Image description

Kai Kaus(কাই কাউস)

 
“... স্থান - বঙ্গভবন। ১৬ নভেম্বর, ১৯৮১ সাল। জাস্টিস সাত্তার জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, আমাদের সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, এর বেশি তাদের কিছু করার নেই। কথাগুলো বললেন ১৫ নবেম্বরে বিপুল ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জাষ্টিস সাত্তার। কতিপয় চক্রান্তকারীর হাতে নিহত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সার্থক উত্তরসূরি জাস্টিস সাত্তার রাষ্ট্র পরিচালনায় যে সাহসিকতা ও দৃঢ় মনােবলের পরিচয় দিয়েছেন তা চোরাপথে ক্ষমতা দখল করতে ওঁৎ পেতে থাকা মহলের কাছে ছিল একেবারেই অনভিপ্রেত।
 
প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাহাদাতের পর থেকে উচ্চাভিলাষী সামরিক বাহিনী প্রধান বক্তৃতা বিবৃতির মারফত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অধিকার দাবি করতে শুরু করেন, যা বিভিন্ন মহলে বিরূপ প্ৰতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
 
প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাহাদাতের পর জাষ্টিস সাত্তার সর্বসম্মতিক্রমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তাঁর দায়িত্ব পালন করতে শুরু করলে, সঙ্গত কারণেই উচ্চাভিলাষী মহলে আতঙ্ক দেখা দেয়।
 
প্রেসিডেন্ট জিয়ার অবর্তমানে মহল বিশেষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে অনেকেই ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকার করতে মাঠে অবতীর্ণ হন। কিন্তু শহীদ জিয়ার সুযোগ্য উত্তরসূরিদের সুদৃঢ় মনােবল ও জাতীয় ঐক্য রক্ষায় তাঁদের সুস্পষ্ট ভূমিকা ঐ সব সুযোগ সন্ধানীদের হীন প্রচেষ্টার পথে অন্তরায় হিসেবে দেখা দেয়। নানা অজুহাতে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মহল বিশেষের অচলাবস্থা সৃষ্টির বহু অপচেষ্টার কথা দেশবাসী আজও ভুলে যায়নি।
 
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে জাস্টিস সাত্তার ব্যাংক ও শিল্প ক্ষেত্রে অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টাকে দৃঢ় হস্তে দমন করে ইতিহাসে এক উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। কয়েক হাজার ধর্মঘটী ব্যাংক কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ঐ সময় দেশের অর্থনৈতিক কাঠামাে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়তো বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট জাষ্টিস সাত্তার তাঁর কতিপয় উপদেষ্টাকেও হতাশ করেন। তাঁদের কেউ কেউ জাষ্টিস সাত্তারকে বলেছিলেন নির্বাচন সামনে রেখে ধর্মঘটরত ব্যাংক কর্মচারী ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে এতো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত হবে না। তিনি এ ধরনের মনোভাব পোষণকারী দলের এক নেতাকে জানান, যদি তিনি (জাষ্টিস সাত্তার) তাঁর সুচিন্তিত সিদ্ধান্তানুযায়ী সরকার পরিচালনা করতে বাধার সম্মুখীন হন, তবে অন্য কোন ব্যক্তিকে যেন দলীয় প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেয়া হয়।
 
এ ছাড়া শোনা যায় তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান ১৯৮১ সালের ১৫ নবেম্বর প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের দিন কয়েক আগে তাঁর অপর দু’জন সহযোগীসহ ভারপ্রাপ্ত প্রসিডেন্ট সাত্তারের সাথে বঙ্গভবনে সাক্ষাৎ করে বলেন, জাষ্টিস সাত্তার যেন নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করেন, কারণ তাঁদের খবরানুযায়ী জাষ্টিস সাত্তারের জয়ের আশা বড় ক্ষীণ। সেনা প্রধান নাকি তাঁর এ ধারণার যৌক্তিকতা কিছু কাল্পনিক তথ্য দিয়ে প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। জাষ্টিস সাত্তার শক্তিধর সেনাপতিকে জানান, নির্বাচন হবেই এবং তিনি হেরে গেলে বিজয়ী প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বঙ্গভবন থকে বিদায় নেবেন। তবে তিনি সেনাপতিদের স্মরণ করিয়ে দেন, নির্বাচন স্থগিতের কোন চাপের কাছে তিনি নতি স্বীকার করবেন না। বিফল মনোরথ হয়ে ব্যারাকে ফিরে যান সেনাধ্যক্ষরা। কিন্তু তাঁরা তাদের কাজ চালিয়ে যান নিরলসভাবে। তাঁদের প্রচেষ্টা, কি করে লোক চক্ষে হেয় করা যায় সরকারকে।
 
