
অদ্ভুত টানাপোড়েন চলছে। ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’ ফ্লপ করেছে। কারণটা পরিষ্কার, আদের আচরণগত সকল কিছুর সাথে আমাদের প্রচলিত সংস্কৃতির বৈপরীত্য। তাছাড়া তারা মৈত্রী যাত্রায় কোনো রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করতে পারেনি। যা করেছে, তাতে সম্ভবত তারাও কনফিউজড। মূলত এটা পরিণত হয়েছিল সিপিবি ঘরানার প্রতিটা ফ্লপ শো’র মতন। সমাজে একদম সাড়া জাগাতে পারেনি এই যাত্রা, এমনকি নারীদের মাঝেও। মূলত এই যাত্রার মঞ্জিল নিয়ে রয়েছে নানান প্রশ্ন। সঙ্গতই টানাপোড়েন যুক্ত হয়েছে সেসব প্রশ্নে।
আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখানেও টানাপোড়েন রয়েছে। কারণ সরকার গঠনের পরপরই বলা হয়েছিল বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কোনো কার্যক্রম চালাতে পারবে না। কিন্তু সেই কথাকে আইনে রূপ দেয়া হয়নি। বিপরীতে যারা এতদিন আওয়ামী লীগের চরম বিরোধী ছিল, তারাই আওয়ামী লীগের মিত্রতে পরিণত হয়েছিল নিষিদ্ধের প্রশ্নে। বিএনপি’র কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে রাজনৈতিক দলের নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে বক্তব্য দিয়েছিলেন। বিএনপি চেয়ারপার্সনের এক উপদেষ্টা তো রীতিমতো ঝড় তুলে ফেলেছেন নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে। সিপিবি ধরনের বামেরাও নিষিদ্ধ ঘোষণার বিপক্ষে আলাপ তুললো। তাতেও তারা থেমে থাকলো না, সারাজীবন আওয়ামী লীগের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা এই বামেরা বসলো বিএনপি’র সাথে এক টেবিলে। এটাও তো এক ধরনের টানাপোড়েন। বিএনপি আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলছে, আওয়ামী লীগের হাছান মাহমুদকে দেখলাম, এক্সাইল লাইফে বিএনপিকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব দেখানোয়। সিপিবি’র অবস্থা সঙ্গতই ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’। সুতরাং টানাপোড়েন।
এদিকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যমুনা থেকে শাহবাগ পর্যন্ত আন্দোলন হলো। এনসিপি, জামায়াত, চরমোনাই পিরের দলসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠন আন্দোলনে যোগ দিলো। জমে উঠলো আন্দোলন। সবাই বিএনপিকে আহ্বান জানালো আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য, কিন্তু বিএনপি ছিল নিশ্চুপ। বিএনপির কোনো কোনো নেতা বললেন, শাহবাগে যাবেন না, শাহবাগী ট্যাগমুক্ত থাকবেন। অথচ নিষিদ্ধ হওয়ার পর বললেন, তারা আনন্দিত।
বিএনপি যদি শাহবাগে যেত কিংবা আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করতো তাহলেও সেদিন শাহবাগে বেগম খালেদা জিয়ার নামে স্লোগানে প্রকম্পিত হতো। শাহবাগ সেদিন কার্যতভাবেই পরাজিত হত ভারত এবং ভারতের সম্পূরক ফ্যাসিবাদবিরোধীদের পদভারে, স্লোগানে। যে শাহবাগে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই শাহবাগেই ফ্যাসিবাদকে সম্পূর্ণ পরাজিত করার পরম মুহূর্ত ছিল সেদিন। কিন্তু ওই যে টানাপোড়েনে ট্রেন মিস। সেদিন দেখেছি বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মলিন মুখ। এই মুখ বাড়িতে বসে থাকা অনেক নেতাই দেখতে পাননি। এটাও তো এক ধরনের টানাপোড়েন। যে টানাপোড়েন শেষ পর্যন্ত ব্যাখ্যা দিতে হয়, কেন শাহবাগে যাওয়া হয়নি। এই যে যারা ব্যাখ্যার মতন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেন, তাদের চিন্তার দূরদর্শিতা নিয়েও তো টানাপোড়েন।
এক ‘বিশাল’ সাংবাদিক, যাকে ইদানীং প্রায় টকাশোতেই দেখা যায়, তিনিও নিশ্চিত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে বরং আওয়ামী লীগই শক্তিশালী হয়েছে। তার কথার সাথে এক্সাইলে থাকা এক সোকল্ড ব্যারিস্টারের কথা মিলে যায়, নিষিদ্ধের প্রতি নাকি মানুষের আকর্ষণ বেশি। কথাটা বোধহয় সর্বাংশে ঠিক নয়, ‘আমরা বেশ্যা’ বলে যারা মৈত্রী যাত্রায় যোগ দিলো, তাদের সাথে কিন্তু মানুষকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখা যায়নি। সুতরাং সব নিষিদ্ধের সাথে ‘শক্তিশালী’ কথাটা সম্ভবত যায় না। নিষিদ্ধের প্রতি মানুষের এক ধরনের আকর্ষণ থাকে, সেই আকর্ষণও কিন্তু নিষিদ্ধ। গোপনে, লোকচক্ষুর আড়ালে যা প্রদর্শিত হয়। যারা প্রকাশ্যে প্রদর্শন করেন, তাদের মানুষ প্রকাশ্যে পরিত্যাগ করে। গোপনে আপন করে নেয়ার মধ্যে কোনো লেজিটিমেসি থাকে না। সুতরাং এখানেও টানাপোড়েন।
উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। মূলত এই টানাপোড়েনের শুরুটা তাকে ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলা নিয়ে। এমনিতেই বুড়োরা তরুণদের বিপ্লবের নেতা হিসেবে মানতে চায়নি। যেমন বিএনপির সুপ্রিমো তারেক রহমানকেও একসময় বিএনপির অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারাও মানতে চাননি। কিন্তু এখন আর না মেনে উপায় নেই। একইভাবে জুলাই বিপ্লবের নেতাদেরও বুড়োরা মানতে চায়নি, মেনে নিতে পারেনি। কারণ তাদের নেতৃত্ব এই তরুণদের সামনে দৃশ্যমান পর্যুদস্ত হয়েছে। বিপ্লব সাহসীদের বরণ করে নেয়, ভীতুদের নয়। সুতরাং সাহস ও ভীরুতার মধ্যে টানাপোড়েনই মাহফুজ আলমকে বিতর্কিত এবং পর্যুদস্ত করার প্রয়াস।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খোদ ভারতই টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করা। কিন্তু এখন তারা চিন্তায় সীমান্তে দুটি বৈরী জনগোষ্ঠী ও দেশ সৃষ্টি হলো কিনা এ বিষয়ে। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে দেশের ক্ষুদ্র একটা অংশ বিরোধী ছিল। বৃহৎ অংশটি ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। কিন্তু এই পক্ষশক্তির মধ্যেও বিভাজন ছিল। এখানেও একটা ক্ষুদ্র অংশ ছিল ভারতের চিন্তার সাথে টিউনড। তারা মূলত ভারতের সাথে মিলে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে চেয়েছিল। তাদের চিন্তায় ছিল না, স্বাধীনতা পরবর্তী একটি দেশকে কীভাবে পুনর্গঠন করতে হয়। যারফলেই স্বাধীনতা পরবর্তীতে আমাদের অবস্থা হয়েছিল লেজগোবরে। এখানেও সেই টানাপোড়েন।
আমাদের রাজনীতি টানাপোড়েনের মধ্যেই চলছে। প্রতিটি বিপ্লবের পরই এই টানাপোড়েন থাকে। ফরাসি বিপ্লবের পর দেশ মোটামুটি স্ট্যাবল হতে এক দশকের বেশি সময় লেগেছিল। একটা ফ্যাসিস্ট রেজিম যখন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন ফ্যাসিজমে রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিউনড হয়ে যায়। নতুনভাবে টিউন করতে তখন বেগ পোহাতে হয়। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারকে যেমন পোহাতে হচ্ছে। একটা বড় রাজনৈতিক পক্ষশক্তি সরকারের কিছু কাজে বিরোধিতা করছে আর বাকি কাজেও সরকার তাদের সহযোগিতা পাচ্ছে না। অথচ ড. ইউনুসকে বিপ্লবের পর ডেকে আনা হয়েছে। অনেকটা জোর করেই তাকে সরকারপ্রধান করা হয়েছে। এছাড়া উপায়ও ছিল না। আন্তর্জাতিকভাবে এতটা প্রভাবশালী বাংলাদেশের রাজনীতি কিংবা রাজনীতির বাইরেও কেউ ছিলেন না। তাই সবদিক দেখেই ড. ইউনুসকে সরকারপ্রধান করা হয়েছে। অথচ এখন ব্লেইমিং চলছে তিনি নাকি ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চাইছেন। এ অবস্থায় যদি ড. ইউনুস পদত্যাগ করেন, তাহলে কী হবে? কে সামলাবেন আন্তর্জাতিক চাপ? আর ভারতের অসহনীয় চাপ তো রয়েছেই। আর ভারতের চাপ সয়ে যদি কেউ ক্ষমতায় থাকতে চায়, তাহলে তো তাকেও ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে হবে। তাকে মানতে হবে, আমাদের দেশের বুক চিরে করিডোর, রেলপথ, ট্রানজিট, বাণিজ্য বৈষম্য, পানি বৈষম্যসহ সব অপকর্মকে। আর অপকর্মের বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদ জানালে আবার চালাতে হবে গুলি। আবার করতে হবে রাতের নির্বাচন। সুতরাং রাজনৈতিক টানাপোড়েনে না থেকে, ভাবতে হবে। চিন্তা করতে হবে দেশের ভবিষ্যতের কথা। ৩৬ জুলাইয়ের নতুন ভোরকে আবার পুরানো রাতের কাছে বন্দি হতে দেয়া যাবে না। কথা পরিষ্কার, বিপ্লব ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না।