
জুলাইযোদ্ধাদের’ বিক্ষোভের মুখে শেষ মুহূর্তে জুলাই সনদের একটি অঙ্গীকারে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। পরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, যে সনদটি তৈরি হয়েছে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামতের ভিত্তিতে (কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তিসহ), সেই সনদের কোনও ধারা বা অঙ্গীকারে ন্যূনতম কোনও পরিবর্তন কি ঐকমত্য কমিশন একক সিদ্ধান্তে করতে পারে? এ পরিবর্তন নিয়ে কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়েছে বা তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে, এমন কোনও সংবাদ গণমাধ্যমে আসেনি বা ঐকমত্য কমিশনও এরকমটি জানায়নি। সুতরাং, বিক্ষোভের মুখে এরকম একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দলিলে ঐকমত্য কমিশন কী করে একক সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিবর্তন আনল, ভবিষ্যতে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে—যদি না রাজনৈতিক দলগুলো কমিশনের এই সিদ্ধান্তে একমত হয়। আবার একমত হলেও পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে।
স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত জুলাই সনদের ৫ নম্বর অঙ্গীকারটি ছিল এরকম: ‘গণঅভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।’
‘জুলাইযোদ্ধারা’ এই অঙ্গীকারে সন্তুষ্ট নন। বরং তারা জুলাই অভ্যুত্থানে তাদের কর্মকাণ্ডের আইনগত দায়মুক্তি চান। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঐকমত্য কমিশন ৫ নম্বর অঙ্গীকার সংশোধন করে প্রেসবিজ্ঞপ্তি পাঠায়। সংশোধিত বাক্যটি এরকম: ‘গণঅভ্যুত্থানপূর্ব বাংলাদেশে ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান কালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারকে এবং জুলাই আহতদের রাষ্ট্রীয় বীর, আহত জুলাই বীর যোদ্ধাদের যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান যেমন মাসিক ভাতা, সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ব্যবস্থা এবং শহীদ পরিবার ও আহত বীর যোদ্ধাদের আইনগত দায়মুক্তি, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করব।’
প্রশ্ন হলো, শহীদ পরিবার ও আহত বীর যোদ্ধাদের আইনগত দায়মুক্তি, তাদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি ‘জুলাইযোদ্ধাদের’ বিক্ষোভের পরে কেন সনদে যুক্ত করতে হলো? মাসের পর মাস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে দায়মুক্তির এই বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি, নাকি উত্থাপিত হলেও এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি?
সনদের অনেক বিষয়েই রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়নি এবং যেসব বিষয়ে দলগুলো একমত হয়নি, সেগুলো সনদে নোট অব ডিসেন্ট আকারে উল্লিখিত রয়েছে। সুতরাং ‘জুলাইযোদ্ধাদের’ দায়মুক্তির বিষয়টিও যদি আলোচনায় থাকত এবং এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতো, তাহলে সেটি প্রয়োজনে নোট অব ডিসেন্ট আকারেই উল্লিখ থাকতে পারত। কিন্তু তার কোনোটিই কেন হয়নি, সেটি বিরাট প্রশ্ন। তার চেয়ে বড় কথা, বিক্ষোভের মুখে তড়িঘড়ি করে ঐকমত্য কমিশন এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে সনদে যুক্ত করল, তাতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত বলে দাবি করা হলেও পুরো প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকল।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, জুলাই অভ্যুত্থানে যারা সামনের সারিতে ছিলেন, যারা আহত হয়েছেন এবং যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারগুলো কেন দায়মুক্তি চাচ্ছেন? তাদের মনে কোনও ভয় আছে যে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক বা নির্বাচিত সরকার এসে তাদের সুরক্ষা দেবে না বা তাদেরকে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে? এটি কি রাজনৈতিক দলের প্রতি তাদের অনাস্থা নাকি ভয়? যদি তাই হয় তাহলে এই প্রশ্নও উঠবে, জুলাই অভ্যুত্থানে যে রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয় ছিল, তাদের মধ্যে কোনও দল বা জোট যদি নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে, তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিক থাকবে? নাকি এটিও নব্বইয়ের এরশাদের পতনের সময় তিন জোটের রূপরেখার মতোই একটি গুরুত্বহীন রাজনৈতিক দলিলে পরিণত হবে?
মনে রাখতে হবে, অনির্বাচিত সরকার যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তারা ক্ষণস্থায়ী। সুতরাং, একটি অনির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট যে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করল, এর পরিণতি কী হবে, তা এখনই বলা কঠিন। তবে এই সনদে এমন অনেক প্রস্তাব রয়েছে যা বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্র বিকশিত হবে। যেমন, ডেপুটি স্পিকার এবং সংসদের গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটিগুলো বিরোধী দল থেকে নিয়োগ; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল ও আস্থাবিল ছাড়া যেকোনও বিষয়ে সংসদে এমপিদের কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ফিরিয়ে আনা ইত্যাদি। পক্ষান্তরে এমনও অনেক প্রস্তাব এই সনদে রয়েছে যেগুলো এখনই বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় বাস্তবসম্মত কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
সব মিলয়ে যে জুলাই সনদটি স্বাক্ষরিত হলো, সেটি নিয়ে আলোচনা এখানেই শেষ—এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই। বরং আগামী দিনের রাজনীতিতে এই সনদ আরও বহুদিন আলোচিত হবে এবং অনেক রাজনৈতিক সংকটের সমাধান যেমন এই সনদের মধ্য দিয়ে হতে পারে, তেমনি নতুন কিছু সংকটেরও জন্ম হতে পারে। কিন্তু তার সব সমাধানই হতে হবে রাজনৈতিকভাবে। মনে রাখতে হবে, যে অসুখের সমাধান অস্ত্রোপচার, সেটি প্যারাসিটামলে সারবে না।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও বিশ্লেষক