
মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হলেই তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না । সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে এমন সংশোধনী আনা হয়েছে । এর ফলে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ , তাদের সমমনা জোট ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের অন্তত দুই ডজন নেতার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে গত সোমবার গেজেট প্রকাশিত হয় ।
এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হলে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হবেন । এ ছাড়া কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সদস্য , কমিশনার , চেয়ারম্যান , মেয়র বা প্রশাসক হিসেবে নির্বাচিত হতে পারবেন না বা এসব পদে নিয়োগ পাবেন না । এমনকি প্রজাতন্ত্রের ( সরকারের ) কোনো সেবায় নিয়োগ পাওয়ারও অযোগ্য হবেন । সরকারের কোনো অফিসে ( পাবলিক অফিস ) থাকতে পারবেন না । তবে পরবর্তী সময় যদি কেউ ট্রাইব্যুনাল থেকে অব্যাহতি পান বা খালাসপ্রাপ্ত হন , তাহলে তাঁর ওপর থেকে এই অযোগ্যতা তুলে নেওয়া হবে । বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলমান রয়েছে । তাঁদের কেউ কারাগারে আছেন , আবার অনেকেই পলাতক ।
আগামী নভেম্বরের মধ্যে আওয়ামী লীগের পলাতক সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ আরও অন্তত ১২ জনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ( প্রশাসন ) গাজী এম এইচ তামিম । এ ছাড়া আগামী জানুয়ারির মধ্যে আরও কিছু তদন্ত প্রতিবেদন আসতে পারে বলেও জানান তিনি ।
গত বছর আন্দোলনের সময় জুলাই - আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের সাত মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে । আদালত এসব অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর চলছে বিচারকার্যক্রম । কয়েকটি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে । আর শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে । শেখ হাসিনা ছাড়াও এসব মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান , জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু , আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ , সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম , কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাদরুদ্দিন খান , কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী এবং কুষ্টিয়া সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা , নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা ইমরান চৌধুরী আকাশ ।
প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে , আগামী নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা হবে অন্তত ১২ জনের বিরুদ্ধে । তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের , সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক , সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান , সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান , সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক , বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন , সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত , যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল , ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সহকারী একান্ত সচিব ( এপিএস ) মো . মনির হোসেন ।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশে গ্রেপ্তার হয়েছেন দলটির হাজারের বেশি নেতা - কর্মী । যাঁদেরকে জুলাই - আগস্টের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট এলাকার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে । তবে সব মামলা এখনো ট্রাইব্যুনালে আসেনি । অনেকে আবার গ্রেপ্তার এড়াতে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন ।
জুলাই-আগস্টে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু , কামরুল ইসলাম , লে . কর্নেল ( অব . ) ফারুক খান , আব্দুর রাজ্জাক , কামাল আহমেদ মজুমদার , গোলাম দস্তগীর গাজী , ডা . দীপু মনি , সাবেক এমপি সোলায়মান সেলিম , ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম , শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা তৌফিক - ই - ইলাহী চৌধুরী । মহাখালী - তেজগাঁও এলাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার আছেন সাবেক কাউন্সিলর নাসির । চট্টগ্রামে ওয়াসিম হত্যা মামলায় কারাগারে আছেন সাবেক এমপি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী । কক্সবাজারের আওয়ামী লীগ নেতা ও কাউন্সিলর একরাম হত্যা মামলায় কারাগারে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি । এ ছাড়া রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক মো . শাহিনুর মিয়া , উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোয়ার ইসলাম চৌধুরী , গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন , উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো . বশির উদ্দিন ও ঢাকা মহানগর উত্তরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেনও হত্যা মামলায় কারাগারে আছেন ।
তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আগামী জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা হতে পারে বলে প্রসিকিউশন সূত্র জানিয়েছে । ট্রাইব্যুনালে হাসানুল হক ইনু ও ডা . দীপু মনির পক্ষে মামলা পরিচালনা করছেন আইনজীবী আবুল হাসান । তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন , আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পরই কাউকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন । কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করলেই দোষ প্রমাণিত হয় না । রায় হওয়া পর্যন্ত তাঁকে নির্দোষই ভাবতে হয় । এটিই আইনের চিরায়ত রীতি । আইনের সংশোধনী নিয়ে গত মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন , মূল বিষয় হলো কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয় , তাহলে তিনি বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্য হবেন না । অর্থাৎ তিনি জাতীয় নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না । স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবেন না । একইভাবে সেই ব্যক্তি কোনো সরকারি চাকরি করতে পারবেন না ।