Image description
 

আনুপাতিক হারে নির্বাচন পদ্ধতি তথা প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশন (পিআর) এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। বর্তমানে এদেশের প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতি হচ্ছে, কোনো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন (একটি ভোট বেশি হলেও), তিনিই নির্বাচিত হবেন। এতে বিজয়ী প্রার্থী শতকরা কত ভাগ ভোট পেলেন, তা ধর্তব্য নয়। এটাকে ইংরেজিতে ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ (এফপিটিপি) বলে। অপরদিকে পিআর পদ্ধতিতে আসনভিত্তিক নয়, বরং জাতীয় ভিত্তিতে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়। যে দল যত ভোট পাবে, আনুপাতিক হারে সে দল ততটা সিট পাবে। বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি ও পিআর দুটিরই পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি আছে, আছে মেরিট ও ডিমেরিট। পৃথিবীতে উভয় পদ্ধতিই চালু আছে।

 

পিআর পদ্ধতির মধ্যে আবার তিন ধরনের নিয়ম আছে। এগুলো হলো—পার্টি-লিস্ট পিআর, মিক্সড-মেম্বার পিআর ও সিঙ্গেল ট্র্যান্সফারেবল ভোট পদ্ধতি। পার্টি-লিস্ট পিআর পৃথিবীর ৮৫টি দেশে আছে, অপরদিকে মিক্সড-মেম্বার পিআর পৃথিবীর সাতটি দেশে আছে। আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার সিনেট, মাল্টা ও ভারতের রাজ্যসভায় পিআরের সিঙ্গেল ট্র্যান্সফারেবল ভোট পদ্ধতি অনুশীলন করা হয়।

 

পিআর পদ্ধতি নিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বাগ্‌যুদ্ধ চলছে। তাদের নিজ নিজ দলের নেতারা টকশোগুলো মাতিয়ে রাখছেন। তারা একে অন্যকে কটাক্ষ করছেন, করে চলছেন রীতিমতো আক্রমণ। শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তারা মাঠে আন্দোলনে নামার হুমকি দিচ্ছেন; কোনো কোনো দল এরই মধ্যে নেমেও পড়েছে। ফলে জনগণ দ্বিধান্বিত ও শঙ্কিত যে, কী হতে যাচ্ছে দেশে! দ্রুত পরিবর্তন হওয়ার পরিস্থিতিতে তাদেরও প্রশ্ন—নির্বাচন কি আদৌ সময়মতো হবে? বিএনপি কি পিআর মানবে? বিএনপি যদি না মানে, তাহলে জামায়াত ও তার সমমনা জোট কী করবে? আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে পারবে?

 

বিএনপির জন্য পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনে যাওয়া দৃশ্যত জেনেশুনে বিষ পান করার মতো। কেননা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি এককভাবে কখনো ক্ষমতায় যেতে পারবে না। অতীতে ৪০ শতাংশের নিচে ভোট পেয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেছে। বিএনপি সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ ভোট পেলেও তাতে পিআর পদ্ধতিতে আসন পাবে মাত্র ১২০টি, যা সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট নয়। বিএনপিকে এক বা একাধিক দলের সঙ্গে কোয়ালিশন করতে হবে। আবার বিদ্যমান পদ্ধতিতে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েও বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

 

অন্যদিকে পিআর জামায়াতের জন্য আবির্ভূত হবে আশীর্বাদ হিসেবে। জামায়াত ১৯৯১ সালে এককভাবে নির্বাচন করে ১২ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছিল ১৮টি। পিআর পদ্ধতি থাকলে আসনসংখ্যা তাদের হতো ৩৬টি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর জামায়াতের সমর্থন ও ভোট নিঃসন্দেহে বেড়েছে। কত বেড়েছে বা বাড়তে পারে, তা দেখার জন্য আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলাফলের ট্রেন্ড কিছুটা সুদূরপ্রসারী ইঙ্গিত দেয়। জামায়াত জাতীয়ভাবে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট পেলে পিআরে তাদের আসনসংখ্যা দাঁড়াবে ৬০ থেকে ৭৫টি। বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে বিপুলসংখ্যক আসনে অল্প ভোটের ব্যবধানে হারতে হতে পারে। ফলে আসন পাওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম।

 

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন করার জামায়াতের দাবি নিয়ে চরমোনাইর পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ তাদের সমমনা জোট মাঠে আন্দোলনে নেমেছে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতারা মাঠে-ময়দানে গরম বক্তৃতা দিচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত তারা তাদের এই অবস্থান কি ধরে রাখতে পারবে? ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে জামায়াতের কি ঐক্য থাকবে? জামায়াত ও তার সমমনা জোট আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে পারবে? বিএনপি কোনোভাবেই মানবে না, অপরদিকে জামায়াত ও তার সমমনা জোট আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে চায়। সমাধান হবে তাহলে কীভাবে? নির্বাচন কি সময়মতো হবে? এসব উত্তর পেতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

 

ছোট দলগুলোর জন্য পিআর অনেকটাই পোয়া বারো। যারা বিদ্যমান পদ্ধতির নির্বাচনে কোনোদিন সংসদে যেতে পারবে না, তারা পিআরে নির্বাচন হলে কয়েকটি আসন পেতে পারে। যেমন চরমোনাইর পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এককভাবে হয়তো কোনো আসন পাবে না, অতীতেও পায়নি; কিন্তু ভোটের দিক দিয়ে দুই বা তিন শতাংশ পেয়ে যেতে পারে। ফলে পিআর পদ্ধতিতে তারা ছয় থেকে ৯টি আসন পাবে। অনুরূপভাবে খেলাফত মজলিস ও এবি পার্টিরও এককভাবে নির্বাচন করে আসন পাওয়া দুরূহ হতে পারে। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে শতকরা এক শতাংশ ভোট পেলেও তারা তিনটি আসন পেতে পারে।

