
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বদরুদ্দীন উমর অনেক দিক দিয়েই ছিলেন অসাধারণ। অধ্যয়নে, প্রজ্ঞায়, অঙ্গীকারে, কর্মে—তাঁর সঙ্গে তুলনীয় মানুষ তাঁর সময়ে বিরল। কিন্তু তাঁর সব গুণের মধ্যে যেটি সবচেয়ে বড় এবং অন্য সব গুণের ভেতরে যেটি শিরদাঁড়ার মতো কাজ করে, সেটি হলো তাঁর ‘না’ বলার ক্ষমতা।
‘না’ বলার লোক সমাজে যে নেই, তা তো নয়।
মাদককে, ধূমপানকে, ঘুষ প্রদানকে ‘না’ বলার আহবান বেশ ভালোভাবেই শোনা যায়। নিরামিষাশীরা ‘না’ বলেন আমিষকে। হ্যাঁ-না ভোটও হয়। কিন্তু উমর ভাই যা করেছেন, সেটি হলো তাঁর শ্রেণিকে ‘না’ বলা।
যে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা, তাঁর ওঠাবসা, সেই শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, আকাঙ্ক্ষা, মোহ, সামান্যতা—সবকিছুকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু তাঁর এই প্রত্যাখ্যান সন্ন্যাসীর নয়, সমাজ বিপ্লবীর। ‘না’ বলেছেন অন্য কারণে নয়, ‘হ্যাঁ’তে অকুণ্ঠ আস্থা থেকেই। সে ‘হ্যাঁ’ হচ্ছে একটি নতুন সমাজ গড়ার, যেটি হবে সমাজতান্ত্রিক, যেখানে সম্পদের মালিকানা আর ব্যক্তিগত থাকবে না, হবে সামাজিক।
ওই ‘হ্যাঁ’ বলার লক্ষ্যেই নিজেকে তিনি শ্রেণিচ্যুত করেছেন।
আমাদের দেশে সমাজ বিপ্লবী আন্দোলনে কম মানুষ আসেনি। শ্রেণিচ্যুত হয়ে আন্দোলনে অসংখ্য মানুষ অকাতরে শ্রম ও সময় দিয়েছে, প্রাণ বিসর্জনে পর্যন্ত কুণ্ঠিত হয়নি। বদরুদ্দীন উমরের ক্ষেত্রে যেটি ঘটেছে সেটি হলো শ্রেণিচ্যুতিকে তিনি একনিষ্ঠভাবে যুক্ত করেছেন জ্ঞানান্বেষণের সঙ্গে। তিনি জ্ঞান সংগ্রহ করেছেন গ্রন্থপাঠ ও ইতিহাস অধ্যয়ন থেকে; এবং একই সঙ্গে মেহনতি মানুষের জীবন-সংগ্রাম ও চিন্তাধারা থেকেও।
এবং সেই সঙ্গে আরো যা করেছেন, সেটি হলো জ্ঞানকে কর্মে প্রয়োগ। জ্ঞান তাঁর জন্য অহংকারের বোঝা হয়ে ওঠেনি, জ্ঞান তাঁকে বিচ্ছিন্নও করেনি, জ্ঞান তাঁকে প্রজ্ঞাবান করেছে। একই সঙ্গে তিনি জ্ঞানী ও কর্মী।
শুরু থেকেই ওই রকমেরই ছিলেন। পড়তেন, ভাবতেন এবং লিখতেন। কিন্তু এক পর্যায়ে পেশাগতভাবে যখন অতি উচ্চ স্তরে উঠে গেছেন, ঠিক তখনই সবকিছু ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছেন মেহনতি মানুষের সংগ্রামী আন্দোলনে, যোগ দিয়েছেন নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টিতে। কাজটি কোনো দিক দিয়েই সহজ ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবেও তিনি অত্যন্ত কর্মঠ ছিলেন। অধ্যাপনা করেছেন, কিন্তু তার বাইরে লিখছিলেনও। রাজশাহীতে অধ্যাপকদের একটি প্রগতিশীল গোষ্ঠী ছিল, তাদের মধ্যে উমর ভাই ছিলেন সর্বাধিক সমাজসচেতন। তিনি রাজশাহীর পূর্বমেঘ ত্রৈমাসিকে লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করেছেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রশ্নে অবস্থান নিতে। তাঁর বই বের হলো ‘সাম্প্রদায়িকতা’ নামে। লিখলেন ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ নামে আরো একটি বই। দেশে তখন ঘোরতর আইয়ুবি শাসন। আইয়ুব খান নিযুক্ত গোমস্তা-গভর্নর মোনেম খাঁ তাণ্ডব ঘটাচ্ছেন। সেই মোনেম খাঁ তপ্ত হয়েছিলেন এসব লেখার কথা শুনে। শোনা যাচ্ছিল বইগুলো নিষিদ্ধ হবে। উমর ভাই পরোয়া করেননি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে সোজা যোগ দিয়েছেন সমাজ বিপ্লবীদের দলে। সে জীবন কেবল অনিশ্চিত ছিল না, ছিল রীতিমতো বিপজ্জনক।
