
আবদুল লতিফ মাসুম
‘পুলিশ’ শব্দটি উচ্চারিত হলে আমাদের সুখকর অনুভূতি হয় না। সেই পুরোনো আমল থেকে পুলিশ মানুষের বন্ধু না হয়ে ভীতির কারণ হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে পুলিশ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রক্ষক। জনগণ ও পুলিশের মধ্যে ছিল ব্যাপক দূরত্ব। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের বিদায়ের পরও সে ধারণার তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি।
পুলিশের ইতিবাচক ভূমিকার চেয়ে নেতিবাচক বিষয়টিই তাদের মনমগজে গেঁথে ছিল এবং আছে। পুলিশ বিষয়ে যতই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকুক না কেন তারপরও তাদের ওপরই ন্যাস্ত আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব। দিনে ঘাম ঝরিয়ে, রাতে ঘুম হারাম করে এবং ঈদ-পার্বণে নিজের পরিবারকে আনন্দ থেকে দূরে রেখে আমাদের আনন্দকে নিশ্চিত করে পুলিশ বাহিনী। আইনগতভাবে সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা নিশ্চিত করাই পুলিশের দায়িত্ব। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন তাদের কর্তব্য।
নীতিগতভাবে এসব কথা বলা হলেও তারা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয় না তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বৈধ শক্তিপ্রয়োগের একক জিম্মাদার। রাষ্ট্র মানে তো রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্রের প্রতিভূ সরকার তাদের পরিচালনা করে। এ সরকার আবার দলীয় সরকার। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বৈধতা ও প্রতিনিধিত্বের দাবি নিয়ে দলই রাষ্ট্র পরিচালনা করে। সুতরাং আমরা যে পুলিশকে সামনে থেকে দেখি, পেছনে তার অন্য শক্তি। তারা কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন করে। সরকার যদি ভালো হয়, তাহলে জনগণ ভালো থাকে। আর সরকার যদি হাসিনা টাইপ হয়, জনগণের দুর্ভোগের সীমা থাকে না।
সভ্যতার কোন পর্যায়ে ও কীভাবে পুলিশের উদ্ভব- তা রীতিমতো কৌতূহলের বিষয়। আগেকার রাজা, রাজ্য, রাজধানীতে উজির, নাজির ও কোতোয়ালের প্রভাব ছিল। কোতোয়ালরা সৈন্য, সামন্ত, মনসবদার, পাহারাদার দ্বারা রাজধানীর শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করত। তবে মূল শক্তি হিসেবে সেনাবাহিনীই কার্যকর ছিল। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে পুলিশি ব্যবস্থার প্রথম প্রবর্তন লক্ষ করা যায়। প্রাথমিকভাবে তারা পাহারা দিত সম্রাট ও তার সভাসদদের। যাজক ও অভিজাতরাও এই পাহারা পেত। সেটা অনেকটা আমাদের গার্ড রেজিমেন্টের মতো।
সাধারণভাবে বলা যায়, আমাদের গেটকিপার বা দারোয়ানদের মতো। কিন্তু ফৌজদারি আইন কার্যকর ও শৃঙ্খলা বিধানের বাহিনী হিসেবে পুলিশের আত্মপ্রকাশ ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনে। ১৮৬০ সালের মধ্যে পুরো ব্রিটেনের আইনশৃঙ্খলা ন্যস্ত করা হয় পুলিশ বাহিনীর হাতে। পরে পুলিশের এ ধারণাটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বত্র দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। পুলিশের এই ভূ-উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে বদনামও তাদের পিছু নেয়।
ক্ষমতা সব সময়ই মানুষকে শক্তিপ্রয়োগের নেতিবাচক দিকে নিয়ে যায়। পুলিশ বাহিনীর ক্রমেই উন্নয়ন তাদের সুনামের অনুন্নয়ন ঘটিয়েছে। তখন থেকেই চিন্তা করা হয় যে কীভাবে তাদের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাদের ক্ষমতার সীমা-পরিসীমা এবং জবাবদিহির বিষয়টিও তখন থেকে আলোচিত হয়ে আসছে। সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ধরন-ধারণ নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার এই যে, সেই অতীতে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো এখনো জাতিরাষ্ট্রগুলোকে আলোড়িত করছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব হওয়ার পর সেই পুরোনো কাঠামো ও ক্ষমতা বিন্যাসের তেমন কোনো পরিবর্তনই হয়নি। শুধু নামটি এবং লোগোটি পাল্টেছে মাত্র। বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসে পুলিশ ক্রমেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে ১৫ বছরে তারা যে বেপরোয়া ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ দেওয়ার জন্য উদাহরণের অবকাশ নেই। আওয়ামী লীগ আর সবকিছুর মতোই সরকার ও পুলিশের পার্থক্যটুকু ঘুচিয়ে দিয়েছে।
পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলতেন। একজন শীর্ষ বিরোধী নেতাকে পেটানোর পুরস্কারস্বরূপ পুলিশ কর্মকর্তা পুরস্কৃত হয়েছেন। পুলিশের পদায়ন ও পদোন্নতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি কতটা নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা দেখাতে পেরেছেন বিরোধীদের প্রতি।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে ফ্যাসিস্ট হাসিনা যে নির্মমতা প্রদর্শন করেছেন, তা ইতিহাসে তুলনাহীন। আর সে নির্মমতার প্রধান বাহিনী ছিল পুলিশ। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ও হৃদয়বিদারক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। এই অভ্যুত্থান শুধু রাজনৈতিক ঘটনার নয়, এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় দমননীতির এক জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে।
