
ভারতের সাংবাদিক সুব্রত আচার্য বলেছেন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দাবি বা অনুভূতি ঠিকমতো গত দেড় দশকে সাউথ ব্লকের কাছে পৌঁছায়নি। তাদের মিসলিড করা হয়েছে কোথাও কোথাও। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এবং এটা কোনো দিক থেকেই ভারতের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা, রাজনৈতিক অঙ্ক মেলানো এবং উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক বা উন্নয়ন, সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে উপেক্ষা করে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের সাথে কোনো একটি রাজনৈতিক সরকারের সম্পর্ক ব্যুমেরাং হয়েছে সেটা মোটামুটি ক্লিয়ার। সুব্রত বলেন, দশটা রিকশা নিয়ে কলকাতা যেমন দখল করা সম্ভব নয় আবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মুখাবয়ব অসুরের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে ভালো বার্তা দেয়া সম্ভব নয়।
সুব্রত আচার্য ‘প্রথম কলকাতা’র সম্পাদকীয় প্রধান। তিনি বাংলাদেশের সময় টেলিভিশনে ভারতীয় সংবাদদাতা হয়ে কাজ করছেন। কাজ করেছেন রেডিও টুডে ও দৈনিক যুগান্তরে। নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্ক, আওয়ামী লীগ ও বিজেপির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলেন।
নয়া দিগন্ত : ভারতের তরফ থেকে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি দলের ওপর নির্ভরশীলতার কারণেই কি এটা ঘটেছে?
সুব্রত আচার্য : গত ১৫ বছরে বা ভারতের বিজেপি সরকারের সাথে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকেই পরিচালিত হয়েছে। এই মুহূর্তে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক বেশি ভালো। এটা ভারতের তরফ থেকে অমিট বা স্কিপ করার কোনো সুযোগ নেই। এ সম্পর্ককে সম্মান দিতে হবে ভারতকে। বাংলাদেশে যদি ইসলামপন্থী দল সরকার চালায় তাহলে তারা অবশ্যই অন্য একটি ইসলামী দেশের সাথে সম্পর্ক রাখতেই পারে। ভারত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে সম্পর্ক গড়তে গিয়ে যতটা না করেছে তার চেয়ে বাংলাদেশের মানুষকে ভারতের কাছে ভিলেন বানিয়েছে আওয়ামী লীগ।
নয়া দিগন্ত : এটা কি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ব্যর্থতা?
সুব্রত আচার্য : আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ব্যর্থতার মার্কশিট পেয়ে গেছে ৫ আগস্ট। দেড় বছরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও গত ১৫ বছরে তাদের ভুলত্রুটি সাউথ ব্লকের নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই পোস্টমর্টেম করে দেখেছেন যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক পছন্দকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। বাংলাদেশের মানুষ যদি বিএনপিকে ক্ষমতায় আনে তাহলে বিএনপি নয় বিএনপি সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ক হবে।
নয়া দিগন্ত : ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক তাহলে দুই দেশের বন্ধুত্বকে নিশ্চিত করতে পারে।
সুব্রত আচার্য : এটাই চরম সত্য। দুই দেশের জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্ককে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপেক্ষা করার কেমিস্ট্রিটা যে ভুল তা গত পনের বছরে ঢাকা ও দিল্লি সম্পর্ক প্রমাণ করেছে এবং এরই নির্যাস হচ্ছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্ক যতক্ষণ না রিস্টোর বা ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হবে ততক্ষণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভ্রান্ত ধারণা দূর করা যাবে না। এটা দূর করার দায়িত্ব দুই দেশের রাজনৈতিক সরকারের। এ জন্য রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণকে পাল্টাতে হবে।
নয়া দিগন্ত : এ জন্য দু’টি দেশকেই তো ভূমিকা নিতে হবে।
সুব্রত আচার্য : শতভাগ ভূমিকা ও উদ্যোগ নিতে হবে দু দেশকেই। ভুল তো হতেই পারে। বিজেপি ও আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সম্পর্কের প্যাচআপ করেছিল। এর ফলাফল দু’টি দেশের সাধারণ মানুষ বুঝেছে। এই মুহূর্তে প্রয়োজন দু’টি দেশের জনগণের সম্পর্ক আগের মাত্রায় নিয়ে পৌঁছানো। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ভারতের দিক থেকেও ইতিবাচক হিসেবে দেখতে হবে। অমীমাংসিত অনেক বিষয় যেমন তিস্তা চুক্তি, সীমান্ত সমস্যা ইত্যাদি। আবার উত্তর-পূর্ব ভারতেও উত্তেজনা সৃষ্টি না হয়, উসকানি না দেয়া, অ্যান্টি ইন্ডিয়ান ফিউরি যেটা চলছে এগুলো বর্তমান সরকার বা আগামীতে নির্বাচিত সরকার যারা আসবেন তারা শান্ত করবে। বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এসব বিষয় একটির সাথে আরেকটি যুক্ত। দু’টি দেশকেই একটা বিশ্বস্ততার জায়গা নিয়ে কাজ করতে হবে। কারণ অনেকটা ক্ষত হয়ে গেছে।
নয়া দিগন্ত : ক’দিন আগেও বাংলাদেশ থেকে ইলিশ গিয়েছে, ভারত থেকে চাল এসেছে, সম্পর্ক তো আবহমানকালের...
