Image description
 

দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তনের হাওয়া সবসময় বড় দেশগুলো থেকে শুরু হয় না। কখনো কখনো তা আসে ছোট দেশগুলোর শান্ত অথচ দৃঢ় পদক্ষেপ থেকে—যারা মর্যাদা, সুযোগ ও নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা খুঁজে বেড়ায়। এ বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে ভুটানের গিলেফু মাইন্ডফুলনেস সিটি (GMC) এবং বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে সংযুক্ত করে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) করার প্রস্তাব দেন।

 

প্রথম দৃষ্টিতে এটি সাধারণ দ্বিপক্ষীয় প্রস্তাব মনে হতে পারে; কিন্তু বাস্তবে এটি আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে এক ভূমিকম্পের ইঙ্গিত। দশকের পর দশক দক্ষিণ এশিয়া ভারতের আধিপত্য, পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সার্কের অচলাবস্থার দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়েছে। কিন্তু এই উদ্যোগ একটি নতুন বয়ান সামনে আনে—ছোট রাষ্ট্রগুলো নিজেদের পথ তৈরি করছে, বিকল্প অংশীদারি গড়ে তুলছে এবং ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসছে। কীভাবে এই প্রস্তাব বৃহত্তর অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক প্রতীকী তাৎপর্য এবং ভারতীয় আধিপত্য ক্ষয়ের প্রতিফলন—তার বিশ্লেষণ করা; পাশাপাশি নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের সঙ্গে তুলনা টানা।

 
 

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ভুটানের প্রস্তাব বাস্তববাদী ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। গিলেফু মাইন্ডফুলনেস সিটিকে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করলে উভয় দেশ পরিপূরক শক্তি কাজে লাগাতে পারবে। ভুটানের জলবিদ্যুৎ সম্পদ এখনো কম ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে এর ৯০ শতাংশ বিদ্যুতের রপ্তানি ভারতেই যায়। বাংলাদেশে বিদ্যুতের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এই সংযোগ ভুটানকে নতুন বাজার দেবে এবং ঢাকা তার ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের প্রয়োজন মেটাতে পারবে। এ উদ্যোগ নেপালের প্রচেষ্টার প্রতিধ্বনি, যারা ভারতনির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে বিদ্যুৎবাণিজ্য বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশের ওষুধশিল্প ২০২৪ সালে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের এবং এরই মধ্যে বৈশ্বিক পর্যায়ে সক্রিয়। ভুটানে উৎপাদন ইউনিট স্থাপন করলে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো নতুন রপ্তানি কেন্দ্র পাবে, আর ভুটানি জনগণ কম দামে ওষুধ পাবে। এটি শ্রীলঙ্কার কৌশলের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, যেখানে দেশটি ভারতীয় আধিপত্য ভাঙতে চীনা ও পাকিস্তানি কোম্পানিকে ওষুধ উৎপাদনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

ডিজিটাল সংযোগের ক্ষেত্রেও ভুটান দীর্ঘদিন ধরে পিছিয়ে আছে—২০২৩ সালে মাত্র ৫৪ শতাংশ মানুষের নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট ছিল। বাংলাদেশের ফাইবার অপটিক সহায়তা চাওয়ার মধ্য দিয়ে ভুটান স্বীকার করছে, স্থলবেষ্টিত ভৌগোলিক অবস্থান ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতার কারণ হতে পারে না। এটি মালদ্বীপের অভিজ্ঞতার মতো, যারা ভারতের বিলম্বিত অবকাঠামো প্রকল্প বাদ দিয়ে চীনা কোম্পানির মাধ্যমে জাতীয় ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে।

পর্যটনও প্রাকৃতিক সেতুবন্ধ। ভুটান বৌদ্ধ পর্যটন বাড়াতে চায়, আর বাংলাদেশে পাহাড়পুরসহ প্রাচীন বৌদ্ধ ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে। এই পথগুলোকে সংযুক্ত করলে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ‘বৌদ্ধ ট্রেইল’ তৈরি হতে পারে, যেমন নেপাল ও শ্রীলঙ্কা যৌথ ধর্মীয় পর্যটন প্যাকেজ দিয়ে তাদের আয় বৈচিত্র্যময় করেছে।

