
আবদুল লতিফ মাসুম
বাংলাদেশ একটি সমজাতীয় (Homogeneous) রাষ্ট্র। জাতীয়তাবাদের যেসব অভিন্ন উপাদান জাতিরাষ্ট্র নির্মাণে সহায়তা করে, তার অনেকটাই বাংলাদেশ ধারণ করে। বাংলাদেশের মানুষ প্রায় শতভাগ বাংলায় কথা বলে। একই রূপ ভাষার ঐক্যে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ। ধর্মের দিক থেকে প্রায় একই বিশ্বাস ও জীবনবোধ ধারণ করে বাংলাদেশ। দেশটি নৃতাত্ত্বিকভাবে প্রায় একই ধরনের। বলা যায় মিশ্র জনগোষ্ঠী। একই সমতল ভূমিতে এদের বসবাস। ভূগোল, ইতিহাস ও অভিন্ন সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ তারা। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে প্রায় একই ধারা প্রবাহিত। ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’। জাতি হিসেবে উত্তরণে রয়েছে এর হাজার বছরের ইতিহাস। নদীর বহতার মতো গিরি-দরি-বন পেরিয়ে অনেক অনিবার্য বাঁক অতিক্রম করে তবেই এই মানচিত্র ধারণ করেছে এই জনগোষ্ঠী। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে প্রাথমিক শাসক এলিটদের দ্বারা সমজাতীয়তার দেশটি বিভক্তি, বিভাজন ও অনৈক্যের কৃত্রিম সংকটে নিপতিত হয়। রাষ্ট্র গঠনের পর জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের (Building Nation State) অনিবার্যতায় যেখানে ভেদাভেদ ভুলে রাজনৈতিক ঐক্যের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার কথা, সেখানে আরোপিত হয় আধিপত্যবাদের নীলনকশা। ঐতিহাসিকভাবে আত্মীয়ের মতো বেড়ে ওঠা জাতি উগ্র জাতীয়তাবাদ, একনায়কত্ববাদ ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকটে জর্জরিত হয়।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের পর্যায়ে শাসক আওয়ামী লীগ স্বীয় স্বার্থে দেশে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতামূলক মনোভাব প্রদর্শন করে। জাতিরাষ্ট্র গঠনের অন্যসব উপাদানকে অতিক্রম করে তারা ভাষা এবং শুধু ভাষার বাস্তবতাকে ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে। যে জাতির প্রাণশক্তি হচ্ছে ধর্ম, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করা হয়। স্বাধীনতার চেতনার নামে ‘মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা’র বিদ্বেষ তৈরি করা হয়। রাজনীতি, প্রশাসন তথা পুরো জাতির সব ক্ষেত্রে এর বিষময় ফল অনুভূত হয়। সেনাবাহিনীতে পাকিস্তানফেরত অংশ একই ধরনের বিরূপতার সম্মুখীন হয়। আওয়ামী শাসক এলিটরা লাল, নীল ও সবুজ বাহিনী দেশকে সন্ত্রাসের দিকে ঠেলে দেয়। রাজনীতিকে ঐক্যের পথে, সমঝোতার পথে ও সহিষ্ণুতার পথে পরিচালিত না করে তারা শতধাবিভক্তি, শত্রুতা ও ঘৃণা-বিদ্বেষের পথে দেশকে পরিচালিত করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের দিকে না এগিয়ে লুটপাটে মেতে ওঠে। অপশাসন, দুর্নীতি ও সীমান্তে খাদ্যশস্য পাচার হওয়ার কারণে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। সরকারের এসব প্রবণতা বাংলাদেশকে ব্যর্থরাষ্ট্রের (Failed State) দিকে ধাবিত করে।
আওয়ামী দুঃশাসনের দুষ্টচক্র (Vicious Circle of Oligarchy) দেশকে খেয়ে খেয়ে ফোকলা করে ফেলে। এ অবস্থায় শেখ সাহেবের হিমালয়সম জনপ্রিয়তা হিমাঙ্কে নেমে আসে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এ ধরনের অবস্থাকে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপপ্রবণ সময় (Praetorian Period) বলে অভিহিত করে থাকেন। (Praetorian Period বলতে এমন একপর্যায় বোঝায়, যখন কোনো সমাজে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সেনাবাহিনী/সামরিক শক্তি সরাসরি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে।) সেনা রাজনীতিবিশারদ এসপি হান্টিংটন এ সময়কে ব্যাখ্যা করেন এভাবে— ‘Wealthy Bribe, students riot, workers strike, mobs demonstrate and military coup.’ (Samuel P Huntington, Political Order in Changing Societies, Yale University Press. New Haven, 1968, pp 192-263)। বিস্ময়ের ব্যাপার হান্টিংটনের এই মন্তব্য তৎকালীন বাংলাদেশে যথার্থভাবেই প্রতিফলিত হয়।
১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের বিয়োগান্তু ঘটনাবলি প্রকারান্তরে বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সৈনিক থেকে সেনাপ্রধান এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানান। (বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন—আবদুল লতিফ মাসুম, Dilemmas of a Military Ruler, A Political Study of Zia Regime, Afsar Brothers, 2006, Dhaka)। সেনা নেতৃত্বের দ্বিতীয় ব্যক্তি জেনারেল জিয়াউর রহমান অভ্যুত্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। ঘটনা পরম্পরায় তিনি অবশেষে রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ক্রমেই বেসামরিকীকরণের (Civilianization) মাধ্যমে দেশকে স্বাভাবিক পর্যায় স্থাপন করেন। তিনি সর্বপ্রথম যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেন তা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য। রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্যতায় তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। আওয়ামী লীগ বাদে সব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের এই সংকটময় সময় জিয়াকে সতত সমর্থন দিয়েছিলেন। বর্ষীয়ান জননেতা মওলানা ভাসানী তার প্রতি অকুণ্ঠ আশীর্বাদ প্রদান করেন। ১৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ সমাজ ছিল অস্থির, অরাজক ও শতধাবিভক্ত। রাষ্ট্রের গহিন-গভীর অংশ সেনাবাহিনীর অস্তিত্বের সংকটে নিমজ্জিত হয়। জিয়াউর রহমান তার সতত সাহস, দৃঢ়তা ও কর্মদক্ষতা দিয়ে বিশৃঙ্খল, পলায়নপর এবং রাজনৈতিকভাবে বিভ্রান্ত সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এ সময় জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হিসেবে যদি সৈনিকদের একতা, বিশ্বাস ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে না পারতেন, তাহলে দেশ একটি গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হতো এবং চিরকালের জন্য বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতো। প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজউদ্দীন মন্তব্য করেন, ‘Ziaur Rahman Saved the Bangladesh Army from an Impending Doom’ (Emajuddin Ahmed, Military Rule and the Myth of Democracy, UPL, Dhaka, 1988, p 72.) । বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রে এটাই জিয়াউর রহমানের এক উত্তম অবদান। সেনাবাহিনীর ঐক্য সংহত করার পর জিয়াউর রহমান জাতীয় ঐক্যের পথে অগ্রসর হন। তিনি প্রথমত জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য গণভোটের আয়োজন করেন। এটি শুধু গণভোটই ছিল না। ব্যালট পেপারে প্রশ্ন রাখা হয় যে জিয়াউর রহমান সূচিত ইসলামি ভাবধারা-সমৃদ্ধ সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষে আপনার মতামত আছে কি না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মন্তব্য করে, ‘যেহেতু জনগণই ক্ষমতার উৎস এবং এই গণভোটের মাধ্যমে তারা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে পূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়েছে’। উল্লেখ্য, গণভোট হওয়ার আগেই ২৩ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে জারি করা এক নম্বর সামরিক আইন ঘোষণার মাধ্যমে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয়, তার কারণে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মনে জিয়ার ভূমিকা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে (মাহফুজ উল্লাহ, প্রেসিডেন্ট জিয়া রাজনৈতিক জীবনী, জাতীয়তাবাদী