এসব নিপীড়ন ও নির্যাতনের ফলে মানুষ পুলিশের ওপর মহাক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। জনতার শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছে দানব হয়ে ওঠা পুলিশ বাহিনী। জনতার রোষ থেকে আত্মরক্ষায় পালিয়ে যায় প্রায় সব পুলিশ যা ইতিহাসে বিরল। পরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টায় পুলিশ বাহিনীর অনেকে কর্মস্থলে যোগ দেয়। কিন্তু অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও অন্যায়ের আশঙ্কায় অনেক পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে অনেক দিন ধরে অনুপস্থিত থাকেন। পুলিশ বাহিনী গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এটিও অপ্রিয় সত্য যে, অপরাধের দায়-দায়িত্ব তাদের চেয়ে হুকুমদাতাদের ছিল বেশি। সে ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষমা বা অনুরূপ কোনো নীতিমালার ভিত্তিতে পুলিশকে পুনর্গঠন করা যেত।
এতে আস্থার পরিবেশ দ্রুত ফিরে আসত। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরপর পুলিশসহ সমগ্র জাতি প্রতিশোধ প্রবৃত্তির কবলে নিপতিত হয়েছিল। শেখ সাহেব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তবে যারা হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মতো ঘটনায় দোষী বিবেচিত হবে, তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রযোজ্য হবে না। এখনো অনেক পুলিশ কর্মচারী ও কর্মকর্তা পলাতক রয়েছেন। সরকার পুলিশ বাহিনীতে পুরোপুরি আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে অনুরূপ ক্ষমা ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
এ ক্ষেত্রে ১/১১-এর ঘটনাবলির পর যে ট্রুথ কমিশন গঠিত হয়েছিল, সেরূপ ব্যবস্থা চিন্তা করতে পারে। তবে সীমালঙ্ঘনকারীদের ক্ষমা করা যায় না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এরপরও কিছু লোক লঘু অপরাধে গুরুদণ্ড পেয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার গুরুতর অপরাধীরা সম্পর্ক বা অর্থের কারণে পুনর্বাসিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ বাগবিধির স্বীকার হয়েছে বলে মনে হয়। ১৫ বছরে নিকৃষ্ট দলীয়করণে যেকোনো অফিসে ক, খ, গ, ঘ- সর্বত্রই আওয়ামী ধ্বজাধারীদের স্থান হয়েছে। যেহেতু তাৎক্ষণিকভাবে বড় কর্মকর্তা বানানো সম্ভব নয়। সেহেতু কম ক্ষতিকারকদের কৌশলে ব্যবহার করা যায় কি না, তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
সরকারের তরফ থেকে নানা ধরনের কর্মকমিশন গঠন করতে হয়েছে। দেশে জনমুখী, জবাবদিহিমূলক এবং দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনীর লক্ষ্যে সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনকে কমিশনপ্রধান করে ৯ সদস্যবিশিষ্ট পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে। অতি সম্প্রতি তারা তাদের সুপারিশমালা পেশ করেছে। ৩৫৫ পৃষ্ঠার সুলিখিত এ প্রতিবেদনে পুলিশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি তুলে ধরা হয়েছে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের এতসব সুপারিশমালা বাস্তবানুগ। তবে এর আইনগত ও কার্যকর প্রয়োগের সময় এবং প্রাতিষ্ঠানিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সত্যিকার অর্থে কারো কাছে আলাদিনের চেরাগ নেই। ইচ্ছা করলেই সবকিছু পরিবর্তন করা যায় না। সময় ও স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার সুপারিশমালার আশু অংশ বাস্তবায়ন করতে পারে। পরবর্তী সরকার মধ্যবর্তী বিষয়াবলি চিন্তা করতে পারে। আর সংস্কারের স্থায়ী ও স্বীকৃত বাস্তবায়নের জন্য ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি পুলিশ সংস্কার সনদ প্রণীত হতে পারে। সুপারিশমালায় অনুপস্থিত একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়। আর তা হলো- ক. স্থানীয় সরকারের হাতে ক্রমেই পুলিশের দায়িত্ব প্রদান। এ ক্ষেত্রে উপজেলা ও জেলা পরিষদ নিজ নিজ অবস্থান থেকে পুলিশ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করবে।
খ. পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন নাগরিক কমিটি গঠন। গ. পুলিশের বেতন-ভাতা এতটাই বৃদ্ধীকরণ যে, তাদের জীবনযাপনের জন্য পরমুখাপেক্ষী, তথা ঘুসপ্রবণতা হ্রাস পায়। ঘ. তাদের চারিত্রিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের জন্য পরিকল্পিতভাবে ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের দীক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান। ঙ. পুলিশে অন্তর্ভুক্তির সময় প্রার্থীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হওয়া। এখন যে পুলিশ বাহিনী রয়েছে, তার দ্বারা সৎ, স্বচ্ছ ও সুন্দর আগামী ভবিষ্যৎ সম্ভব নয়। ক্রমেই যথার্থ পরিকল্পনার মাধ্যমে ঈপ্সিত লক্ষ্যে ধাবিত হওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। এই পদক্ষেপের বাস্তবভিত্তিক অর্জনে অন্তর্বর্তী সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়