
এম আবদুল্লাহ
এক বছর আগে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, দেশের অবস্থা খুবই খারাপ। টিভি টকশো এবং সভা-সমাবেশে অনেক বক্তা ড. ইউনূসকে পুরোপুরি ব্যর্থ হিসেবে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করছেন। অনেকে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করছেন।
৩১ জুলাই রাতে একটি বেসরকারি টিভি টকশোতে হালের তুখোড় আলোচক ড. ইউনূস সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক সহনীয় পর্যায়ে আনতে না পারাকে বড় ব্যর্থতা চিহ্নিত সরকারকে তুলাধুনা করেন। তার ভাষায়—এ ব্যর্থতার ফলে রপ্তানি-বাণিজ্য ধসে পড়বে। শুক্রবার সকালেই জানা গেল, বাংলাদেশের জন্য পাল্টা শুল্ক ১৫ শতাংশ কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। দক্ষতার সঙ্গে দর-কষাকষি করে এই অসামান্য অর্জন করেছে বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। যেকোনো মানদণ্ডে এটা বড় কূটনৈতিক সাফল্য। এ অর্জন টকিস্ট বা সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের সন্তোষজনক প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ল না। সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ দেওয়া তো দূর কি বাত। আমরা এমনই।
দেড় সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার আত্মদানের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। নোবেলজয়ী বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার আকাশছোঁয়া প্রত্যাশার চাপ নিয়ে ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয়। এক বছরের অন্তর্বর্তী শাসনে সবচেয়ে বড় সাফল্য বা মোটা দাগে ব্যর্থতা কোন কোন ক্ষেত্রে, তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা অস্বাভাবিক নয়।
আইনশৃঙ্খলার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি, এটি স্বীকার করতেই হবে। পুলিশের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। যৌক্তিক অনেক কারণ সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে আরো নিবিড় তদারকি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার ছিল। আইন উপদেষ্টা দুদিন আগে বলেছেন, মব সন্ত্রাস ও ঢালাও মামলাই বর্তমান সরকারের সময়ে অন্যতম নেতিবাচক চিত্র। মব শব্দটি নতুন করে প্রচলন ঘটেছে। যেসব ঘটনাকে মব বলে চালানো হচ্ছে, একই ধরনের অসংখ্য ঘটনা গত পনেরো বছরে ঘটলেও সেগুলো ‘মব’-এর মর্যাদা পায়নি। আর গায়েবি মামলায় পতিত হাসিনা সরকারের শিরোপা কেউ কোনো দিন কেড়ে নিতে পারবে না। নতুন বাংলাদেশে এর যেকোনো পরিবর্তনই হয়নি, তা বললে অবিচার হবে।
এখন আর পুলিশ বা সরকার কোনো ঢালাও আসামি করছে না। গায়েবি মামলা হয়েছে একটিও, এমনটি জানা নেই। আবার এক বছরে পুলিশের ওপর অন্তত ২৫০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ পুরোদমে সক্রিয় না হওয়ার এটাও একটি কারণ।
সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেপ্তার না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে। গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পরিবারকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে জানানো হয়, আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ, নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির করা, রিমান্ডের সময় বেঁধে দেওয়াসহ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীসহ ফৌজদারি কার্যবিধি সংস্কার উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত হয়েছে। এটা সুশাসন, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই দিতে না পারার ব্যর্থতা উপেক্ষার নয়। সরকার বলেছে—দেশে বই মুদ্রণের প্রয়োজনীয় কাঠামো গত ১৫ বছরে ধ্বংস করে ভারত থেকে ছাপা হচ্ছিল। নিজেদের পাঠ্যবইটিও নিজেরা মুদ্রণের সক্ষমতা না থাকার গ্লানি মুছে তা যে দেশের ছাপাখানায় ফিরিয়ে আনা গেছে, এটিও সাফল্য হিসেবে দেখছে। উপরন্তু সব পাঠ্যবই এবার পরিমার্জন করতে হয়েছে ব্যাপকভাবে। ফলে সময় লেগেছে। মাত্র তিন মাসের প্রস্তুতিতে এতগুলো পাঠ্যবই পরিমার্জিত আকারে প্রকাশ কম চ্যালেঞ্জের নয়। অতীতেও ১ জানুয়ারি বই দিতে না পারার ঘটনা ঘটেছে বহুবার।
