
রাত পোহালেই ডাকসু নির্বাচন। ডাকসু মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন। প্রায় ৪০ হাজার ছাত্রছাত্রী ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এটি ৩৮তম ডাকসু নির্বাচন হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব অর্জন করার পর প্রথম নির্বাচন। এর আগে ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পদার্পণের দুবছর আগে হয়েছিল। তারও আগে ১৯৯০ সালের ৬ জুন ডাকসু নির্বাচন রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
সেই নির্বাচনে ছাত্রদলের আমান-খোকন প্যানেল বিজয়ী হয়েছিল। নির্বাচনটি হওয়ার পর নব্বইয়ের স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে এবং ডাকসুর ভিপি আমানউল্লাহ আমান ও জিএস খায়রুল কবীর খোকনের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠিত হয়। রাজনীতি ও আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য এরপর ডাকসু ঘুমিয়ে যায়। ২৯ বছর পর ২০১৯ সালে আবার ডাকসু নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে ভিপি হন নুরুল হক নুরু।
ছয় বছর পর আবার হচ্ছে ডাকসু নির্বাচন। ডাকসুর আলোচিত সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না কয়েকদিন আগে টকশোতে অংশ নিয়ে বলেছেন, ‘ডাকসু নির্বাচনের ঢোল বেজেছে, নাচ নেই। নির্বাচনে একধরনের আমেজ তৈরি হয়েছে বটে, তবে উৎসবের কোনো ঢেউ-তরঙ্গ দেখছি না। আমাদের সময়ে এই নির্বাচন কেন্দ্র করে মাসব্যাপী চলত উৎসব-উত্তেজনা।’ তবে মাহমুদুর রহমান মান্না এখন মানবেন ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ঢোল-নাচ, উৎসব উত্তেজনা সবই বিরাজমান। ক্যাম্পাস সরগরম। মিছিল-মিটিং, ইশতেহার পাঠ, ভোট চাওয়া, টিভি বিতর্কে অংশ নেওয়া, ডাইনিং হলে একসঙ্গে খাওয়া, হলে হলে প্রচার—এক কথায় নির্বাচনের সব উপকরণ চোখে পড়ছে। নির্বাচন নিয়ে ক্যাম্পাস মাতোয়ারা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এবার ডাকসুতে ভোট বিপ্লব হবে। নির্বাচনটি দেশব্যাপী সাড়া ফেলেছে।
তবে যে উৎসাহ-উদ্দীপনায় নির্বাচনটি হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত যেন তা বজায় থাকে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে এ নির্বাচন হচ্ছে। পরাজিত শক্তি ওত পেতে আছে নির্বাচন কীভাবে বিতর্কিত এবং ভন্ডুল করে দেওয়া যায়। এমন কানাঘুষাও শোনা যাচ্ছে, বাইরের একটি মহল এই লক্ষ্যে কাজ করছে। এ ধরনের তৎপরতা চোখে পড়লে এর বিরুদ্ধে ডাকসুতে অংশগ্রহণকারী সব প্যানেলের প্রার্থী এবং শিক্ষার্থীদের অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হবে। ১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর উৎসবমুখর পরিবেশেই নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয়। কিন্তু গণনার সময় গোলাগুলি ও অস্ত্রের মুখে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। সেই ধরনের আশঙ্কা এবার না থাকলেও নির্বাচন ভণ্ডুল করার একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ওই মহলটির মতলব হতে পারে, ডাকসু নির্বাচন ভণ্ডুল বা বিতর্কিত করে জাতীয় নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত করা। এমন যেকোনো ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সজাগ দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি অশুভ চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দিতে হবে।
ডাকসুতে এবার ২৮টি পদে নির্বাচন হবে। প্রার্থী ৪৭১ জন। তাদের মধ্যে নারী প্রার্থী ৬২ জন, যা মোট প্রার্থীর মাত্র ১৩ শতাংশ। তবে ডাকসুতে মোট ভোটারের ৪৮ শতাংশই নারী। এবার ডাকসু নির্বাচনে ৪০ হাজার ভোটারের মধ্যে নারী ভোটার ১৮ হাজার ৯৫৯ জন। ভিপি পদে প্রার্থী ৪৫ জন। এর মধ্যে ছাত্রী পাঁচজন। সাধারণ সম্পাদক বা জিএস পদে প্রার্থী ১৯ জন। সেখানে ছাত্রী মাত্র একজন। অবশ্য একজন জিএস প্রার্থী আরেকজন জিএস প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বাগছাস, দুটি বাম সংগঠন, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র অধিকারসহ স্বতন্ত্র প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। ভিপি প্রার্থীদের মধ্যে ছাত্রদলের মো. আবিদুল ইসলাম খান, ছাত্রশিবিরের মো. আবু সাদিক (সাদিক কায়েম), উমামা ফাতেমা, বাগছাসের আবদুল কাদের, ছাত্র অধিকারের মো. বিনইয়ামিন মোল্লা, শেখ তাসনিম আফরোজ (ইমি) উল্লেখযোগ্য। জিএস প্রার্থীদের মধ্যে ছাত্রদলের শেখ তানভীর বারী হামিম, শিবিরের এসএম ফরহাদ, বামদের মেঘমল্লার বসু এবং বাগছাসের মো. আবু বাখের মজুমদার উল্লেখযোগ্য।
এদের মধ্যেই হবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এদের বেশিরভাগ প্যানেলের ইশতেহারে মিল রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সংকট, নারীদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি, একাডেমিক পরিবেশ উন্নয়ন, গবেষণায় মানোন্নয়ন, ফ্যাসিবাদ নির্মূল, ডাকসু সংস্কার ইত্যাদি। শেষ মুহূর্তে ডাকসু প্রার্থীদের মধ্যে মেরুকরণ হচ্ছে। ভিপিপদে আবিদুল ইসলাম ও সাদিক কায়েমের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে যাচ্ছে। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ক্যাম্পাসে চমক সৃষ্টি করেছেন। আবিদুল বলছেন, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস নেই। সাদিকের বক্তব্য—ফ্যাসিবাদকে ছাড় নয়। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ছাত্রী ছাড়া যিনিই ভিপি হবেন তিনি মাদরাসা থেকে আসা। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদরাসা থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হতো না।
ডাকসুর ১০০ বছরের ইতিহাসে এর আগে তিনজন নারী প্রার্থী ভিপি ও জিএস হয়েছিলেন। ১৯৬০-৬১ শিক্ষাবর্ষে প্রথম নারী ভিপি হন বেগম জাহানারা আক্তার। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে ডাকসুর জিএস নির্বাচিত হন মতিয়া চৌধুরী। এরপর ১৯৬৭-৬৮ শিক্ষাবর্ষে ডাকসুর ভিপি হন মাহফুজা খানম, কিছুদিন আগে তিনি মারা যান। এবারের ডাকসু নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১১ জন নারী প্রার্থী দিয়েছে, সাতটি বামপন্থি ছাত্রসংগঠনের যৌথ প্যানেল ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ তাদের প্যানেল থেকে ভিপি প্রার্থী হয়েছেন শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি। আর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় থাকা ছাত্রীদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেত্রী উমামা ফাতেমা ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ নামের প্যানেল থেকে ভিপি প্রার্থী হয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য ছাত্রী প্রার্থীরাও রয়েছেন।
শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮টি ডাকসু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন ১০৪ বছরে উপনীত হয়েছে। শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ধারণ করে এগিয়ে চলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক প্রতিবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের সমাজ-সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটতে থাকে। শিক্ষার আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠার পাশাপাশি আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগারেও পরিণত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার দুবছর পরই ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে গঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ। আর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের প্রথম ভোট হয় ১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে। ছাত্র সংসদ ভূমিকা রাখে ছাত্রদের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কার্জন হল প্রাঙ্গণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণাকে ছাত্ররা ‘নো’, ‘নো’ বলে প্রতিবাদ জানায়। ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত করতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অবদান ছিল অতুলনীয়। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তও হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বসেই। ভাষাশহীদ আবুল বরকত ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।
শুধু ভাষা আন্দোলনই নয়, এরপর প্রতিটি আন্দোলনেই ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনষত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এক অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেন।