 

বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে পিআর পদ্ধতিতে কোনো নির্বাচন হয়নি। কোনো কিছু না হলেই যে ভবিষ্যতে কখনোই তা হতে পারবে না, ব্যাপারটি তেমন নয়। তবে যেকোনো পদ্ধতির বাস্তবতা ও উপযুক্ততা যাচাই-বাছাই করা দরকার। একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে এ জাতি চিনত না। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে তুমুল গণ-আন্দোলনের সময়ও এদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী পর্যন্ত বলেছিলেন, ‘পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নন।’ ইতিহাস সাক্ষী, এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই সবচেয়ে ভালো ও প্রয়োজনীয় ছিল বাংলাদেশে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমেই একাধিক সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশে। কিন্তু পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার আদালতের রায়ের নামে গোজামিলের আশ্রয় নিয়ে তা বাতিল করে, যার পরিণতি ছিল গত বছরের গণ-অভ্যুত্থান এবং তাদের দেশ ছেড়ে পলায়ন।

 

পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হয়নি সত্য, তবে শহীদ জিয়া সত্তরের দশকের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিশ্চিত করেছিলেন যেন ছোট দলগুলো থেকেও তাদের প্রতিনিধি (যেমন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) বিজয়ী হয়ে সংসদে আসেন। রাস্তা বা রাজপথ নয়, বরং সংসদকেই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু বানাতে চেয়েছিলেন শহীদ জিয়া। এটাকে অনেকটা পরোক্ষ পিআর বা পিআরের বিকল্প বলা যেতে পারে। ছোট দলগুলো পিআরের জন্য অতি উৎসাহী হলেও নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা থাকা বড় দল বিএনপির কাছ থেকে কয়েকটি আসনে বিজয়ী হওয়ার নিশ্চয়তা বা আশ্বাস পেলে তারা হয়তো পিআর নিয়ে মাঠের আন্দোলনে যাবে না।

 

পিআর নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হতে চলছে বলে মনে হয়। বিএনপি পিআর মানবে বলে মনে হয় না। তারা চায় নিম্নকক্ষ প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচিত হোক। আর নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত সিটের আনুপাতিক হারে (সংরক্ষিত মহিলা আসনের মতো) উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন করা হোক। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল জামায়াত ও তাদের সমমনা জোটের অবস্থান বিএনপির পুরো উল্টো। পিআর নিয়ে তারা মাঠে আন্দোলনে নেমেছে। ঐকমত্য কমিশনের সমঝোতা বৈঠক চলা অবস্থায় আন্দোলনে যাওয়ায় তাদের কঠোর সমালোচনা করছে বিএনপি এবং তারাও মাঠে নামার হুমকি দিচ্ছে। জামায়াত থেকে বলা হচ্ছে, ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বা আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। তারা এটাকে সময়ক্ষেপণ বলে মনে করে। জামায়াত নেতারা মনে করেন, এভাবে সময়ক্ষেপণ করে একসময় ডিসেম্বরে নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করা হয়ে যাবে। তখন বলা হবে, শিডিউল ঘোষণা করা হয়ে গেছে এবং নির্বাচন অতি সন্নিকটে—এখন কিছুই করার নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পিআর নিয়ে বিএনপি ও জামায়াত ধীরে ধীরে পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে যাচ্ছে।

 

এভাবে পারস্পরিকভাবে দোষারোপ করতে থাকলে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মাঠে নামলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দুর্বল সরকারের পক্ষে পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হবে। পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেলে তখন তা সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এ অবস্থায় জরুরি অবস্থা জারিসহ ১/১১ সরকারের মতো কোনো সরকার জাতির ঘাড়ে চেপে বসতে পারে—এ ধরনের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তখন রাজনীতিবিদদের কিছুই করার থাকবে না।

পিআর নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা কয়েকভাবে দূর হতে পারে। প্রথমত, দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে সব দল ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেবে—উভয় কক্ষের নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতে হবে, নাকি পিআরের মাধ্যমে হবে। দুটোই বিশ্বে স্বীকৃত পদ্ধতি। দ্বিতীয়ত, সব দল যদি ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারে, তবে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেবে—নিম্নকক্ষ বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবে, আর উচ্চকক্ষ পিআরের মাধ্যমে হবে। তৃতীয়ত, ওপরের দুটি অপশনের কোনোটিতেই যদি মতৈক্য না হয়, তাহলে ৫০ শতাংশ হবে বিদ্যমান পদ্ধতিতে, আর ৫০ শতাংশ হবে পিআর পদ্ধতিতে। চতুর্থত, ওপরের কিছুতেই যদি সমঝোতা বা ঐকমত্য না হয়, তাহলে পুরো ব্যাপারটি জনগণের কাছে ছেড়ে দেওয়া, অর্থাৎ গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে। জনগণকেই সিদ্ধান্ত নিতে দিন। জনগণ যা বলবে, তা সবাইকে মেনে নিতে হবে।

 

গণভোটের গুরুত্ব, প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা আছে। নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে বছরের ওপর হতে চলল; কিন্তু তারা ১৮ কোটি মানুষের দেশে সুন্দরভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে, এমন সক্ষমতা জাতির কাছে প্রমাণ করার সুযোগ পায়নি। গণভোটের আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন একদিকে জাতিকে সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে, একইসঙ্গে আগামী ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে নিজেদের সক্ষমতাও প্রমাণ করতে পারে।

 

ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
 

লেখক : ইংল্যান্ডে আইন পেশায় নিয়োজিত, সংবিধান বিশেষজ্ঞ