করবৃদ্ধি রেস্তোরাঁর খাবার, মিষ্টি, পোশাক, নন-এসি হোটেল, বিস্কুট, আচার, মেট্রেস, ট্রান্সফরমার, টিস্যু পেপারসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। আইএমএফের শর্ত মানতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্কবৃদ্ধি ও ভ্রমণ কর বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি একদিকে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে, অন্যদিকে ভোক্তাপর্যায়ে অস্বস্তি এবং অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
অর্থনীতির দিকে নজর দিলে দেখা যাবে লুটপাট থামিয়ে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাওয়াকে অনেকে বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন। অর্থনীতির ক্ষত অনেকটাই শুকিয়েছে বলে মত দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। রিজার্ভ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৩০ বিলিয়ন ছুঁয়েছে। স্থবিরতা কাটিয়ে গত জানুয়ারি থেকে মার্চ—তিন মাসে এফডিআই বা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১৪ শতাংশ বেড়েছে। রপ্তানি খাতে এখনো আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধি আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৮ শতাংশ। শীতল সম্পর্কের মধ্যেও প্রতিবেশী দেশ ভারতে রপ্তানি বাড়ার খবর দিয়েছে সংবাদপত্র।
রেমিট্যান্স তো রেকর্ড ভেঙে রেকর্ড গড়ছে। রিজার্ভে হাত না দিয়েই বড় অঙ্কের আন্তর্জাতিক দেনা পরিশোধ করা হয়েছে। দেউলিয়া-প্রায় ব্যাংকগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে স্থিতিশীল পর্যায়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি হয়েছে। এস আলমের দখলমুক্ত করা পাঁচটি শরিয়াহ ব্যাংককে একীভূত করার প্রক্রিয়া চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নীতির কারণে তিন মাসে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের মধ্য দিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। আতঙ্কে তুলে নেওয়া গ্রাহকদের ২১ হাজার কোটি ব্যাংকে ফিরেছে আস্থা ফেরার মধ্য দিয়ে।
অনেকগুলো ঘটনা সরকারকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়েছে। সাময়িকভাবে টালমাটাল পরিস্থিতিতে পড়েছিল সরকার। তবে সহসাই সামলে নিতে পেরেছে। সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুনে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র পুড়ে যাওয়ার ঘটনাটি সরকারকে নাড়া দিয়েছে। দক্ষিণ সিটিতে বিএনপি নেতা ইশরাককে মেয়র হিসেবে বসানো নিয়ে টানা অবরোধ এমনকি প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাও করে বিএনপি নেতাকর্মীদের শক্তি প্রদর্শন পরিস্থিতিতে নাজুক করে তুলেছিল। একপর্যায়ে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর কথাও ভেবেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এছাড়া এনসিপির সমাবেশ ঘিরে গোপালগঞ্জে ভয়াবহ সহিংসতা ও প্রাণহানি, ঢাকার মিটফোর্ডে এক ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে পাথর-খণ্ড দিয়ে আঘাতে আঘাতে হত্যা, মাইলস্টোন স্কুলে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে ৩০ জনের অধিক শিক্ষার্থী, শিক্ষকের মর্মান্তিক মৃত্যু, শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে বিপুলসংখ্যক উচ্ছৃঙ্খল তরুণের সচিবালয়ে ঢুকে নৈরাজ্য সৃষ্টি, চট্টগ্রামের আদালতে চিন্ময় কৃষ্ণের সমর্থকদের তাণ্ডব ও আইনজীবী হত্যা, আনসার বাহিনীর বিপুল সদস্যের সচিবালয় আক্রমণ, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে দেশজুড়ে সমাবেশ এবং ঢাকামুখী লংমার্চ ঘোষণা, আদিবাসী ছাত্র-জনতার নামে সহিংস বিক্ষোভ, রেলকর্মীদের কর্মবিরতি, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাবি শিক্ষার্থীদের সংঘাত, সিএনজি অটোরিকশা-চালকদের রাজধানীজুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ বাতিল হওয়া শিক্ষকদের