একসময় এ বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতো জ্ঞানতাপস, বহু ভাষাবিদ এবং সত্যেন বোসের মতো বিজ্ঞানীরা ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় ‘লড়াইয়ের দুর্গ’। ডাকসুর নেতারাই পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আজ শতবর্ষী এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন (ডাকসু) এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে এ দেশের ছাত্র-জনতা এক ঘৃণিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদী শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। এবার ৩৮তম ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে। এর আগে ৩৭ বার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতিবছরই নির্বাচন হওয়ার কথা। সে হিসেবে ১০০তম ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু হয়েছে মাত্র ৩৭টি নির্বাচন। এর মধ্যে স্বাধীনতার আগে হয়েছে ৩০টি নির্বাচন এবং স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে মাত্র সাতটি নির্বাচন হয়েছে। বিগত দশকের পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদগুলো শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক, আবৃত্তি, রচনা, অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন ও প্রকাশনা বের করা।
তবে ষাটের দশকের শুরুতে শিক্ষা আন্দোলন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ডাকসু ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের রাজনৈতিক ভূমিকা প্রাধান্য পায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের অতুলনীয় ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। পুরো মার্চ মাসজুড়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোয় আক্রমণ চালানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্রাধিক ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান এরই ধারাবাহিকতা।
ডাকসুর শতবছরের ইতিহাস
লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে লেখা বই থেকে জানা যায়, ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হওয়ার পর ওই বছরেরই ২৩ সেপ্টেম্বর মুসলিম হল ইউনিয়ন গঠিত হয়। কয়েক মাসের মধ্যে ঢাকা হল ইউনিয়ন ও জগন্নাথ হল ইউনিয়ন গঠিত হয়। এরপর হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ এবং এ সংসদের ভোট হয় ১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে। ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে এর নামকরণ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। ডাকসুকে মিনি পার্লামেন্ট বা ছোট সংসদ হিসেবে তখন থেকেই অভিহিত করা হয়। শুরুতে হলে হলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। সেখানে ডাকসু প্রতিনিধি নির্বাচিত হতেন। ডাকসু প্রতিনিধিদের ভোটে নির্বাচিত হতেন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি, ভিপি এবং সাধারণ সম্পাদক জিএস। পর্যায়ক্রমে এক হল থেকে ভিপি এবং আরেক হল থেকে জিএস নির্বাচিত হওয়ার রীতি ছিল। ১৯৭০ সালে শুরু হয় সরাসরি ভোট। শিক্ষার্থীদের ভোটেই ভিপি-জিএস নির্বাচন শুরু হয়।

ষাটের দশকে ছাত্রসংগঠন ছিল ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ। আর আইয়ুব খানের সরকারি ছাত্রসংগঠনের নাম ছিল ন্যাশনাল ছাত্র ফেডারেশন বা এনএসএফ। ১৯৬৩ সালের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে এনএসএফের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেল নির্বাচনে অংশ নেয়। ডাকসুতে ছাত্র ইউনিয়ন মনোনীত প্যানেল থেকে রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী ভিপি-জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে হলের কোটাভিত্তিক পদ্ধতিতে সর্বশেষ ডাকসুর ভিপি হয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলের ২৩ বছরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে ১৪ বার। পাকিস্তান ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে নির্বাচন হয়েছে ১৬ বার। একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫৪ বছরে ভোট হয় মাত্র সাতবার।
’৭৩-এর ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই
১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে শেখ কামালের ইশারায় মুজিববাদী ছাত্রলীগের ‘ব্যালট বাক্স ছিনতাই’ ইতিহাসের এক ন্যক্কারজনক ঘটনা। নির্বাচন কারচুপি বিশেষ করে ব্যালট জালিয়াতি যে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একটা মজ্জাগত ব্যাপার কিংবা তাদের রক্তের সঙ্গেই মিশে আছে, সেটি তারই প্রমাণ। গণতান্ত্রিক নির্বাচন কিংবা সুষ্ঠু ভোটে একেবারেই বিশ্বাস করে না আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গদল ছাত্রলীগসহ অন্যরা।
