
‘একটা দুইটা শিবির ধর, সকাল-বিকাল নাশতা কর।’ একসময় জামায়াত শিবিরবিরোধী দলগুলো এরকম স্লোগান দিতো। বিশেষ করে ছাত্রলীগ। জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পরে এর ঠিক বিপরীতে গিয়ে আরও ভয়ঙ্কর স্লোগান দেয়া হয়, সেটি হলো: ‘একটা একটা লীগ ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’।
রাজনীতির মিছিলে প্রতিপক্ষ নির্মূলে এই ধরনের স্লোগান নতুন কিছু নয়। স্লোগানে স্ল্যাং ব্যবহারও নতুন নয়। কিন্তু সেই স্ল্যাং বা প্রতিপক্ষকে অসম্মানিত করতে গিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে এমন কিছু স্লোগান দেয়া হয়েছে, যা স্লোগানদাতাদের শিক্ষা, রুচি, মূল্যবোধ এবং সামগ্রিকভাবে তারা যেসব দলের নেতাকর্মী ও সমর্থক, তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। বিশেষ করে কিছু অশ্লীল স্লোগান নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এইসব স্লোগান শোনা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গাতেও, যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান-মুক্তবুদ্ধি এবং উন্নতি সংস্কৃতি চর্চা হওয়ার কথা।
গত ৯ জুলাই পুরান ঢাকায় লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ নামে এক ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ইডেন কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ ব্যানারে মিছিল হয়। এসব মিছিলের কোনো কোনোটিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে লক্ষ্য করে এমন কিছু অশ্লীল স্লোগান দেওয়া হয়—যার লিখিত রূপ এখানে উল্লেখ করা শোভন নয়। যেমন: ‘এক দুই তিন চার, তারেক জিয়ার…মার’; ‘টিনের চালে কাউয়া’, তারেক জিয়া…।’ ডট দিতে হলো কারণ এই শব্দগুলো লেখার উপযোগী নয়। যে শব্দ সংবাদমাধ্যমে লেখা যাচ্ছে না, সেই শব্দ সমস্বরে ছাত্র-তরুণ-শিক্ষিত সমাজ কী করে দেয়, এটি যেমন প্রশ্ন, তেমনি যারা এই ধরনের স্লোগান দেন বা দিতে পারেন, তাদের শিক্ষাদীক্ষা ও পারিবারিক মূল্যবোধ নিয়েও সংশয় তৈরি হয়।
মিছিল ও স্লোগানের সঙ্গে জনরুচির সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিটা দেশের মানুষের একটা সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ থাকে। ইউরোপে যে পোশাক কিংবা কথা বলার ক্ষেত্রে যে ধরনের স্ল্যাং স্বাভাবিক, বাংলাদেশে সেটি স্বাভাবিক নাও হতে পারে। ইউরোপে-আমেরিকার অনুকরণ করে আমাদের তরুণরা অনেক কিছুই বলার চেষ্টা করেন। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া পুরো পৃথিবীতে আঙুলস্পর্শ দূরত্বে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তারপরও প্রতিটা দেশ আলাদা, দেশের ভেতরে প্রতিটা সমাজ আলাদা। মূল্যবোধ, শিক্ষা ও জনরুচি মাথায় না রেখে কিছু বলা ও করার ভেতরে কোনো কৃতিত্ব নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু স্লোগান রাজনীতির বাইরে গিয়েও যেভাবে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও সহিংসতা উসকে দিয়েছে, তা শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর যেকোনো সভ্য দেশের মানুষের মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের পরিপন্থী। যেমন স্লোগান দেয়া হয়েছে ‘ধর্ষকের জন্য বিচার নয়, গুলি করো’, ‘গার্লফ্রেন্ড মানেই চরিত্রহীন’, ‘মেয়ে রাতে বাইরে মানেই খারাপ’ ইত্যাদি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে ও ভয়ঙ্কর স্লোগান বোধ হয় ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’। জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এই স্লোগান দেয়া হয়েছিল—যার একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা চাকরি পাবে না তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?’ এই বক্তব্যের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লোগান দেয়া হলো ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’। সমালোচনা শুরু হলে পরে এই স্লোগানের সঙ্গে আরেকটি লাইন যুক্ত করে বলা হলো: ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’