সহিংস আন্দোলন, মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উত্তাল বিক্ষোভ, পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের অবরোধে শহরে শহরে অচলাবস্থা, নূর হোসেন দিবসে আওয়ামী লীগের ঢাকা মার্চ কর্মসূচি ভন্ডুল, নিষিদ্ধঘোষিত হিযবুত তাহরীরের ব্যানারে পতিত শক্তির মাঠে নামার অপচেষ্টা, গাজীপুর ও জামালপুর কারাগারে বিক্ষোভ ও গুলি, জামালপুর কারাগারে ছয় বন্দির মৃত্যু, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ সামলাতে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে সরকারকে। এছাড়া পাহাড়ে উসকে দেওয়া রক্তক্ষয়ী সংঘাত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।
শিল্পকারখানার শ্রমিকদের এক বছরে প্রায় শতবার মহাসড়ক অবরোধ, সরকারি কর্মকমিশনে নিয়োগ দিয়ে বিতর্কের মুখে ছয়জনের নিয়োগ বাতিল করতে বাধ্য হওয়া সরকারকে কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। নির্বাচনের সময় নিয়ে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে টানাপড়েন সংকটকে ঘনীভূত করলে লন্ডনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে আলোচিত বৈঠকের মাধ্যমে সংস্কার এবং বিচারে সন্তোষজনক অগ্রগতি সাপেক্ষে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্য হয়। জনমনে ফিরে আসে স্বস্তি।
দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকার বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে দেশের কয়েকটি এলাকায় দফায় দফায় বিধ্বংসী বন্যার আঘাতে। এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সরকারকে বেশ চাপে ফেলেছে। তার রেশ এখনো রয়ে গেছে। নিত্যপণ্যের বাজারে মাঝেমধ্যে স্বস্তির সুবাতাস পাওয়া গেলেও বেশির ভাগ সময় মানুষ অস্বস্তি ও চাপে পড়েছে। তবে রমজান মাসে কোনো পণ্যের দাম না বাড়ায় প্রশংসা কুড়িয়েছে সরকার। ঈদযাত্রায় ভোগান্তি কমিয়ে আনতে পারাও মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে।
কঠিন চ্যালেঞ্জ ও নানা শঙ্কা সত্ত্বেও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা ও তার দলের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের প্রচারের ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আদালত অবমাননার একটি মামলায় শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয় মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রথমবারের মতো আপিল বিভাগে দুটি চেম্বার আদালতে বিচারকাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দায়িত্বের শুরুর দিকটায় যে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা ভুলে গেলে চলবে কী করে? দলবাজ প্রধান বিচারপতিসহ ছয় বিচারপতির পদত্যাগ, সৈয়দ রেফাত আহমদকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ইউজিসির চেয়ারম্যান ও সদস্য, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দলবাজ ভিসি, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন চেয়ারম্যানের পদত্যাগের ঘটনা ঘটে সরকারের ক্ষমতাগ্রহণের দুদিনের মধ্যেই সম্পন্ন করতে হয়েছে। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও সিইসি হাবিবুল আউয়ালসহ তার পুরো কমিশনের পদত্যাগও কম চ্যালেঞ্জের ছিল না। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করার পর নির্বাচনী প্রস্তুতি গতি পেয়েছে। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে তেমন কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। মুখ থুবড়ে পড়া মেট্রোরেল অবিশ্বাস্য সাশ্রয়ে চালু করতে পেরেছে স্বল্পসময়ের মধ্যে। জামায়াত ও শিবির নিষিদ্ধের আদেশ বাতিল করে চাপ সামাল দিতে হয়েছে।
দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের পদত্যাগ এবং নতুন চেয়ারম্যান এবং কমিশনার নিয়োগ করে দুর্নীতির বিচারে গতি সঞ্চার করা সম্ভব হয়েছে। এক বছরের মধ্যে দুদক পতিত শেখ হাসিনা সরকারের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ৭৬৮টি অভিযোগ তদন্ত করে ৩৯৯টি মামলা করেছে। প্রভাবশালী আমলা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১৪৪ মামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ৪৪টি মামলা হয়। দুদকে মোট অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে ৩২১টি।