১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় ডাকসু নির্বাচন। তখন জাসদ ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। তাই জাসদ ছাত্রলীগকে ঠেকাতে মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে নির্বাচনে প্যানেল দেয়। এই সমঝোতা করতে গিয়ে মুজিববাদী ছাত্রলীগ প্রায় অর্ধেক আসন ছাত্র ইউনিয়নকে ছেড়ে দিতে হয়। এ ঘটনায় ছাত্রলীগে কোন্দল সৃষ্টি হয়।
ছাত্রলীগের একটি অংশ ভোটের প্রচারে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে জাসদ ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে। অন্যদিকে মুজিববাদী ছাত্রলীগের সঙ্গে আঁতাত করার কারণে ছাত্র ইউনিয়নের জনপ্রিয়তাও কমে যায়। মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেলের ভিপি পদে ছিলেন নূহ-উল-আলম লেনিন (ছাত্র ইউনিয়ন) ও জিএস পদে ইসমত কাদির গামা (মুজিববাদী)। অন্যদিকে জাসদ ছাত্রলীগের প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক ও জিএস প্রার্থী জহুরুল ইসলাম।
তিয়াত্তরের ওই সময়টিতে রেশন কার্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে তোলপাড় চলছিল। রেশন কার্ড কেলেঙ্কারির সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত ছিল। দুর্নীতি ও কালোবাজারি এতটাই বেড়ে যায়, এতে মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের বক্তব্য ম্লান হয়ে যায়। তাছাড়া দুর্ভিক্ষ, বন্যাসহ অন্যান্য কারণেও দেশে সংকট চলছিল। এ অবস্থায় ডাকসুতে মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেলের ভরাডুবি হোক ছাত্রলীগ কোনোভাবেই চায়নি। শেখ কামাল ইশারা দেন নির্বাচন বানচাল করে দিতে হবে। ইশারাই কাফি। ডাকসু নির্বাচনের প্রচার চলতে থাকল। ভোটের দিন ৩ সেপ্টেম্বর উৎসবমুখর পরিবেশেই হল সংসদ ও ডাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলে। বিকেলে শুরু হয় ভোট গণনা। সন্ধ্যার ঠিক আগে কয়েকটি ছাত্রহলে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ক্যাম্পাসেরও বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায়।
অন্ধকার পরিবেশে মুজিববাদী ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা রিভলভার, স্টেনগানসহ নানা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গুলি করতে করতে ভোট গণনার কক্ষে ঢুকে যায়। অস্ত্র তাক করে ভোট গণনা থামিয়ে দেয় এবং একপর্যায়ে অস্ত্রের মুখে ব্যালট বাক্সগুলো ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। ওই নির্বাচনে ভোটগণনার যে আভাস পাওয়া গিয়েছিল, তাতে দেখা যায়, জাসদ ছাত্রলীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ডাকসু ও হল সংসদে। ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের এ ঘটনা কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করে। নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগের কাছে মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল হারলে যে বিপর্যয় হতো, তার চেয়ে বেশি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় মুজিববাদী ছাত্রলীগ। ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচন বাতিল করে দেয়।
সেদিন সিপিবি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, যিনি ডাকসুর ভিপি ছিলেন, বিবৃতিতে দিয়ে বলেন, অস্ত্র নিয়ে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছে জাসদ ছাত্রলীগ। সেই বিবৃতির জন্য পরে তিনি ভুল স্বীকার করেন। তার ওই বিবৃতি সঠিক ছিল না। ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না ’৭৩-এর সেই ডাকসু নির্বাচন সম্পর্কে বলেন, ’৭৩-এর ডাকসু নির্বাচন ‘হাইজ্যাক’ হয়েছিল। গণকণ্ঠে পরদিন শিরোনাম হয়—‘অস্ত্রের ভাষায় ব্যালটে’র রায় বানচাল। ইত্তেফাকের শিরোনাম—‘ডাকসু নির্বাচনে গোলাগুলি ও ব্যালট বাক্স ছিনতাই’। পূর্ব দেশের শিরোনাম ছিল—ডাকসুর শান্তিপূর্ণ নির্বাচন—‘সন্ধ্যায় গোলাগুলির মুখে ত্রাসের সঞ্চার’। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিতর্কিত ওই নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করায় ১৯৭২ সালের ডাকসু নির্বাচনের বিজয়ী প্যানেল পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমার দেশ