
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতে মোট ঋণের বিপরীতে খেলাপি ঋণের অনুপাত যে হারে বাড়ছে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামীতে এ হার আরও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
খেলাপি ঋণের অনুপাত বৃদ্ধির পাশাপাশি এর দ্রুত কোনো সমাধানের পথও খুঁজে পাচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে নতুন করে আর যাতে কোনো জাল জালিয়াতি হয়ে খেলাপি ঋণের সৃষ্টি না করে সেটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। গৃহীত কার্যক্রমের ফলে এটি সম্ভব হবে বলে মনে করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
দেশের ব্যাংক খাতের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি হালনাগাদ একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক খাতে মোট ঋণের বিপরীতে খেলাপি ঋণের অনুপাত অস্বাভাবিক গতিতে বেড়েই চলেছে। বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে লুটপাটের কারণে ব্যাংক থেকে যেসব অর্থ আত্মসাৎ বা পাচারের মাধ্যমে বের করে নেওয়া হয়েছে সেগুলো এখন খেলাপি হচ্ছে। স্বল্প মেয়াদি ঋণগুলোই এখন খেলাপি হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি ও যেসব ঋণের বিপরীতে লম্বা সময় গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে সেগুলো অবশ্য এখন খেলাপি হচ্ছে না। মেয়াদ শেষে হলে এগুলোও খেলাপি হওয়া শুরু করবে। তখন খেলাপি ঋণের হার আরও বেড়ে যাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে এখন কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এ কারণে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হচ্ছে। এর বিপরীতে মোটা অংকের ঋণ খেলাপি হওয়ায় মোট ঋণের বিপরীতে খেলাপি ঋণের অনুপাত বেড়ে যাচ্ছে। যা বৈশ্বিক ও দেশীয়ভাবে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিকভাবে খেলাপি ঋণের হার ৩ শতাংশের বেশি থাকলেই ওই ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। যদি এর বিপরীতে প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি থাকে তবে তাতে ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাধারণ খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশের বেশি থাকলে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়।
গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি খেলাপি ঋণের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমকি ২০ শতাংশে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৯ শতাংশ। জুন থেকেই খেলাপি ঋণের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। আগে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করা হয়েছিল। দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সরকারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেছে। গত সরকারের সময়েও ২০২৪ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমকি ১১ শতাংশে। গত বছরের জুনে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে। লুটপাটকারীরা পালিয়ে গেলে বা আত্মগোপন করলে বা কেউ কেউ গ্রেফতার হলে তাদের কোম্পানির নামে স্বল্প মেয়াদি ঋণগুলো খেলাপি হতে থাকে। ফলে গত বছরের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশে।
আগে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল ছিল। কিস্তি পরিশোধের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ছয় মাস থেকে নয় মাস পর খেলাপি হতো। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তিন মাস খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে। এই মানদণ্ডে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা গত এপ্রিল থেকে কার্যকর করা হয়েছে। ফলে আগামী জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। তবে এ সংজ্ঞার কার্যকারিতা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করেছে ব্যবসায়ীরা। কারণ বিদ্যমান পরিস্থিতিতে খেলাপি ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা উদ্যোক্তাদের কম। তবে আইএমএফের চাপ রয়েছে এ সংজ্ঞা বহাল রাখার। সে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও এটি স্থগিত করেনি।
ব্যাংক থেকে ঋণের নামে যেসব অর্থ বের করে পাচার বা আত্মসাৎ করা হয়েছে সেগুলো খেলাপি হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এগুলো আদায় করা কঠিন হবে। তারপরও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা নেওয়া হচ্ছে খেলাপি ঋণ কমাতে ঋণের টাকা উদ্ধার করতে। কয়েকটি ব্যাংক ইতিমধ্যে খেলাপি ঋণের দায়ে গ্রাহকের সম্পত্তি নিলামে তুলেছে। এতে কিছু টাকা আদায় হচ্ছে। পাচার করা টাকা ফেরানোর প্রক্রিয়াটি একটু সময় সাপেক্ষ। দেশে যারা পরিস্থিতির কারণে খেলাপি বা ইচ্ছাকৃত খেলাপি তাদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে জোর দেওয়া হয়েছে। যারা ব্যবসা করতে চান তাদের বিশেষ ছাড়ে খেলাপি ঋণ নবায়ণ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমবে।