Image description
 

দেশ যখন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় ১৩তম জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ও বক্তব্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। যদিও এটি প্রতিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামি দলগুলোর, বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি সচেতন নাগরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

 
 

অতীতে কখনো এমন দেখা না গেলেও, গত কয়েক মাসে ঢাকার সব পশ্চিমা দেশের মিশনপ্রধানসহ চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়ার কূটনীতিকরা নিয়মিত জামায়াত নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। এমন পরিস্থিতিতে একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠেছে—ইসলামি দলগুলো কি আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করতে যাচ্ছে? যদি তাই হয়, তারা কি ইসলামি শরিয়াহ আইন প্রয়োগ করবে এবং ইসলামি সংবিধান চালু করবে?

 

২০২৪ সালের ৩৬ জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে, তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা দেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করছে। শুরুতে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি পরবর্তী নির্বাচনের জন্য জনগণের স্বাভাবিক পছন্দ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। একই সঙ্গে, জনমানসে একটি প্রত্যাশা ছিল, ইসলামপন্থি দলগুলোর সংসদে তাদের আসনসংখ্যা বাড়াবে এবং বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে। তবে খুব সাম্প্রতিক সময়ের আগ পর্যন্ত কেউ এমন চিন্তা করে নাই যে, ইসলামি দলগুলো বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করার সম্ভাবনা আছে। এখন দেখা যাচ্ছে অনেক জামায়াত বিরোধী গণমাধ্যমকর্মী ও ইউটিউবাররা জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে কন্টেন্ট বানাচ্ছেন। তাহলে হঠাৎ এই পরিবর্তনের পেছনে কী কারণ রয়েছে?

 

জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামি দল ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনা বলিষ্ঠভাবে ধারণ করেছে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সদস্যদের সঙ্গে দৃশ্যমান কোনো সম্পর্ক এড়িয়ে চলছে বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে, বিএনপির কিছু নেতার চাঁদাবাজি, টেম্পোস্ট্যান্ড দখল, আর্থিক সুবিধা অর্জনের উদ্দেশ্যে অবৈধ ও জনবিরোধী কার্যক্রমে সম্পৃক্ততা, দলের অভ্যন্তরে কোন্দল এবং বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু নেতার অনুপযুক্ত ও বিতর্কিত বক্তব্য তাদের জনপ্রিয়তাকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

 

বিএনপির জনপ্রিয়তা হ্রাসের আরো একটি বড় কারণ হলো—তারা জনপ্রিয় জাতীয় প্রস্তাবগুলো, যেমন : আওয়ামী লীগ মনোনীত রাষ্ট্রপতির অপসারণ, গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার প্রস্তাব, ‘জুলাই সনদ’ এবং এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে অস্পষ্টতা ও বিরোধিতা। পাশাপাশি, জুলাই ৩৬ বিপ্লবকে খাটো করে দেখার প্রবণতা সাধারণ মানুষের কাছে নেতিবাচকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ভারতের প্রতি অনুগত অবস্থান এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও উদার গণতন্ত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়া তাদের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং আল্লাহর প্রতি অটুট আস্থার আদর্শ থেকে সরে আসা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

 

বিএনপির জনপ্রিয়তা মূলত শহীদ জিয়ার সততা, দেশপ্রেম বা ভারতবিরোধী অবস্থান, পারিবারিক পক্ষপাতহীনতা, ইসলামপ্রীতি, মুসলিম বিশ্বের ঐক্য প্রচার, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ও নারীশিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল। বেগম খালেদা জিয়াও এসব নীতি দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছিলেন। কিন্তু এখন বিএনপির কিছু নেতার নতুন বামপন্থি, ধর্মনিরপেক্ষ, উদারনৈতিক, ভারতঘেঁষা ও ইসলামবিরোধী বয়ান জনগণের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।

 

অনেক নেতাই যেন ভুলে গেছেন, শহীদ জিয়া ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান নিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের বৈধ অধিকারের জন্য দৃঢ়ভাবে লড়াই করেছিলেন। যদি বিএনপি নেতৃত্ব ভারতের প্রতি অনুগত হয়ে আওয়ামী লীগের ভোট পাওয়ার চেষ্টা করে, তবে এটি হবে বিএনপির জন্য আত্মঘাতী।

 

বিএনপি যখন ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে তাদের ঐতিহ্যগত মৈত্রীর পথ পরিত্যাগ করছে, তখন ইসলামি দলগুলো আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিএনপি যতই ভারতীয় আধিপত্যকে সমর্থন করে, ততই তারা ভোটারদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এছাড়া তৃণমূলে চাঁদাবাজি ও জনবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে নিতে বিলম্ব হলে তারা আরো বেশি জনসমর্থন হারাবে।

এই প্রেক্ষাপটে, অনেকেই ইসলামি দলগুলোর দিকে ঝুঁকছেন মূলত ভারতীয় আধিপত্য থেকে দেশকে রক্ষা করা, ‘জুলাই ৩৬’ বিপ্লবের চেতনায় অগ্রসর হওয়া এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার লক্ষ্যে। অনেকে মনে করেন, ইসলামি দলগুলো ছাড়া সব রাজনৈতিক দলই ইতোমধ্যে একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে; এখন ইসলামি দলগুলোকে সুযোগ দেওয়ার সময় এসেছে।

 

তবে এ বিষয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে—ইসলামি দলগুলো কি সরকার পরিচালনার জন্য প্রস্তুত? তারা কি বাস্তবিক অর্থে নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারবে? এ ধরনের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে প্রয়োজন সঠিক তথ্য ও গভীর বিশ্লেষণ। ইসলামি দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বৃহত্তর দল হচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

 

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই ইসলামি দলগুলো ইসলামি সংবিধান ও শরিয়াহ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছে। একজন মুসলিম হিসেবে, মূলনীতির দিক থেকে এ দাবির বিরোধিতা করার সুযোগ নেই। কিন্তু ৯২ শতাংশ মুসলমান অধ্যুষিত একটি দেশে, স্বাধীনতার ৭৮ (পাকিস্তানের ২৪ ও বাংলাদেশের ৫৪) বছর পরও জনগণ ইসলামি সংবিধান ও শরিয়া বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত বলে মনে হয় না।

 

বাংলাদেশের মুসলমানরা সাধারণভাবে ইসলামবিরোধী নয়, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলামি সংবিধান বা শরিয়াহর বাস্তবায়ন সমর্থন করে না। ভোটের ব্যাপারে এই দাবিগুলো মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে বিভক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামি শাসনের বিরোধিতাকারীরা সাধারণ জনগণকে বোঝাতে পেরেছে যে ইসলামি দলগুলোর বিজয় মানেই চুরি করলে হাত কেটে ফেলা, ব্যভিচারে পাথর নিক্ষেপে হত্যা এবং নারীদের পর্দা বা গৃহবন্দিত্বে বাধ্য করা হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ইসলামি দলগুলো এ ধরনের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর প্রচারের বিরুদ্ধে কার্যকর অবস্থান নিতে পারেনি। মূলত তাদের অস্পষ্ট বক্তব্য ও ভুল কৌশলের কারণে জনগণ ইসলামি শাসনের কল্যাণ সঠিকভাবে বুঝতে পারেনি।

 

জনমনে এমন একটি ধারণাও বিদ্যমান যে ইসলামি দলগুলো অমুসলিমদের প্রতি বৈরী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়। নারীবিদ্বেষী হিসেবে তাদের চিত্রায়ণও তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যদি ইসলামি দলগুলো সত্যিই নির্বাচনে জয়লাভ করতে চায়, তাহলে তাদের এসব নেতিবাচক প্রচার মোকাবিলা করতে হবে এবং এসব বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। জনগণকে বাস্তবিকভাবে বোঝাতে হবে, তারা আসলে কী চায়।

 

প্রশ্ন হলো-বাংলাদেশ কি ইসলামি শাসনব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত? ইসলামি দলগুলোর জয় কি ইসলামকে বিজয়ী করবে? সরকার পরিচালনা কি ইসলামি দলগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে, নাকি পুরস্কারের হবে? তাদের হাতে কি দক্ষ মানবসম্পদ, মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বিস্তারিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নযোগ্য রূপরেখা আছে? তারা কি অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা ও সমালোচনা এবং আন্তর্জাতিক শত্রুতা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত?

 

দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দলীয় কোন্দল ও ভারতঘেঁষা অবস্থানের কারণে জনগণ প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোয় আস্থা হারিয়েছে। ফলে জনগণ এখন ইসলামি দলগুলোকে বিকল্প হিসেবে বেছে নিতে পারে। এটি কি ইসলামী দলগুলোর অর্জন, না প্রতিপক্ষের ব্যর্থতার ফসল।

 

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ইসলামি ছাত্রশিবিরের বিজয় থেকে অনুমান করা যায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসলামি দলগুলোর প্রতি জনসমর্থনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (জাকসু) বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিজয়কে ছাত্রদের আদর্শগত পরিবর্তন হিসেবে দেখা উচিত নয়। বরং এটি ছিল ছাত্রশিবির ও তাদের সহযোগীদের প্রজ্ঞার বিজয়-যেখানে তারা বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্রদের নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল গঠন করেছে, ছাত্রদের প্রকৃত চাহিদা পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রমের অঙ্গীকার করেছে, ছাত্রীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দিয়ে তাদের আস্থা অর্জন করেছে এবং সর্বোপরি সব ধরনের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যের প্রতীক ‘জুলাই ৩৬’-এর চেতনা সমুন্নত রেখেছে। জাতীয় নির্বাচনে ইসলামি দলগুলো কি পারবে ছাত্রশিবিরের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা অনুসরণ করতে?

লেখক : উপাচার্য, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

ড. শাহজাহান খান