ভুটানের ভারতের ওপর নির্ভরতা শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকও। ১৯৪৯ সালের মৈত্রী চুক্তির পর থেকে ভারত ভুটানের পররাষ্ট্রনীতির অভিভাবক হিসেবে কাজ করেছে। ২০০৭ সালে আংশিক স্বাধীনতা পেলেও এখনো ভুটানের ৮০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি ভারতের মাধ্যমে হয়, আর ভুটানি নুলট্রুম মুদ্রা ভারতীয় রুপির সঙ্গে বাঁধা।

বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে ভুটান কৌশলগত বিকল্প চাইছে। এটি নেপালের সাম্প্রতিক চীনমুখী কূটনীতির প্রতিধ্বনি, যেখানে ২০১৭ সালে তারা প্রথমবারের মতো চীনা বন্দরে প্রবেশাধিকার পায়। ভুটান ভারত থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করছে না, বরং প্রতিবেশীদের মতো কৌশলগত পরিসর বাড়াচ্ছে।

বাংলাদেশের জন্যও এর রাজনৈতিক তাৎপর্য গভীর। অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে ঢাকা নিজেকে আঞ্চলিক সেতুবন্ধকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে। ইউনূসকে প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী তোবগে তাকে ‘আমার অধ্যাপক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, যা প্রমাণ করে বাংলাদেশকে এখন ভারতের কঠোর কূটনীতির বিকল্প সহযোগী হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতার মতো, যেখানে দেশটি সংকট-উত্তর সময়ে ঢাকার কাছ থেকে মুদ্রাবিনিময় ও বাণিজ্য সহায়তা নেয় নয়াদিল্লির শর্তযুক্ত সহায়তার পরিবর্তে।

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক দ্বিধা

ভুটান-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ঐতিহ্যগত আঞ্চলিকতার ব্যর্থতাও প্রতিফলিত করে। ভারত-পাকিস্তান বৈরিতার কারণে ২০১৬ সাল থেকে সার্ক কার্যত অচল। এর জায়গায় ছোট ও মধ্যম রাষ্ট্রগুলো নমনীয় দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক চুক্তি অনুসন্ধান করছে।

বিবিআইএন মোটর যানবাহন চুক্তি ছিল এক উদাহরণ; কিন্তু ভুটান অভ্যন্তরীণ চাপে সরে যায়, কারণ তারা ভারতের ওপর অতিনির্ভর হতে চায়নি। এখন সরাসরি বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে গিয়ে ভুটান দেখাচ্ছে, আঞ্চলিকতা ভারত ছাড়াও সম্ভব।

এই প্রবণতা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় দৃশ্যমান। মালদ্বীপ ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ ও ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতির মধ্যে দোদুল্যমান, চীনের সঙ্গে কৌশলগত অবকাঠামো চুক্তি করেছে। শ্রীলঙ্কা হাম্বানটোট বন্দর চীনের কাছে লিজ দিয়েছে, যখন ভারত বিনিয়োগে দেরি করেছে। নেপাল ক্রমেই চীনা অবকাঠামো প্রকল্পকে স্বাগত জানাচ্ছে ভারতের ওপর নির্ভরতা কমাতে। সুতরাং ভুটান-বাংলাদেশ উদ্যোগটি এই বৃহত্তর প্রবণতার অংশ।