বদরুদ্দীন উমর সব সময়েই একজন সামাজিক মানুষ। রাজশাহীতে প্রগতিশীল শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁর যোগটা ছিল নিবিড় বন্ধুত্বের। আইয়ুবি শাসনের শেষ দিকে একটি উদ্যোগ দানা বেঁধে উঠছিল স্বৈরাচারবিরোধী একটি বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী গঠনের। উমর ভাইয়ের সহকর্মী ও বন্ধুরা ওই উদ্যোগে ছিলেন। উমর ভাই চেয়েছিলেন আমিও যুক্ত হই। তাঁদের একাংশ বের করল ইংরেজি সাপ্তাহিক ফোরাম পত্রিকা। আর তখনই দেখা গেল দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি মৌলিক পার্থক্য। ফোরাম যাঁরা বের করলেন, তাঁরা অবশ্যই ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সামরিক শাসনবিরোধী এবং গণতন্ত্রপন্থী, কিন্তু উমর ভাই তো আরো অগ্রসর, তিনি তো সমাজতন্ত্রী। ফোরামে উমর ভাই লিখতে সম্মত হয়েছিলেন, কিন্তু তখনকার রাজনীতি সম্পর্কিত বিষয়ে নয়, আগের আন্দোলনের পর্যালোচনামূলক লেখা। ওই পত্রিকায় আমিও লিখেছি। ফোরামের সঙ্গে নয়, উমর ভাই যুক্ত হয়েছিলেন গণশক্তির সঙ্গে। গণশক্তি গোপন পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র। তিনি ছিলেন সেটির সম্পাদকের দায়িত্বে। পত্রিকাটি চালু রাখা খুবই কঠিন ছিল; বেশিদিন চালু রাখা যায়ওনি, থেমে গেছে একাত্তরের যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ে। আন্দোলনের জন্য যে পত্রিকা আবশ্যক, সেটি সব সময়েই তাঁর চিন্তা ও উপলব্ধির মধ্যে ছিল। সে জন্য নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে সংস্কৃতি নামের একটি মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করেন। সেটি নিয়মিত বের হতো। মাঝখানে থেমে গিয়েছিল, কিছুদিন হলো আবার চালু করেছেন। একসময়ে নয়া পদধ্বনি নামে একটি বামপন্থী সাপ্তাহিক বের হয়েছিল। এর পেছনে ছিলেন বদরুদ্দীন উমর; সামনে কর্নেল কাজী নূরুজ্জামান। সে পত্রিকার অক্ষরবিন্যাস করতেন পার্টির কর্মীরা, বিতরণেও তাঁরা ছিলেন। পত্রিকাটি জমে উঠছিল। আমরা যুক্ত হয়েছিলাম তার সঙ্গে; আমার স্ত্রী নাজমা জেসমিনও লিখত, সোৎসাহে। কিন্তু টিকল না। এরশাদ চলে এলেন অস্ত্রহাতে, সামরিক বাহিনী সঙ্গে নিয়ে। কর্নেল জামানকে গ্রেপ্তার করা হলো, মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে তিনি এরশাদবিরোধী আন্দোলন করবেন এই আশঙ্কায়। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেল।
নিজের লেখা ও পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে উমর ভাইয়ের চেষ্টা ছিল পাঠক ও রাজনৈতিক কর্মীদের সংস্কৃতির মানকে উন্নত করা। সংস্কৃতি উন্নত না হলে জ্ঞান যে ফলপ্রসূ হওয়ার নয় এবং সমাজ বিপ্লব যে অসম্ভব একটি স্বপ্নই রয়ে যাবে, সেটি উমর ভাই জানতেন, যেমন জানতেন অন্য বিপ্লবীরাও। তাই তিনি যেমন আন্দোলনে ছিলেন, তেমনি ছিলেন সংস্কৃতিচর্চায়। তাঁর পত্রিকার নাম অনিবার্যভাবেই দাঁড়িয়েছে সংস্কৃতি। আন্দোলন ও