সুব্রত আচার্য : রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক বা ভৌগোলিক কোনো দিক থেকেই ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক আটকে রাখা যাবে না। ইলিশ কিংবা চাল এগুলো পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের মাধ্যমে দু’টি দেশের কোষাগারে যেমন রাজস্ব যাচ্ছে, তেমনি পণ্য আদান-প্রদানের মধ্যে দু’টি দেশের মানুষ কাছাকাছি যাচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে যে বাংলাদেশী মৎস্যজীবী ভাইটি ইলিশ ধরে বরিশাল বাজারে বিক্রির পর তা রফতানি হচ্ছে ভারতে আবার বর্ধমানে চাষির উৎপাদিত চিনিগুঁড়া চাল যাচ্ছে বাংলাদেশে।
নয়া দিগন্ত : রাজনৈতিক ভুল বোঝাবুঝির বিষয় যেমন শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে হত্যার বিচার চলছে বাংলাদেশে এ ধরনের বড় বাধাগুলো কিভাবে অতিক্রম করা যায়?
সুব্রত আচার্য : শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়াটা ন্যায়সঙ্গত। ভারতের কোনো রাষ্ট্রনেতা বাংলাদেশে আশ্রয় প্রার্থনা করত, তার প্রাণ সংশয় হতো তাহলে বাংলাদেশ কি তাকে আশ্রয় দিত না। তাকে কি তুলে দিত। সারা পৃথিবীতেই তাই। আমেরিকাতে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা বা হাজার হাজার মানুষ পলিটিক্যাল অ্যাজাইলাম নিয়েছে। ব্রিটেনে খোদ বিএনপি নেতা তারেক রহমান রয়েছেন। তারেক রহমানকে ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আবেদন করার পর ব্রিটেন সরকার ফেরত দেয়নি। এগুলো আপেক্ষিক। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি ভারত সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ভারতের প্রচলিত আইন এটিকে নির্দেশনা দিচ্ছে। হাসিনাকে ফেরত দেয়া না দেয়ার সাথে বাংলাদেশের মানুষ যদি উদার হয়, তার যদি দূরদর্শী হন তাহলে এ ইস্যু বা হাসিনার বিচার যে বাংলাদেশে হচ্ছে সেগুলোর সাথে ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক আটকে থাকবে না, যদি বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনা করা হয়, সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করলে কেউ কেউ হয়তো ভারত বিদ্বেষী হয়ে যাবে। হাসিনাকে আশ্রয় দেয়া ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, এই মুহূর্তে তিনি আমাদের অতিথি, অতিথি আমাদের কাছে ভগবান সমতুল্য। আশ্রয় দেয়াটাই আমাদের রাষ্ট্রীয় বিধান।
নয়া দিগন্ত ডেস্ক : হাসিনার শাসনামলে আমরা দেখেছি অনুপ চেটিয়াকে ভারতে ফেরত দেয়া হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি রয়েছে।
সুব্রত আচার্য : অনুপ চেটিয়া আর শেখ হাসিনা এক নয়। শেখ হাসিনা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচন হয়েছে কি হয়নি, রাতের অন্ধকারে হয়েছে সেই ডিবেট হান্ড্রেড পারসেন্ট থাকতে পারে। সেই ডিবেটের মধ্যে লজিকও থাকতে পারে। কিন্তু তিনি তো দেশটা চালিয়েছেন। একজন রাষ্ট্রীয় নেতা যখন অন্য দেশে আশ্রয় নেয় তখন তো সমাজবিরোধী সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করতে পারবেন না। অনুপ চেটিয়ার সাথে তারেক রহমানকে তো ট্রিট করবেন না। আবার সুব্রত বাইনসহ প্রচুর সন্ত্রাসীকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বিরোধীদের রাজনীতি করতে দেননি, তার বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর হুকুম দেয়ার অভিযোগ রয়েছে, এই অভিযোগের সত্য মিথ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে বিচার চলছে ঠিক আছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকলেই সে ভারতে আশ্রিত। তাকে ফেরত দেয়ার বিষয়টি ভারতের সাংবিধানিক ও একেবারেই আইনগত সিদ্ধান্ত।
