
আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বাধাদানকারীরা নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নির্বাচনে যাতে অন্য কোন দেশের থাবা মারার সুযোগ না থাকে সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন চেয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার বিকাল পাঁচটা থেকে দেড় ঘণ্টা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সাতটি রাজনৈতিক দল ও হেফাজত ইসলামের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা।
বৈঠকে একাধিক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শক্তির দলগুলোকে নিয়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি গঠনের পরামর্শ দেওয়া হয়। একই আগামী বড়-ছোট রাজনৈতিক দলের বৈষম্য না করে সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান জানান। বিগত তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের কার্যক্রম স্থগিতের দাবি জানানো হয় একাধিক দলের পক্ষ থেকে।
বৈঠক করা দলগুলো হল— এবি পার্টি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, এলডিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় গণফ্রন্ট। দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের স্ত্রী মারিয়া আক্তার সাক্ষাত করেন।
এর আগে গত রোববার বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে পৃথক বৈঠকে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি দেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবারের বৈঠকেও পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধান উপদেষ্টা। সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলের কাছে প্রধান উপদেষ্টা পরামর্শ চেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে একই সঙ্গে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র চলছেও বলে মন্তব্য করেন সরকার প্রধান। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য সাংবাদিকদের জানান প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে দিতে চায় না, তারা যত রকমভাবে পারে বাধা দেবে। বাংলাদেশের সত্তাকে গড়ে তুলতে তারা বাধা দেবে। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে নির্বাচন বানচাল করার। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে যাতে নির্বাচন না হয়। এগুলোর কিছু কিছু লক্ষণ এখন দেখা যাচ্ছে। সামনে আরো আসবে। এইজন্য আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে। আমাদের চেষ্টা হবে নির্বাচন করার এবং নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচিত সরকারের হাতে সরকারের হাতে আমরা ক্ষমতা হস্তান্তর করব।
এবারের অনন্য নির্বাচন হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচন নয়, দেশের সকল মানুষ ও রাজনৈতিক দলের নির্বাচন। এই নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা হল ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নির্মাণের। এই নির্বাচন হবে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর সাহস অর্জনের, নিজের ভঙ্গিতে দেশ পরিচালনার। এ নির্বাচন অন্য কোন দেশের থাবা মারার কোন সুযোগ যেন না থাকে। আমরা এই নির্বাচন আয়োজনে আপনাদের সর্বাত্মক সমর্থন চাই।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন প্রতি পদে পদে বাধা আসবে। সবার মনে দ্বন্দ তৈরি করার চেষ্টা করবে। আমরা যেন সঠিক থাকি, স্থির থাকি। সবাই একসাথে সহযোগিতা করি।
অন্তর্বর্তী সরকারের আচরণ কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ়তা এবং সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে মনে করে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বলেছেন, এটা দুর না হলে এবং তাদের কর্মকাণ্ডে দৃঢ়তা স্পষ্ট না হলে নির্বাচনের শঙ্কা কাটবে না। তিনি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।
নুরুল হক নুরের উপর হামলা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তুচ্ছ ঘটনায় সংঘটিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যো সমন্বয়হীনতার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে এটা খুবই দুঃখজনক। নির্বাচনে অতীতে যারা খুবই সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রয়োজনে তাদের চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া যায় কিনা তা বিবেচনার অনুরোধ জানান তিনি।
ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে। দৃশ্যমান অগ্রগতি আমরা দেখিনি। সারাদেশের সন্ত্রাস এখনই বন্ধ করেতে পারে না। সেখানে তিনশ আসনের নির্বাচনের জালভোট, ব্যালট বাক্স ছিনতাই কিভাবে বন্ধ করবে? এ আস্থা আসেনি। নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) ভিত্তিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি দলটি জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন আশরাফ আলী আকন। এ জন্য গণভোটের দাবি করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশ প্রশাসনিক কর্মকর্তা দলীয় উল্লেখ করেন এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ। তিনি বলেন, বিগত সরকার তাদের লোক এমনভাবে বসিয়েছে যে প্রশাসনের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত আছে। এটা নিরপেক্ষ করার জন্য সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। নির্বাচনের মাঠ প্রশাসনের বদলি লটারীর মাধ্যমে করার সিদ্ধান্তকে শিশু সুলভ বলেও উল্লেখ করেন তিনি। রেদোয়ান আহমেদ বলেন, দেশের কোথায় কেমন অবস্থা তার উপর নির্ভর করে দক্ষতার সঙ্গে বিবেচনা করে বদলি করতে হবে। অস্ত্র যেসব লুণ্ঠন হয়েছল সেগুলো এখনো পুরোপুরি উদ্ধার করা যায়নি। এই অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা না গেলে মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থাকবে না।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেছেন, সরকার যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, রাষ্ট্র পুনর্গঠন যথার্থ হয়নি। সেকারণে নানান সংকট তৈরি হচ্ছে। এতে রাজনৈতিক মহলে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। নির্বাচনের পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ঐকমত্য কমিশনে যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিনিধিত্ব করেছে তাদের নিয়ে এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন প্রয়োজন। এতে যেখানে যে ঘটনাগুলো ঘটনা সেই কমিটির সকলে মিলে ঠিক করবে। এখন থেকেই এটা কাজ শুরু করা দরকার।
জুলাই সনদে শাপলার গণহত্যা ও ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সহিংসতায় নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানির কথা রাখার দাবি প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব আজিজুর রহমান ইসলামাবাদী বলেন, আমরা দাবি জানিয়েছি সংবিধানে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল করতে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের চিহ্নিত ক্রিমিনাল, দোসরদের গ্রেপ্তার ও প্রশাসন হতে বহিষ্কারের প্রস্তাব করেছে সংগঠনটি।
গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, যারা এখন প্রশাসন ও বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান তারা কি আপনার সরকারে আনুগত্য প্রকাশ করছে? সহযোগিতা করছে? আমরা দেখছি করছে না। তাই আমরা বলেছি, এখানে দুটি সরকার কাজ করছে, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, আরেকটা অদৃশ্য সরকার। গণভোটের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণভোটের সুযোগ নেই। এখন যেহেতু রাজনৈতিক মহলে গণভোটের দাবি উঠেছে সেক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কি হবে?
নির্বাচন সমন্বয় কমিটির প্রস্তাবের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে রেপ্রস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রত্যেকটা পরামর্শ লিখে নিয়েছেন। সে অনুযায়ী তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। উনি বলেছেন এগুলো নিয়ে সামনে আরও বৈঠক হবে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশের বিষয়ে একাধিক রাজনৈতিক দলের আশঙ্কার বিষয়ে প্রেস সচিব বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে সব ধরণের প্রস্তুতি নিচ্ছি। নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এটা অনন্য নির্বাচন হবে উৎসবমুখর পরিবেশে। আমরা সকলে পরিবার পরিজন নিয়ে ভোট দিতে যাব। এ উৎসব যেন সারাজীবন মনে রাখে।