জ্ঞানানুশীলনের সম্মিলনকে তিনি অত্যাবশ্যকীয় মনে করতেন। আর এটিও তিনি জানতেন এবং দেখিয়েছেন যে রাষ্ট্র ও সমাজের কোনো কিছুই রাজনীতিনিরপেক্ষ নয়, সবকিছুই রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত। তাঁর বড় কাজগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তৎকালীন রাজনীতি। তিন খণ্ডে লিখেছেন; তথ্য, বিবৃতি, প্রকাশনা—সবকিছু সংগ্রহ করেছেন; বিশেষভাবে নিয়েছেন সাক্ষাৎকার। ভাষা আন্দোলনকে তিনি দেখেছেন একটি রাজনৈতিক উত্থান হিসেবে, অন্যদের মতো কেবল সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে দেখেননি। হ্যাঁ, সে আন্দোলন বাঙালি সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য ছিল বৈকি, কিন্তু সংস্কৃতি তো আকাশবিহারী নয়, তার ভিত্তি রয়েছে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের মানুষের বিক্ষোভের কারণেই অতটা শক্তিশালী হয়েছিল, এটা তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন। আন্দোলনের ভেতরে ছিল শ্রেণি সম্পর্কের টানাপড়েন। শ্রেণিকে বাদ দিয়ে যে কোনো রাজনৈতিক ঘটনার ব্যাখ্যা করা চলে না, এই সত্যটিকে তিনি সব সময়ই বিবেচনায় একেবারে সামনে রেখেছেন। ইতিহাসের পাঠকে তিনি অত্যন্ত জরুরি মনে করেন এবং সে-পাঠের জন্য শ্রেণিদ্বন্দ্বকে যে ভুললে চলবে না, এ কথা তিনি তাঁর পাঠকদের সর্বদাই খেয়াল করতে বলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ওপর ইংরেজিতে লেখা ‘The Emergence of Bangladesh’ নামে দুই খণ্ডের যে ইতিহাস-গ্রন্থটি তিনি লিখেছেন, সেখানে শাসকদের শ্রেণিগত অবস্থান ও চরিত্রের কথা পরিষ্কারভাবে এসেছে; আর এসেছে শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে মেহনতি মানুষের রুখে দাঁড়ানোর কাহিনি। প্রবন্ধ হোক, কি সংবাদপত্রের কলাম হোক, তিনি যা-ই লিখেছেন, তাতে রাজনীতি কখনোই অনুপস্থিত থাকেনি।
মনে পড়ে, আমরা ওসমানী উদ্যানের ১১ হাজার গাছ রক্ষা আন্দোলন করেছিলাম। মূল চিন্তাটা এসেছিল উমর ভাইয়ের কাছ থেকেই। বামপন্থীরা এবার গাছ আঁকড়ে ধরেছে—এমনটা বলে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করেছে, এমনকি বামপন্থী মহলের কেউ কেউ বাঁকা চোখে তাকিয়েছেন, কিন্তু গাছ রক্ষা আন্দোলন যে আসলে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন; এবং প্রতিবাদটি যে প্রকৃতিবিনষ্টকারী মুনাফা লিপ্সু পুঁজিবাদী উন্নয়নের বিরুদ্ধে, সেটি উমর ভাই অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে জানতেন, জানতাম আমরা যাঁরা আন্দোলন করছিলাম তাঁরাও। ওই একটি সময় গেছে, যখন ঢাকায় বামপন্থীরা একত্র হয়েছিলেন এবং শিল্পী-সাহিত্যিক-লেখকরা কাছাকাছি চলে যেতে পেরেছিলেন সাধারণ নাগরিকদের। ফলে আন্দোলনটি সফল হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছিল যে বামপন্থীরাও পারেন, যদিও যখন তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হন।
তিনি অসুস্থ ছিলেন, হাসপাতালেও যেতে হয়েছে। আবার ফিরেও এসেছেন, কিন্তু আজ চিরদিনের জন্য না-ফেরার দেশে চলে গেলেন। তাঁর এই চলে যাওয়া আমাদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়