নির্বাচন হয়ে গেলে সরকারের ভিত আরও শক্ত হবে এ ভয়ে ভীত হয়ে সরকারবিরোধী তৎপরতা চক্রান্তকারীরা আরও বাড়িয়ে দেয়।
 
উল্লেখ্য, ডঃ কামাল হােসেন, জেনারেল ওসমানী, মেজর জলিল, ডঃ আলিম আল রাজী, মওলানা আবদুর রহিম, মোহাম্মদ তোয়াহাসহ নয় জন পার্টি নমিনী নির্বাচনে অংশ নেয়। এছাড়া ছিল প্রায় ২০ জন স্বতন্ত্র প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী।
 
বঙ্গভবনের অঙ্গনে নির্বাচনােত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য আজো চােখে ভসে ওঠে। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জাস্টিস সাত্তার অভ্যাগতদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। আর অন্য এক কোণায় তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন। তাঁর কথার প্রতিপাদ্য বিষয় সাংবাদিক সম্মেলনে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব সম্পর্কে জাষ্টিস সাত্তারের মন্তব্য। সেনাপ্রধান দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের বললেন, এ দেশের সৈনিকরা মার্সিনারী সৈন্য নয়, এরাও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের ন্যায্য শেয়ার চায়। বেশ কিছুদিন আগ থেকে তিনি তাঁর এ বক্তব্য বিভিন্ন স্থানে বলে বেড়াচ্ছিলেন। রাজনীতি সচেতন জনগণ এর মধ্যে অশনি সঙ্কেতের ইঙ্গিত দেখতে পান।
 
 
তখন একটি গুজব বাজারে কোন এক মহল থেকে ছড়ানাে হয় যে, সেনাপ্রধান ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যেতে আগ্রহী।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী প্রধানকে এ গুজবের সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করি। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি এ ব্যাপারে আমার মন্তব্য জানতে চান। আমি তাঁকে বলি, এ ব্যাপারে আপনি কি ভাবছেন? আমার মত কি এ ব্যাপারে, পুনরায় জানতে চাইলেন সেনাপ্রধান। আপনি কি চান, তাঁর সরাসরি প্রশ্ন আমার কাছে। বললাম, আই ওয়ান্ট এ গুড গভর্নমেন্ট অ্যান্ড এ ডিসিপ্লিন্ড আর্মি। সেনাপ্রধান এর পর কথা না বাড়িয়ে অন্যদিকে মনােনিবেশ করলেন। সে দিনের সংবর্ধনা সভায় নারী পুরুষের ভিড় ছিল প্রচুর।
 
এর চার মাস পরের ঘটনা সর্ববিদিত। একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলো সামরিক এক জান্তার হাতে। এই সামরিক জান্তা ঘাপটি মারা কোন মহলের মদদ ছাড়া এমনভাবে জনতার রায়কে বানচাল করার সাহস পেতো না।
 
আজ আর একটি ঘটনা মনে পড়ে। সাত্তার শাসনামলে জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন শেষে নতুন সংসদ ভবন থেকে বেরুবার সময় দেখা হয় মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাথে। আমার সাথে ছিল তখনকার অবজারভারের আমার বিশিষ্ট বন্ধু আবদুল মতিন। মহিউদ্দিন ভাই এমপি একজন সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। চারদিকে গুজব, কারা যেন ক্ষমতা দখল করতে তৎপর। এ ব্যাপারে মহিউদ্দিন ভাইয়ের মতামত চাইলে তিনি বললেন, যারা ক্ষমতা দখল করতে উদগ্ৰীব, তাদের ট্রেন অলরেডী যাত্রা শুরু করেছে, গন্তব্যে তারা পৌঁছবেই। তার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়। ২৪ মার্চ, ১৯৮২ সালে॥”
— আবদুর রহিম (সাংবাদিক) / সুপ্রভাত বাংলাদেশ ॥ [ ননী প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫ । পৃ: ৮২-৮৪ ]
May be an image of 2 people, bicycle and text