ভারতের কৌশলগত সংকট

ভারতের জন্য ভুটান-বাংলাদেশ চুক্তি বাস্তব ও প্রতীকী উভয় দিক থেকেই চ্যালেঞ্জ। বাস্তবে ভারত ভুটানের জলবিদ্যুৎ ও বাণিজ্য করিডোরের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। যদি ঢাকা ও থিম্পু রেল ও ফাইবার অপটিকের মাধ্যমে সংযোগ গভীর করে, তাহলে ভারতের গেটকিপার ভূমিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রতীকী দিক থেকে তোবগে ও ইউনূসের আলিঙ্গন, যেখানে তিনি তাকে ‘আমার অধ্যাপক’ বলেছেন, তা প্রমাণ করে বাংলাদেশি সহযোগিতামূলক কূটনীতি দিন দিন আকর্ষণীয় হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ‘জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাসুলভ’ মনোভাব অহংকারপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়, যেখানে বাংলাদেশকে সমান অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এটি ভারতকে একই রকম সংকটে ফেলছে, যেমনটি হয়েছিল শ্রীলঙ্কায় হাম্বানটোট বন্দরের সময়ে, নেপালে ২০১৫ সালের সীমান্ত অবরোধে এবং মালদ্বীপে ভারতবিরোধী বিক্ষোভে। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের কড়াকড়ি উল্টো ফল দিয়েছে। ভুটান-বাংলাদেশ চুক্তিতে প্রতীয়মান হচ্ছে, ভারত যদি বদলাতে না পারে, তবে তার প্রভাব ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাবে।

ছোট পদক্ষেপ, বড় পরিণতি

ভুটান-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ক্ষুদ্র মনে হলেও এর প্রভাব বিশাল। ভুটানের জন্য এটি বহুমুখীকরণ ও আত্মপ্রকাশের পথ। বাংলাদেশের জন্য এটি হিমালয় ও বঙ্গোপসাগরের মাঝে সংযোগকারীর ভূমিকা দৃঢ় করে। আর পুরো অঞ্চলের জন্য এটি প্রমাণ করে, ছোট রাষ্ট্রগুলো ভারতীয় আধিপত্যের পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে দ্বিপক্ষীয় পথ বেছে নিচ্ছে।

নেপালের চীন চুক্তি, শ্রীলঙ্কার বন্দর নিয়ে বেইজিংয়ের দিকে ঝোঁক এবং মালদ্বীপের নিরাপত্তা অংশীদারি বৈচিত্র্যকরণ একই বার্তা দেয়—দক্ষিণ এশিয়া আর কেবল ভারতের আধিপত্য দিয়ে সংজ্ঞায়িত হতে রাজি নয়। ভুটান-বাংলাদেশ উদ্যোগ এই কাহিনিতে নতুন অধ্যায় যোগ করেছে।

ভুটান-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি শুধু একটি সম্ভাব্য বাণিজ্যিক চুক্তি নয়। এটি একটি ঘোষণাপত্র, যাতে প্রতীয়মান হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট রাষ্ট্রগুলো আর ভারতের ছায়ায় থাকতে রাজি নয়। বাংলাদেশের দিকে হাত বাড়িয়ে ভুটান নেপালের সাবধানি বৈচিত্র্যকরণ, শ্রীলঙ্কার সাহসী পদক্ষেপ এবং মালদ্বীপের ভারসাম্য নীতির প্রতিধ্বনি করেছে।

বাংলাদেশের জন্য এটি অধ্যাপক ইউনূসের সহযোগিতামূলক কূটনীতির দর্শনকে আঞ্চলিক নেতৃত্বে রূপান্তর করার সুযোগ। ভুটানের জন্য এটি আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রদর্শনী এবং অতিনির্ভরতার চক্র ভাঙার পদক্ষেপ। ভারতের জন্য এটি এক সতর্কবার্তা—বিনয় ও সহযোগিতা গ্রহণ করো, নইলে আরো বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি আছে।

আজ দক্ষিণ এশিয়া এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে। পুরোনো ক্ষমতার স্তরবিন্যাস আঁকড়ে ধরবে, নাকি সমতা, সুযোগ ও যৌথ সমৃদ্ধির ভিত্তিতে নতুন অংশীদারির যুগ শুরু করবে—এটাই প্রশ্ন। ভুটান-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হয়তো ছোট পদক্ষেপ, কিন্তু এটি এক বৃহত্তর পরিবর্তনের দিকেই ইঙ্গিত করছে।

 

লেখকঃড. সিরাজুল আই ভূঁইয়া