হয়েছে।

আন্দোলনে কীভাবে সংগঠিত হয়েছে, তা তুলে ধরে নাহিদ ইসলাম বলেন, মাঠ দেখত আসিফ, বাকের ও রিফাতরা। আন্দোলনের একটা পর্যায়ে আমি ফিল্ড থেকে অনেক বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। আমার ওপরের অনেক যোগাযোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে থাকতে হয়েছিল। সেখানে আখতার, মাহফুজ এবং পরে নাসির ভাই এসে যোগ দেন। আমরা সবসময় যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি, তা নয়। আসিফ অনেক সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের ১৫ জুলাইয়ের কর্মসূচি ১৪ জুলাই রাত তিনটায় ঘোষণা হয়েছিল। আসিফ যাদের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব, করে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে। কেউ কোনো সিদ্ধান্ত দিলে আমরা তা মেনে নিয়েছি। সেই সিদ্ধান্ত সবাই বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি। লংমার্চ একদিন এগিয়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তও আসিফের। আমাকে কেবল জানানো হয়েছিল। সরকার গঠনের সময় আসিফ খুব শক্তভাবে বলেছে, ছাত্রদের সরকারের অংশ হতে হবে। আমার একটু নিমরাজি ছিল। সরকারে যাব কী যাব না। কারণ, আমাদের মাঠটাও দরকার। তখন আসিফ শক্তভাবে বলে।

নাহিদ আরও বলেন, আন্দোলনে নেতৃত্ব আমরা তুলব না, এটা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। একটা সময় আমাকেই গণমাধ্যম মোকাবিলা করতে হয়েছে। মাঠের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিত আসিফ, বাকের ও রিফাতরা। রাজনৈতিক যোগাযোগগুলো ওরা করত। আমি জানতামও না কার সঙ্গে কী কথা হয়েছে। ইচ্ছে করেই জানতাম না। কারণ সব তথ্য আমার কাছে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ। সেসময়ের সরকার বা গোয়েন্দা সংস্থা ভেবেছিল, আমি যেহেতু ফেস এবং ছাত্রশক্তির সেক্রেটারি; আমাকে ধরলেই বোধহয় সব পাওয়া যাবে। আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তারা প্রচণ্ড হতাশ হয়। কারণ আমার কাছে আসলে কোনো তথ্য নাই। তারা আমাকে মারধর করে, আমার মোবাইল ফোন বিশ্লেষণ করে তারা দেখছে, আমার কাছে আসলেই অনেক তথ্য নাই। আমার সঙ্গে বিএনপির কোনো নেতার কোনো কথাই হয়নি। ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের নেতাদের সঙ্গেও সেভাবে কথা হয়নি। কারণ যোগাযোগগুলো ওরা করত। পরে ওরা আসিফকে তুলে নিয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, আমাদের গল্প কেউ যেন ভেবে না নেয়, এটাই জুলাই অভ্যুত্থানের গল্প। প্রত্যেকটা মানুষের গল্প জুলাই অভ্যুত্থানের গল্প এবং সেই গল্প এখন আমাদের আরও বেশি করে শোনা উচিত। আমি যদি কখনো বই লিখি, তাহলে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবে আমাদের ৫-৭ বছর; যেটার মধ্য দিয়ে আমরা বড় হয়েছি। আমাদের মধ্যে রাগ-ক্ষোভগুলো জন্ম নিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতেরও যেমন ১৫ বছরের একটি লড়াইয়ের ইতিহাস আছে। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আমাকে প্রভাবিত করেছে। এবারের আন্দোলনটা অনেকটাই সে আন্দোলনের মতো করে হয়েছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও এভাবে ব্লকেড হয়েছে। আমাদের মাথায় ছিল স্কুল কলেজের সবাই বের হয়ে আসবে। আমার মাথায় সে দৃশ্য সবসময় হিট করত। এই প্রেক্ষাপট আমরা তৈরি হয়েছি।