প্রকাশনা সংস্থা, ২০২৫, ঢাকা, পৃষ্ঠা : ৭৭)। গণভোটের বিপুল সমর্থন লাভের পর তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে ঐক্য নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। জিয়াউর রহমানের কর্মসূচিকে জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াসে এ সময় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল-জাগদল একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের জন্য অন্যান্য সমমনা রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট নামে একটি রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়। এই জোটে সংযুক্ত হয় ভাসানী ন্যাপ, মুসলিম লীগ, আইডিএল ও অন্য ছোট ছোট রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি।
নির্বাচনের পর ৫ জুন ১৯৭৮ এক সংবাদ সম্মেলনে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জিয়াউর রহমান বলেন, তার তিনটি উদ্দেশ্য রয়েছে—পুরো দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সাধারণ জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। তিনি এ সময় জাতীয় ঐক্যের জন্য তার সমর্থনে গঠিত জাগদলকে এগিয়ে না নিয়ে বৃহত্তর ঐক্যের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন উপলক্ষে গঠিত ফ্রন্টের সবাইকে নিয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ছিল বিভিন্ন চিন্তার ও বিভিন্ন আদর্শের মানুষের সমাহার। শুধু ক্ষমতার জন্য ফ্রন্টে শামিল হয়েছিলেন অনেকে। জিয়া চাইলেন ভিন্নমতের, ভিন্ন রাজনীতির সবাইকে ক্ষমতার ধারায় নয়; বরং জাতীয় ঐক্যের ধারায় প্রবাহিত করতে। ফ্রন্টের মধ্যে নানা ধরনের ব্যক্তিদের সঙ্ঘাত ও কোন্দলের অবসানও একক দল গঠনের উদ্দেশ্য ছিল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর সময়ও তার অনুকূলে ছিল একক রাজনৈতিক দল গড়ার পক্ষে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও নতুন দল গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল। তার পক্ষে গঠিত জাগদল বিরোধীদের মোকাবিলায় যথেষ্ট শক্তিশালী বলে তিনি মনে করতেন না। ইতোমধ্যে শাহ আজিজুর রহমান এবং অন্য রাজনৈতিক নেতারা জিয়া বা ক্ষমতার কাছাকাছি আসার জন্য একক দল গঠনে জিয়াউর রহমানকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। সব দলের মধ্যে ডান ও বামে না গিয়ে তিনি নবগঠিত দলকে মধ্যপন্থি আদর্শে সংগঠিত করেন। তিনি রাজনৈতিক চিন্তায় আধুনিক ও প্রগতিশীল ছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তার অবস্থানকে বর্ণনা করেন এভাবে—Right from the left and left from the right।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। এতে শামিল হয়—জাগদল, ন্যাপ (ভাসানী), ইউপিপি, মুসলিম লীগ ইত্যাদি রাজনৈতিক দল। ডান-বাম, বড়-ছোট নির্বিশেষে সব ব্যক্তি ও সংগঠনকে জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে তিনি একত্র হওয়ার আহ্বান জানান। জিয়া বলেন, দলের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে—বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণা ও আদর্শে জনগণের মধ্যে ইস্পাত-কঠিন ঐক্য গড়ে তোলা এবং জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অগ্রগতি, আত্মনির্ভরশীলতা ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা। বিএনপিতে প্রবীণ ও নবীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অপূর্ব সমন্বয় ঘটে। বিএনপিকে একটি সৎ, সুশৃঙ্খল, অনুগত এবং ত্যাগী দেশপ্রেমিক দল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি চেষ্টা করেন। তার বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতি এই সাক্ষ্য দেয়। তিনি দলের লোকদের আদর্শিকভাবে একই ধারায় দীক্ষিত করার জন্য রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি আশা