ধরা যাক শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে প্যারোডি করে বা তাকে ব্যঙ্গ করেই স্লোগানটি দেয়া হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষের জীবনে সবচেয়ে ঘৃণিত শব্দ হচ্ছে ‘রাজাকার’। কেউ রাজাকার তকমা পেতে চায় না। আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিরোধী মতের মানুষদেরকে রাজাকার ট্যাগ দেয়ার ভয়ঙ্কর প্রবণতা ছিল। ফলে তুমি ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দেয়ার পেছনে শেখ হাসিনার বক্তব্যের বাইরে ওই ট্যাগিংও হয়তো একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা যাই বলুন না কেন, যে ভাষাতেই বলুন না কেন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়ার বাংলাদেশের কোনো নাগরিক, যার ভেতরে ন্যূনতম দেশপ্রেম আছে, তিনি কি ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দিতে পারেন—যে রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর হিসেবে এই দেশের অগণিত মানুষের হত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল! প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও কি এটা বলা যায় যে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’? সুতরাং, প্রতিবাদের ভাষা কিংবা ব্যঙ্গ করার স্বাধীনতা মানেই যা খুশি বলা নয়। প্রতিবাদ মানেই আরেকজন মানুষকে অসম্মানিত করা নয়। প্রতিবাদ মানে জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ বা হেয় করে, এমন কোনো স্লোগান দেয়া নয়।
২.
স্লোগান হচ্ছে মিছিলের কবিতা। সাধারণত এর দুটি লাইনে অন্ত্যমিল থাকে। আবার নাও থাকতে পারে। যেমন: অন্ত্যমিলসহ স্লোগান: ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা।’ অন্ত্যমিল ছাড়া স্লোগান: ‘রাষ্ট্র ভাষা রাষ্ট্র ভাষা, বাংলা চাই বাংলা চাই।’ ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও।’ অন্ত্যমিল না থাকলেও এগুলোর ভেতরে ঝংকার আছে। শক্তি আছে। উদ্দীপনা আছে। মূলত এইধরনের স্লোগানই যুগে যুগে মানুষকে ঘরের বাইরে নিয়ে এসেছে। আন্দালনের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। শারীরিকভাবে দুর্বল মানুষও মিছিলের ভিড়ে এসে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।
১৯৬৮-৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টিতে স্লোগানের রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে সৃষ্ট স্লোগানসমূহ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশে— এবং এভাবে সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব জাগরণ। এ সময়ের কয়েকটি ঐতিহাসিক স্লোগান হচ্ছে— ‘তোমার দফা আমার দফা, এগারো দফা এগারো দফা’, ‘এগারো দফার ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোল’, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’, ‘জয় জয় হবে জয়, বাংলার হবে জয়’, ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’ ইত্যাদি। ছাত্রদের মিছিলে মিছিলে উচ্চারিত জনপ্রিয় স্লোগান ছিল— ‘আইয়ুব-মোনেম ভাই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই’। এ সময় গোপন বামপন্থীদের মুখে উচ্চারিত হতো ‘মুক্তির একই পথ, সশস্ত্র বিপ্লব’, ‘কৃষক শ্রমিক অস্ত্র ধর, জনগণতন্ত্র কায়েম কর’।
স্লোগান কখনো উদ্ভূত হয় তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে— কখনো বা সুচিন্তিত উপায়ে। জনতার মিছিল থেকে উচ্চারিত হয় স্লোগান— তার কোনোটি লাভ করে জনপ্রিয়তা, আবার কোনোটি বা হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। জনপ্রিয় স্লোগানটি প্রবহমান থাকে যুগের পর যুগ জনমানুষের কণ্ঠে— ক্রমে তা হয়ে ওঠে ইতিহাসের অংশ। স্লোগানের বিষয় ও ভাষা বিশ্লেষণ করলে বিশেষ সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়া যায়। বস্তুত স্লোগানের ভাষার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারা। গণমানুষের ন্যায়সংগত দাবি আদায়ের অন্যতম উপায় স্লোগান। সে সূত্রে আন্দোলন ও স্লোগান শব্দদ্বয় অঙ্গাঙ্গিভাবে একাত্ম। (বিশ্বজিৎ ঘোষ, কালের কণ্ঠ, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২)।
তবে মিছিল ও স্লোগানের সঙ্গে জনরুচির সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিটা দেশের মানুষের একটা সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ থাকে। ইউরোপে যে পোশাক কিংবা কথা বলার ক্ষেত্রে যে ধরনের স্ল্যাং স্বাভাবিক, বাংলাদেশে সেটি স্বাভাবিক নাও হতে পারে। ইউরোপে-আমেরিকার অনুকরণ করে আমাদের তরুণরা অনেক কিছুই বলার চেষ্টা করেন। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া পুরো পৃথিবীতে আঙুলস্পর্শ দূরত্বে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তারপরও প্রতিটা দেশ আলাদা, দেশের ভেতরে প্রতিটা সমাজ আলাদা। মূল্যবোধ, শিক্ষা ও জনরুচি মাথায় না রেখে কিছু বলা ও করার ভেতরে কোনো কৃতিত্ব নেই।
কোরিয়ার মানুষের কাছে কুকুরের মাংস উপাদেয় খাদ্য হলেও বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটা অপছন্দের। আবার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মানুষ রসিকতা করে কিংবা রাগান্বিত হয়েও যেসব স্ল্যাং ব্যবহার করে, সেগুলো স্লোগানের ভাষা হতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের দেশে স্লোগানের ভাষায় পরিবর্তন আসতে আসতে সেগুলো অশ্লীলতায় পর্যবসিত হয়েছে। অথচ জুলাই অভ্যুত্থানেই এখানে অনেক শোভন ও সুন্দর স্লোগান ছিল—যার ভেতরে দ্রোহ ছিল, উদ্দীপনা ছিল আবার একইসঙ্গে শালীনতাও ছিল। যেমন ‘লাখো শহীদের দামে কেনা, দেশটা কারও বাপের না’, ‘এক দুই তিন চার, শেখ হাসিনা গদি ছাড়’, ‘এক দফা, এক দাবি, স্বৈরাচার তুই কবে যাবি’, ‘লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে’, ‘তুমি কে আমি কে বিকল্প বিকল্প’ ইত্যাদি।
অধ্যাপক ফাহমিদুল হক রবিবার একটি জাতীয় দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, স্লোগানে গালির প্রথম উপস্থিতি দেখা যায় ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে। সারা পৃথিবীর জেন–জিরা নিজেদের প্রকাশভঙ্গির প্রক্রিয়ায় মাঝেমধ্যে গালি ব্যবহার করে। আগের জেনারেশনের জন্য বিষয়টা অবশ্যই অস্বস্তিকর। তবে অন্য সৃজনশীল স্লোগানের পাশাপাশি প্রকাশভঙ্গিতে খানিকটা গালির ব্যবহার বাড়তি ক্রোধ প্রকাশে সহায়ক হয়। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঘন ঘন এর ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি আর লুকিয়ে রাখা মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে নেই; বরং তা অস্বস্তিকর থেকে বিরক্তিকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে। (প্রথম আলো, ১৭ আগস্ট ২০২৫)
এটা ঠিক যে, স্লোগান শুধু রাজনৈতিক দলগুলো নয়, বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষও অনেক সময় প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্লোগান তৈরি করে। অনেক স্লোগান দেয়ালের ভাষা হয়ে ওঠে। মানুষের টি শার্টে জায়গা পায়। প্রতিটা স্লোগান ওই সময় ও সমাজকে ধারণ করে। সমাজের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ, হতাশা, রাগ ও প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। অনেক সময় এসব স্লোগানের পেছনে সরকারের ব্যর্থতা তথা সুশাসন ও গণতন্ত্রহীনতাও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। কিন্তু তারপরও খেয়াল রাখতে হয়, কোনো স্লোগানই যাতে সহিংসতা উসকে না দেয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি তৈরি না করে। ব্যক্তিগত আক্রমণ না হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অনেক স্লোগান এই রীতিনীতির বৃত্ত ভেঙে দিচ্ছে—যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।