নয়া দিগন্ত : বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনুরোধ করেছেন যে শেখ হাসিনা ভারতে বসে এমন কিছু না বলেন যাতে শৃঙ্খলা বিঘœ হয়, অস্থিরতার সৃষ্টি না হয়। শেখ হাসিনা প্রায়ই বার্তা দিচ্ছেন এবং সেই অনুযায়ী বাংলাদেশে অস্থিরতার অপচেষ্টা চলছে।
সুব্রত আচার্য : এই সময়ে দাঁড়িয়ে আপনি কার মুখ আটকাবেন। ভারত গণতান্ত্রিক দেশ। ভারতে বসে প্রধানমন্ত্রী মোদি বা পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা বা ব্যক্তিগত আক্রমণও করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা রাজনীতি করবেন, উনি যদি ইউরোপে থাকতেন তাও বলতেন। ভারতের ডেমোক্র্যাসি অনুযায়ী উনি চলবেন। শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে বের হচ্ছেন না, দালাইলামা প্রকাশ্যে সমাবেশ করছেন। শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইতে পারেন সেটা যৌক্তিক বা আইনগত অধিকার আছে। একই সাথে বলতে পারেন শেখ হাসিনা বক্তব্য দেয়ার কারণে বাংলাদেশ অশান্ত হয়ে যাচ্ছে। তার মুখে লাগাম পড়ানো হোক। কিন্তু ভারতে তিনি অতিথি ও তার নিরাপত্তা, ফ্রিডম ভারত সরকার দেবে। এ ব্যাপারে ভারতের সব রাজনৈতিক দল ও ১৪০ কোটি মানুষ একমত। ওনার বক্তব্য বাংলাদেশে সমস্যা সৃষ্টি করলে তা ব্লক করে দেয়া যায়, এটা হাসিনার সময় হয়েছে।
নয়া দিগন্ত : ভারতে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার অব্যাহত রয়েছে, চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়ার কথা বলা হচ্ছে।
সুব্রত আচার্য : চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন বা ঢাকা থেকে রিকশা নিয়ে এসে কলকাতা দখল এগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিউজ বাড়ানোর কৌশল। ৫ আগস্টের পর এনসিপির নেতাদের বক্তব্য যতটা ভাইরাল হতো এখন কিন্তু তা হচ্ছে না। একটা দেশ সম্পর্কে কথা বলতে গেলে সেই দেশের সমাজ, ধর্ম, বর্ণ, ভুগোল, জাতি, রাজনীতি সম্পর্কে জানতে হবে। ভারতের অনেক সাংবাদিক হয়তো ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশেকে জানতে শুরু করেছেন। তারা যদি ১৫ বছরের ইতিহাস না জানে তাহলে বাংলাদেশে সম্পর্কে ভুলভাল বিশ্লেষণ করবে।
নয়া দিগন্ত : বাংলাদেশে চমৎকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে দুর্গাপূজা হয়ে গেল
সুব্রত আচার্য : দু’টি দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষত সারিয়ে তুলতে হবে। দু’টি দেশের সরকারই এ জন্য দায়ী ছিল এবং এখন আমরা চাইলেই বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা চলে যাবে তা হবে না। অন্তত আগামী ১০-১৫ বছরেও হবে কি না সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু একেবারে টগবগ করে ফোটা জল হয়তো গরম থাকবে টগবগ করে ফুটবে না সে জন্য বাংলাদেশের মানুষকে বিবেচনা করতে হবে। উভয় দেশের মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ বা গালমন্দ করা মানুষের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যদি দু’টি দেশের সরকারই উদ্যোগ নেয়। দু’টি দেশের মধ্যে কেউ যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধর্মকে ব্যবহার না করতে পারে সে জন্য আমাদের সজাগ থাকতে হবে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় যেমন প্রশ্নবিদ্ধ সৃষ্টি করছে সেটাকেই জাস্টিফাই না করে আমাদের ন্যায়নিষ্ঠার ভিত্তিতেই এগিয়ে যেতে হবে। দশটা রিকশা নিয়ে কলকাতা যেমন দখল করা সম্ভব নয় আবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মুখাবয়ব অসুরের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে ভালো বার্তা দেয়া সম্ভব নয়। দু’টি শ্রেণীই মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত।