
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন কোনো সমাজের অস্তিত্ব নেই, যেখানে মানুষ সমতা ও ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেনি। গুহা-যুগ থেকে আজকের আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা পর্যন্ত মানবজাতির সবচেয়ে বড় সামাজিক চাওয়া- ন্যায়, ন্যায্যতা ও আইনের অধীনে সমান আচরণ।
“রাষ্ট্রের চোখে সবাই সমান”—এটি শুধু একটি রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং একটি সভ্যতার মানদণ্ড। যে রাষ্ট্রে আইন ক্ষমতাবানকে ছাড় দেয়, সেখানে রাষ্ট্র নিজেরই নৈতিক ভিত্তি হারায়। আইন তখন শাসনের হাতিয়ার হয়, ন্যায়বিচারের নয়। এই সত্য উপলব্ধি করেই প্রাচীন গ্রিস থেকে আধুনিক ইউরোপ পর্যন্ত সব চিন্তাবিদই বলেছেন, রাষ্ট্রের শক্তি নয়, ন্যায়ের ভিত্তিতেই টিকে থাকে সভ্যতা।
‘Rule of Law’ বা আইনের শাসন ধারণাটি প্রথম জনপ্রিয়তা পায় ব্রিটিশ দার্শনিক A.V. Dicey-এর কলমে। তিনি বলেন, ‘No man is above the law, and every man, whatever be his rank or condition, is subject to the ordinary law of the land.’
অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি-রাজা হোক বা সাধারণ নাগরিক—কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এই ধারণাটি আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তি। রাষ্ট্র যখন প্রত্যেক নাগরিককে সমান চোখে দেখে, তখনই আইনের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র তখন শাসক নয়, বরং ন্যায়বিচারের অভিভাবক। তবে এই ধারণার শেকড় আরও গভীরে। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছিলেন, ‘Law should rule, and the rulers should be servants of the law.’
অর্থাৎ, শাসক নয়, আইনই হবে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব। এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, একটি নৈতিক অবস্থান- যেখানে শাসন ক্ষমতার ওপর নয়, ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে রাষ্ট্র নিজের শাসককেও আইনের আওতায় এনেছে। প্রাচীন রোমে, ‘Twelve Tables’ নামক আইন প্রণালীতে প্রথমবারের মতো বলা হয়- আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
২০২৩ সালে ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন ব্যক্তিগত আচরণ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়লে, সরকারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নয়, একজন নাগরিক হিসেবে তিনি তদন্তে অংশগ্রহণ করেন।
একজন অভিজাত সিনেটর এবং একজন সাধারণ নাগরিক একই অপরাধ করলে, তাদের শাস্তিও হবে একই। মধ্যযুগের ইংল্যান্ডে, ১২১৫ সালের Magna Carta ছিল ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া দলিল। সেখানে রাজা জনকে বাধ্য করা হয় এই মর্মে যে, তিনি আর স্বেচ্ছাচারী শাসন করতে পারবেন না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সীমিত থাকবে এবং রাজা নিজেও আইনের অধীন হবেন। এটি ছিল আধুনিক গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রথম ভিত্তি।
আজকের উন্নত বিশ্বে ন্যায়বিচার কেবল তত্ত্ব নয়, এটি একটি জীবন্ত প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, কানাডা এবং জাপান—এই দেশগুলোয় আইন প্রয়োগের নিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের সবচেয়ে গর্বের জায়গা। সেখানে কোনো নাগরিকই, এমনকি রাষ্ট্রপ্রধানও, বিচার থেকে অব্যাহতি পান না।
২০২৩ সালে ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন ব্যক্তিগত আচরণ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়লে, সরকারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নয়, একজন নাগরিক হিসেবে তিনি তদন্তে অংশগ্রহণ করেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দুর্নীতির অভিযোগে এখনো আদালতে বিচারাধীন। আদালতের নির্দেশে তাকে তদন্তে সহযোগিতা করতে হয়। তিনি এখনো বিচারাধীন এবং আদালত প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। পূর্বে এহুদ ওলমার্ট (২০০৯) দুর্নীতির মামলায় দোষী প্রমাণিত হয়ে ১৮ মাস জেল খেটেছেন।
রাষ্ট্রীয় পদে থেকে বিচার প্রক্রিয়া চললেও, কোনো বিশেষ সুবিধা তিনি পাননি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একাধিক মামলায় ইতিপূর্বে আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। এমনকি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তার বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, যদিও পরবর্তীতে উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড তাকে ক্ষমা করে দেন।
বিল ক্লিনটনের ‘মনিকা লিউইনস্কি কেলেঙ্কারি’ মামলায় শপথভঙ্গ ও বিচারব্যবস্থায় বাধা দেওয়ার অভিযোগে Impeachment Trial অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আদালত প্রেসিডেন্ট বা প্রভাবশালীকে নয়, কেবল আইনকেই শ্রদ্ধা করে।