গণতন্ত্র, নির্বাচন ও বিচারব্যবস্থা ধ্বংসকারী অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করা, আওয়ামী আমলের দলীয় অনুগতদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, পতিত সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও হেভিওয়েট নেতাদের গ্রেপ্তার করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা, ১৫ আগস্টের ছুটি বাতিল, সাবেক দুই আইজিপিসহ দলবাজ ও খুনি পুলিশ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতি এবং অনেককে গ্রেপ্তার, সিইসি হাবিবুল আউয়াল ও নুরুল হুদাকে গ্রেপ্তার এবং আদালতে তাদের স্বীকারোক্তি, তিন নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বপালন করা জেলা প্রশাসকদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো, ফ্যাসিবাদী শাসনে বিভিন্ন কারণে চাকরিচ্যুত ১ হাজার ৫২২ পুলিশ সদস্যকে চাকরিতে পুনর্বহাল, একতরফা ও তামাশার নির্বাচনে গঠিত স্থানীয় সরকার পরিষদ থেকে ১ হাজার ৮৭৬ আওয়ামী প্রতিনিধিকে অপসারণের মতো বিষয়গুলো খাটো করে দেখার সুযোগ কোথায়?
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ অনুসমর্থন করেছে সরকার। বিগত সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান ও গুমে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশনের একাধিক প্রতিবেদন শেখ হাসিনা ও তার গুমবাহিনীর মুখোশ উন্মোচন করেছে। এক বছরে কোনো গুমের ঘটনা ঘটেনি।
শেখ হাসিনা, জয়, পুতুল, ববিসহ শেখ পরিবারের লুটেরাদের বিরুদ্ধে মামলা, ব্যাংক হিসাব জব্দ, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও ইন্টারপোলকে চিঠি, শেখ পরিবারের সদস্যদের জন্ম-মৃত্যু, ভাষণসহ সংশ্লিষ্ট আটটি জাতীয় দিবস বাতিল করে সরকারি অর্থের অপচয় এবং অপব্যয় রোধ, হাইকোর্টের ১২ দলবাজ বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা, কয়েকজনকে অপসারণ অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল, ত্রয়োদশ সংশোধনী বহালের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের লুটেরাদের দায়মুক্তি দিয়ে করা আইনের সংশ্লিষ্ট দুটি ধারা বাতিল, জয়বাংলা জাতীয় স্লোগান হিসেবে বাধ্যতামূলক করে দেওয়া রায় স্থগিত করা, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ আইন, সুপ্রিম কোর্টের স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত আইনাঙ্গনে স্বস্তির বার্তা দিয়েছে।
জনতুষ্টিমূলক পদক্ষেপের মধ্যে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা ও দুর্গাপূজায় ছুটি বৃদ্ধি, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের উৎসবভাতা ২৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশে উন্নীত করা হয়, সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদেরও ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বেড়েছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শূন্য পদে ১ লাখ ৮২২ জন শিক্ষক নিয়োগের কার্যক্রম চলছে, দামে লাগাম টানতে সয়াবিন ও পামওয়েলে শুল্কছাড়, চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার, চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২-এ উন্নীত করা, সরকারি চাকরিতে আবেদনের ফি কমানো, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলা র্যাব থেকে পিবিআইতে স্থানান্তর এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন, ৭৭৮ প্রভাবশালীর অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল, শেখ পরিবারের নামে করা প্রায় এক হাজার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন, শেখ হাসিনাসহ ৯৭ জনের পাসপোর্ট বাতিল, শেখ মুজিবের ছবিযুক্ত নোটের পরিবর্তে বিভিন্ন মূল্যমানের নতুন নোট প্রবর্তন, পুলিশের লোগো থেকে নৌকা বাদ দিয়ে নতুন লোগো চূড়ান্ত করা হয়, কক্সবাজারে জনপ্রশাসন একাডেমির নামে ৭০০ একর বনভূমির বন্দোবস্ত বাতিল করেছে সরকার। ১২ সাবেক সচিব ও বিচারককে তুষ্ট করতে বরাদ্দ করা বিলাসবহুল ফ্ল্যাট বাতিল করেছে।
