
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, ব্যাংক খাতে যে সমস্যা সবাই তা ভালো করে জানে। কিছু ব্যাংকে সুশাসনের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও কয়েকটা ব্যাংকে বাঁচানো সম্ভব নয়, এটা সত্য। কিছু ব্যাংকের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ কিছু কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮৭ শতাংশ হয়ে গেছে। এটার জন্য একটি পরিবার পুরোপুরি দায়ী। কারণ ১০০ টাকা লোন দেওয়া হলে ৮৭ টাকা এক পরিবারবে দেওয়া হয়েছে। এভাবে ব্যাংক খাতকে লুট করা হয়েছে।
মঙ্গলবার ঢাকায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘অর্থনীতির পুনর্গঠন সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের সুপারিশ’ শীর্ষক দুই দিনের কর্মশালার শেষ দিনে ‘ব্যাংকিং সেক্টরে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি এবং শাসন’ শীর্ষক অধিবেশনে তিনি এই কথা বলেন।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথি ছিলেন ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, বিএবির চেয়ারম্যান আবদুল হাই সরকার, আইসিবির চেয়ারম্যান আবু আহমেদ।
গভর্নর বলেন, ব্যাংক খাতকে উদ্ধারের জন্য ব্যাংক রেজুলেশন অ্যাক্ট করা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকেই সমস্যা আছে। তাদের মনিটরিং করা হচ্ছে। বেশকিছু সরকারি ব্যাংকেরও প্রচুর সমস্যা আছে।
তিনি আরও বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) যাতে ব্যাংকিং খাতে কোনও প্রভাব ফেলতে না পারে সেজন্য নিয়মকানুন তৈরি করা হচ্ছে। এফআইডি ব্যাংকিং খাতে কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। রাজনৈতিক চর্চা শুরু হলে যাতে হস্তক্ষেপ কম হয়। এফআইডির মতো প্রতিষ্ঠান যাতে এখানে কর্তৃত্ব না করতে পারে।
এসময় গভর্নরের বক্তব্যের বিরোধিতা করে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অনেক গুণী ব্যক্তি। কিন্তু তার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, ওটা দুর্বল ব্যাংক, ওটা সবল ব্যাংক- যতদিন এসব বলা বন্ধ না করবেন ততদিন ব্যাংকিং সেক্টর ঠিক হবে না। উনি অনেক কিছুই ভালো করছেন। আমাকে তারাই আবার এ ব্যাংকে পাঠিয়েছেন।
দিনি বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে আমি যখন চলে আসি তখন সেটি ইসলামী ব্যাংক থেকেও ভালো ব্যাংক ছিল। এখন সেটি সবচেয়ে খারাপ ব্যাংক এটি আমিও মানি। অর্থনীতিবিদরা কেবল বলেন, ব্যাংক বন্ধ করে দেন, আমি বলি অর্থনীতিটাকেই বন্ধ করে দেন।
‘আমাকে অর্থনীতিবিদ বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক একটু বেশি কথা বলে। কিছু বললেই বলে, টাকা ছাপিয়ে দেব।’ যোগ করেন তিনি।
জিডিপির তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, জিডিপির সঠিক হিসাব আসলে কত। এখন শুনছি ৫০০ বিলিয়ন ডলার ছেড়ে যাবে। আবার একটি পত্রিকায় বলা হয়েছে এটি ৩৪০ বিলিয়নের বেশি হবে না। কত টাকা ছাপাতে হবে, কত টাকা ছাপানো আছে- এটা আমরা কেউ জানি না। তথ্য বলছে, জিডিপির ৩ শতাংশ টাকা ছাপানো আছে। কিছু টাকা চোরাকারবারি হচ্ছে, বিদেশে চলে যাচ্ছে, শিকলবন্দি আছে। আসলে আমাদের ইকনমির সাইজ কত এটা কেউ জানে না।
মিন্টু বলেন, মুদ্রানীতি কারা করে সেটিও আমরা জানি না। বাংলাদেশ ব্যাংক যখন বন্ড বিক্রি করে, তখন সেটি মানি ক্রিয়েশন হলো? সেটি তো টাকা উঠানো হলো। আমাদের কাছে মাঝে মাঝে নিজেদের বোকা মনে হয়।
ব্যাংকের টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের তথ্যের অসংগতি আছে উল্লেখ করে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের যে অবদান এই বইটার (টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন) ভেতরে তা অস্বীকার করা হয়েছে। তাছাড়া আমাদের বুঝতে হবে, এখন যদি বলেন কোনো বিনিয়োগ লাগবে না, তাহলে ভালো।
তিনি বলেন, একটা দেশে যদি বিনিয়োগ না বাড়ে সে দেশে কর্মসংস্থান কিভাবে হবে। প্রতিবেদনে একটি বিষয় এড়িয়ে গেছে। সেটি হলো ব্যাংকগুলো শর্টটার্ম সঞ্চয়ের বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়। অন্য দেশে এটি কম, ভারতেও এটি কমে গেছে। যতদিন আপনি পুঁজিবাজার ঠিক না করবেন, দীর্ঘমেয়াদের পুঁজি না আনতে পারবেন, ততদিন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেই ঋণ নিতে হবে। আর যদি বাণিজ্যিক ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি সঞ্চয়ের বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয় এ খেলাপি সমস্যা কোনোদিন যাবে না।
সবাই লুণ্ঠনে ব্যস্ত অভিযোগ করে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, আমরা এত সমস্যা কার কাছে বলব। যার কাছে বলি তারাই লুণ্ঠনে ব্যস্ত। গত ২০-২৫ বছর এসব দেখে এসেছি।
রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া কোনো উপায় নেই উল্লেখ করে এ রাজনীতিবিদ আরও বলেন, এ বইতে এসব সমস্যার সমাধান হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত এদেশে রাজনৈতিক সংস্কার না হবে, না আইনশৃঙ্খলা পরিস্খিতি ঠিক হবে, না বিনিয়োগ বাড়বে, না প্রবৃদ্ধি হবে। বৈষম্য দূরীকরণ বা সম্পদ বণ্টনের দায়িত্ব কার- সেটি তো রাজনীতিবিদদের।
সংস্কার প্রস্তাব দিয়ে জেলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে উল্লেখ করে মিন্টু বলেন, গত ২০ বছর ধরে সংস্কারের এসব কথা বলে আসছি। একবার সংস্কারের কথা বলে জেলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। দুইবার জেলে গিয়েছি, আর জেলে যেতে চাই না। বয়স হয়ে গেছে। আপনারা (সিপিডি) সংস্কার সংস্কার করেন, আর আমরা রাস্তাঘাটে খামাখা দৈনিক বক্তৃতা করি।