এমনই এক সমাজে নাগরিক জানে- ‘ন্যায়বিচার কেবল শব্দ নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা।’
বিখ্যাত দার্শনিক জন রলস (John Rawls) তার ‘A Theory of Justice’ গ্রন্থে বলেন, ন্যায়বিচার হলো সমাজের সবচেয়ে মৌলিক গুণ। তার ‘Veil of Ignorance’ ধারণাটি বলে- যদি মানুষ জন্মের আগে জানত না সে ধনী না দরিদ্র, ক্ষমতাবান না সাধারণ নাগরিক- তবে সে এমন একটি সমাজব্যবস্থা চাইতো, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ ও ন্যায্য আচরণ নিশ্চিত থাকে।
অন্যদিকে, জ্যাঁ জ্যাক রুসো-র ‘Social Contract’ তত্ত্বও একই বার্তা দেয়- মানুষ রাষ্ট্রকে ক্ষমতা দিয়েছে কেবল ন্যায়ের বিনিময়ে। যদি রাষ্ট্র সেই ন্যায্যতা রক্ষা না করে, তবে রাষ্ট্রের বৈধতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
ইমানুয়েল কান্ট আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন, ‘Justice is the foundation upon which the existence of a lawful state rests.’ অর্থাৎ, রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বৈধতা ন্যায়ের ওপর নির্ভর করে, ক্ষমতার ওপর নয়।
ফরাসি প্রজাতন্ত্রের অন্যতম বড় শক্তি হলো বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা। নিকোলাস সারকোজি দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থ গ্রহণের মামলায় আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং তিন বছরের কারাদণ্ড দেয় (যার একটি অংশ স্থগিত ছিল)। জ্যাক শিরাক সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে সরকারি তহবিল অপব্যবহারের অভিযোগে দুই বছরের সাজা পান।
এমন দৃষ্টান্ত ইউরোপে বিরল হলেও ফ্রান্সে এটি সম্ভব হয়েছে কারণ আদালত রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপরে অবস্থান করে।
যখন রাষ্ট্রে আইনের প্রয়োগ অসম হয়- যখন ধনী ও ক্ষমতাবানদের জন্য একটি নিয়ম, আর সাধারণ মানুষের জন্য আরেকটি- তখন রাষ্ট্র ধীরে ধীরে তার নৈতিক কেন্দ্র হারায়।
ইতিহাসে এমন বহু উদাহরণ আছে যেখানে ‘দ্বৈত বিচারনীতি’ সভ্যতাকে পতনের দিকে নিয়ে গেছে। রোমান সাম্রাজ্য শেষ দিকে এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে, আইন কেবল অভিজাতদের সুরক্ষায় ব্যবহৃত হতো। ফলাফল, সাম্রাজ্যের পতন।
ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) অন্যতম কারণও ছিল সামাজিক ও আইনি বৈষম্য- যেখানে অভিজাত শ্রেণি করমুক্ত ছিল, আর সাধারণ মানুষ ভোগ করতো অন্যায়ের বোঝা। ন্যায়বিচারের অভাব সমাজে ক্ষোভ, অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ জন্ম দেয়। আর যখন নাগরিক মনে করে রাষ্ট্র তাকে সমান চোখে দেখে না, তখনই গণতন্ত্র ভেতর থেকে ভেঙে পড়ে।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো- institutional neutrality, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান নিরপেক্ষতা। ব্রিটেনের সংসদীয় ঐতিহ্য, আমেরিকার বিচারব্যবস্থা, কিংবা সুইস প্রশাসন-সবখানেই প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির ওপরে। ব্যক্তির প্রভাব যত বড়ই হোক, প্রতিষ্ঠান তাকে ছাড় দেয় না।
এই কারণেই উন্নত বিশ্বে কোনো মন্ত্রী, বিচারক বা পুলিশ কর্মকর্তা পদে থেকেই অভিযুক্ত হলে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ছেড়ে দেন, যাতে তদন্ত প্রক্রিয়া প্রভাবিত না হয়। এটি আইনের সমতার প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা প্রকাশ করে।
...ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তার বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, যদিও পরবর্তীতে উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড তাকে ক্ষমা করে দেন।
ন্যায়বিচার কোনো রাষ্ট্রের সৌন্দর্য নয়, এটি তার আত্মা। রাষ্ট্র তখনই শক্তিশালী হয়, যখন নাগরিক জানে- আইনের কাছে সবাই সমান। যেখানে আইন পক্ষপাতহীন, সেখানে সমাজে বিশ্বাস জন্মায়; যেখানে আইন দ্বিমুখী, সেখানে জন্ম নেয় ভয়, হতাশা ও প্রতিশোধের সংস্কৃতি।
ইতিহাস সাক্ষী, ন্যায়বিচারই টিকিয়ে রাখে সভ্যতা। একদিকে যদি রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান হয়, অন্যদিকে যদি নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে দুর্বল থাকে-তবে সেই রাষ্ট্র যত উন্নতই হোক, নৈতিকভাবে ভঙ্গুর। রাষ্ট্রের চোখে সবাই সমান- এটি শুধু নীতির কথা নয়, এটি মানব সভ্যতার সর্বোচ্চ প্রতিজ্ঞা। যে রাষ্ট্র এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারে, তার আদালতই হয় ন্যায়বিচারের মন্দির, আর আইন হয় স্বাধীনতার অন্য নাম।
ন্যায়বিচার কোনো প্রার্থনা নয়, এটি একটি চর্চা। রাষ্ট্রের চোখ যদি সত্যিই সমান হয়, তবে সেখানে কোনো রাজা, কোনো প্রভাবশালী, কোনো ধনী নয়- শুধু মানুষ থাকে, আর থাকে আইন। এমন রাষ্ট্রেই নাগরিক গর্ব করে বলতে পারে-‘আমি নই আইনের অধীন; আইনই আমার রক্ষাকবচ।’
ড. সুলতান মাহমুদ রানা : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়