করতেন, তার নবগঠিত বিএনপি আদর্শে হবে জাতীয়তাবাদী, পরিকল্পনায় আধুনিক এবং ভারসাম্যপূর্ণভাবে হবে সংগঠিত। গ্রামীণ এবং জনসম্পৃক্ত রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। সে জন্য একবার বলেছিলেন—হি উড ম্যাড পলিটিকস ডিফিকাল্ট (He would made politics difficult)। এভাবে তিনি রাজনীতিকে নিতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছে। তিনি গণতন্ত্রকে অর্থপূর্ণ করতে চেয়েছেন। এক কথায় বিএনপি তার সময়ে হয়ে উঠেছিল একটি অনন্য সংগঠন। বিরোধী রাজনীতিক বিশেষত আওয়ামী ও বামধারার বুদ্ধিজীবীরা বিএনপিকে সেনাছাউনি থেকে উত্থিত রাজনৈতিক দল বলে অনিশ্চয়তার কথা বলছিল। কিন্তু শহীদ জিয়া প্রতিষ্ঠিত সেই প্রতিষ্ঠানটি বিগত অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করে অসামান্য জনপ্রিয়তায় দুর্দান্ত প্রতাপে এখনো দীপ্তিমান আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান স্বীকার করেন, ‘She (Khaleda Zia) Succeeded in transforming the BNP from a state-sponsored sarkari party to an opposition party...’
জিয়া মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধাদের এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন আর তা ছিল ক্ষমতায় থাকাকালে এতসব অভ্যুত্থানের অন্যতম কারণ। তিনি আওয়ামী লীগের মতো দেশকে বিভক্ত করতে চাননি। ১৯৭১ সালের ভূমিকার জন্য তিনি কাউকে ঘৃণা করতেন না। তিনি ছিলেন এক বিশাল হৃদয়ের মানুষ এবং তার নীতি ছিল রাষ্ট্রনায়কসুলভ। বিরোধীদের ক্ষমা করার বিপুল মানসিক শক্তি ছিল তার (মাহফুজ উল্লাহ পূর্বোক্ত)। জিয়ার প্রতি ডানধারার সমর্থন ছিল প্রত্যাশিত। সিপিবি ও বামধারার রাজনীতিবিদদের সমর্থন ছিল অপ্রত্যাশিত। স্মরণ করা যেতে পারে, জিয়ার ১৯ দফা ও খাল খনন কর্মসূচির পক্ষে প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছিল সিপিবি। এছাড়া কাজী জাফর, এ জেড এম এনায়েত উল্লাহ খান ও তোয়াহাসহ চীনা বাম ধারার প্রায় সব রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীরা জিয়ার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে তিনি যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সবার সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। তিনি ন্যায়কে নিশ্চিত করতে চাইতেন।
জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর অনেকেই ভেবেছিলেন বিএনপি আর কার্যকর থাকবে না। এরশাদের আমলে বিএনপিকে ভাগ করার অপচেষ্টা চলে। অবশেষে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অবিসংবাদিত নেতৃত্ব এরশাদের পতন ঘটায়। সেই থেকে খালেদা জিয়া আপসহীন নেত্রীর অভিধা অর্জন করেন। এরশাদের অবসানে বাংলাদেশের ইতিহাসে যে নির্বাচনটি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বলে কথিত সেই নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় চলে আসে। ১৯৯৬ সালে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামি শক্তির বিভাজনের সুযোগে ছলে-বলে-কলে-কৌশলে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতাসীন হয়। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতের ঐক্য তাদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের সূত্র হয়ে দাঁড়ায়। বিএনপি আবার সরকার গঠন করে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শহীদ জিয়ার অনুসৃত রাজনৈতিক ঐক্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। অভ্যন্তরীণ শত্রু এবং আধিপত্যবাদী প্রতিবেশীর ষড়যন্ত্রে ১/১১-এর ঘটনা ঘটে। জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিঃশেষ করার জন্য পরে নানা ধরনের নীলনকশা প্রণয়ন করে তারা। ২০০৮ সালের পাতানো নির্বাচনে প্রতিবেশীর প্যাকেজ ডিলের আওতায় তারা ক্ষমতা লাভ করে। দীর্ঘ মেয়াদে তিনটি নির্বাচনে তিন ধরনের কলাকৌশল এঁটে তারা ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার প্রয়াস নেয়। জনগণের হৃদয়ে জমে থাকা দুঃখ-কষ্ট, ক্ষোভ-ক্রোধ একসময় আগুনের ফল্গুধারা ছড়ায়। ২০২৪ সালের গণবিপ্লবে পলায়ন করে স্বেচ্ছাচারী হাসিনা। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় বিএনপি গণতন্ত্রের সংগ্রামে, মানবাধিকার উদ্ধারে ও নির্বাচনব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অনেকবার আন্দোলন-সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। জনগণের নীরব, নিরঙ্কুশ সমর্থন সত্ত্বেও শাসক দলের হামলা, মামলা, গুম ও খুন সত্ত্বেও অপরিসীম ধৈর্য ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বিএনপি গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে সফলতার প্রান্তসীমায় নিয়ে যায়। ছাত্র-জনতার রক্তের মধ্য দিয়ে জাতি আবার গণতান্ত্রিক পথে নিবিষ্ট হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অবশেষে তাদের চূড়ান্ত নেতৃত্বের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করে।
বিজয় অর্জন করা সহজ কিন্তু বিজয়কে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া কঠিন। বিএনপি তথা পুরো জাতি এই কঠিন দায়-দায়িত্ব অর্পণ করে দেশের একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে। বাংলাদেশের চুয়ান্ন বছরের সময়কালে দেশের নাগরিক তথা জনসাধারণ এ রকম অবারিত স্বাধীনতা কখনোই ভোগ করেনি। তাই আন্দোলন-সংগ্রামের প্লাবন বয়ে যায়। সরকারে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকারে শরিক হয়নি বিএনপি। বরং বাইরে থেকে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে যথার্থ সহযোগিতা দেয়। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠকের পর স্বস্তি ফিরে আসে। ইতোমধ্যে বিএনপি তার আন্দোলন ও সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাগত নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নেয়। অন্যসব বিরোধী দল অনুরূপ প্রস্তুতি নিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
নবগঠিত এনসিপি নির্বাচনের চেয়ে সংস্কার কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এবং সংস্কারের আইনগত কাঠামো নিশ্চিত করতে চায়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর এই দ্বন্দ্ব ও বিভাজন হ্রাস করার জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করছে।
অন্যদিকে বিএনপি প্রধান রাজনৈতিক দল হওয়ার কারণে যথাসম্ভব সমঝোতা নিশ্চিত করতে চাইছে। শহীদ জিয়াউর রহমান জাতীয় ঐক্যের জন্য যে পথ ও পাথেয় রেখে গেছেন, সেটিই বিএনপির ভবিষ্যৎ লক্ষ্য। সাম্প্রতিক সময়ে জিয়াউর রহমান অনুসৃত আদর্শ থেকে বিএনপির ব্যত্যয় ও বিস্মৃতি সম্পর্কে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ব্যক্ত হয়েছে। মানুষ বিশ্বাস করতে চায় জিয়াউর রহমানের আদর্শই বিএনপিকে চিরঞ্জীব রাখবে। সময়ের প্রয়োজনে কোনো তাৎক্ষণিক উচ্চারণ বিএনপিকে শহীদ জিয়ার চিরায়ত আদর্শ থেকে বিচ্যুত করবে না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, নির্বাচনের পূর্বাহ্ণে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা সনদ অর্জিত হবে। সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচনের পর একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি আগে-ভাগেই দিয়ে রেখেছেন বিএনপির কর্ণধার তারেক রহমান। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি তথা নির্বাচন-উত্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং সমৃদ্ধি অর্জনে প্রত্যাশিত জাতীয় সরকার নিশ্চিত ভূমিকা রাখবে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষ ও জনপ্রিয়তায় শক্তি বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নাগরিক সাধারণের এটাই প্রত্যাশা।