কবি নজরুলকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি, মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলে আনন্দ শোভাযাত্রা করা হয়, পাঠ্যবইয়ে এক ব্যক্তির সব কৃতিত্ব ও বন্দনার পরিবর্তে সব জাতীয় নেতাদের প্রাপ্য সম্মান নিশ্চিত করা হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পদোন্নতি-বঞ্চিত জনপ্রশাসনের ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়ে বঞ্চনার প্রতিকার ও প্রশাসনে ভারসাম্য আনার চেষ্টা হয়েছে। ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনে ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে এবং হজ প্যাকেজের ব্যয় কিছুটা হলেও কমিয়ে প্রশংসিত হয়েছে।
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাওয়া হজযাত্রীদের নির্ধারিত প্যাকেজ মূল্য থেকে অর্থ সাশ্রয় হওয়ার পর তা ফেরত দেওয়া হয়েছে। হত্যা মামলায় খালাস পেয়েও বিস্ফোরক আইনের মামলায় কারাগারে থাকা বিডিআরের সাবেক ১৭৫ সদস্য জামিনে মুক্তি, ইবতেদায়ি মাদরাসা পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের ঘোষণা করা হয়েছে। এনজিও নিবন্ধন সহজতর করা হয়েছে। সিলেট থেকে প্রথমবারের মতো কার্গো বিমান চালু করায় রপ্তানি-বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সরকার জুলাই-আগস্টের গণহত্যার তদন্তে জাতিসংঘ-নেতৃত্বাধীন একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং (তথ্য অনুসন্ধান) মিশনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। স্থানীয়ভাবে পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গণহত্যার তদন্ত করে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তা দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। পতিত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের ওই রিপোর্ট অকাট্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
নতুন বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করছে। এখন আর সংবাদ ও টকশোতে দৃশ্য-অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপ নেই। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রোধ করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন থেকে বিতর্কিত ও নিপীড়নমূলক ৯টি ধারা বাতিল, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো পর্যালোচনা এবং আর্থিক সংকটে থাকা সাংবাদিক, গণঅভ্যুত্থানে শহীদ সাংবাদিক পরিবার ও আহতদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।
কূটনৈতিক সাফল্য পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে—অধ্যাপক ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জনে সমর্থ হয়েছে। ফ্যাসিবাদী শক্তিকে ফেরানোর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের চেষ্টা ভন্ডুল হয়ে গেছে ইউনূস-ম্যাজিকে। সংস্কার উদ্যোগকে প্রায় সব দেশ অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানসহ কয়েকটি বিদেশ সফরে ড. ইউনূস ব্যাপকভাবে নন্দিত ও সম্মানিত হয়েছেন। বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সংস্থা বিপুল অঙ্কের ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ব্যাংককে ড. ইউনূস ও মোদির মধ্যে ৪০ মিনিটের তাৎপর্যপূর্ণ বৈঠক হয়। সেখানে দিল্লিতে পলাতক শেখ হাসিনাকে ফেরত চান ড. ইউনূস। চুপ থাকেন বিব্রত মোদি।
অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উপদেষ্টা ও শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। এটাও আপাত সাফল্য হিসেবে গণ্য হতে পারে। একজন উপদেষ্টার এপিএস নিয়ে অভিযোগ উঠলে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার পর দুদক তদন্ত করছে। এ নিয়ে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা হলেও এখনো প্রমাণিত নয়।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট