
লেখক ও শিক্ষাবিদ নাসিমা হাসান বলেছেন, ইসলামে সম্পদ বণ্টনের বিষয়টিতে আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা হয়েছে- অর্থনৈতিক দায়িত্বের বিবেচনায়, সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে নয়। তিনি বলেন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে অনেক ভুলবোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে তা যাচাই-বাছাই ও আলোচনার মধ্যে দিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। আমরা সবাই এক দেশে বাস করি এবং সবার যাতে বেনিফিট হয় সেটি লক্ষ রাখতে হবে। মুসলিম হিসেবে কোনোভাবেই এসব সুপারিশ ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তা আমরা চাই না। তিনি নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
নাসিমা হাসান বলেন, আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করা যেত এবং এখনো সে সুযোগ রয়েছে। নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা সৃষ্টির জন্যে যে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন সুপারিশগুলো দিয়েছে সেগুলোতে নারী যাতে আরো বেশি অধিকার ভোগ করতে পারেন সে বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে; কিন্তু কিছু বিষয় ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তা অবশ্যই সংশোধন করতে হবে। কারণ সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে পুরুষের সমান নারীদের দিতে বলা হয়নি কুরআনে। কারণ যুক্তি ও ইনসাফ ছাড়াও এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো পয়েন্ট জড়িত রয়েছে। দেশে পারিবারিক আইন কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতেই চলছে, তো এখানে হাত দিতে গেলে তো বড় ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো দেখে অনেক জায়গায় মনে হয়েছে যে, পুরুষ ও নারী একে-অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী, এটা নয়, ইসলামের দৃষ্টিতে পুরুষ ও নারী একে-অপরের পরিপূরক। একজন আরেকজনের সাথী। তারা একে-অপরে ন্যায়ের আদেশ করবে এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ করবে।
সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বেসিক যে রুল, ইনহেরিটেন্স ল’টা প্রাইমারি হিসেবে প্রাপ্য পাঁচজন। মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, তার কন্যা, তার পুত্র, তার পিতা ও মা। এই পাঁচজনকে খুঁজবে একজন মৃত ব্যক্তির সম্পদ। এখানে পুত্র ও কন্যা সম্পদের কত অংশ পাবেন আল্লাহ তায়ালা তা ডেফিনিট বা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এটাকে আমরা সংস্কার করতে পারি না। কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের মধ্যে সম্পদের বণ্টন অ্যাডজাস্ট করে তা ভিন্ন। নিজেরা করলে তা ইসলামী আইনের আওতায় পড়বে না।
মনে রাখতে হবে যে, এখানে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে কন্যা ছাড়াও নারী হিসেবে তার মা ও দাদীও রয়েছেন। ইসলাম সবার মধ্যে সম্পদটা বণ্টন করেছে এবং আমাদের বুঝতে হবে যে, এ সম্পদটা অনার্জিত সম্পদ। আমি কিন্তু এ সম্পদ অর্জন করিনি। আল্লাহ তায়ালা এ সম্পদ আমাদের দিয়েছেন বলে আমরা কিন্তু তা পাচ্ছি।
পৃথিবীতে যত ট্যালেন্টেড মানুষ আছে, ধরেন হার্ভাড, এমআইটি বা অনেক বড় বিদ্বান হোক না কেনো, আগে যারা জন্ম নিয়েছেন, ভবিষ্যতে যারা আসবেন এই দুনিয়ায় তাদের সবার চেয়ে মহাজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালা নিজে এ সম্পদ বণ্টন করে দিয়েছেন তার আপন মহিমায়।
নয়া দিগন্ত : বলা হচ্ছে, ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইন আছে; কিন্তু কেউ যদি এর বাইরে অন্য কোনো আইনে চলতে চায় তাদের জন্য সিভিল অপশন হিসেবে ঐচ্ছিক হিসেবে নতুন আইন চাওয়া হচ্ছে।
নাসিমা হাসান : ঐচ্ছিক করে নতুন আরেকটা আইন কিছুটা কনফিউজিং। সেটি সম্ভব কি না। সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা মুসলিম জনসংখ্যার দেশে অধিকাংশ মানুষ ধর্মভীরু। এটা করতে গেলে অনেক সংস্কারের প্রয়োজন আছে। আরো চিন্তাভাবনা করতে হবে, পরিষ্কার ও স্বচ্ছ ধারণা দরকার হবে।
নয়া দিগন্ত : যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলা হচ্ছে...
নাসিমা হাসান : যৌনকর্মীরা আমাদের সমাজে অত্যাচারিত, নির্যাতিত, তাদেরকে যে পেশায় ঠেলে দেয়া হয়েছে এ পেশায় আসলে কোনো মর্যাদা নেই। শ্রমের মর্যাদা দিলেও তারা সে মর্যাদা পাবে না। তার চেয়ে তাদের পুনর্বাসন করা হোক। মাদকাসক্তদের পুর্নবাসন করা হচ্ছে। তাদের পেছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করা হচ্ছে। যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন করা তার চেয়ে সহজ হবে। কারণ তারা স্বেচ্ছায় কেউ এই পেশা গ্রহণ করেনি। তার ওপরে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে তাকে যৌনকর্মী বানানো হয়েছে, তাহলে সেসব অপরাধের বিচার না করে একে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিলে ওরা পার পেয়ে যাবে। যৌনকর্মীদের মধ্যে অবশ্যই ভিন্ন কোনো-না-কোনো দক্ষতা আছে। মাদকাসক্তদের চেয়ে যৌনকর্মীদের সংখ্যাও অনেক কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ দেশী ও বিদেশী অনেক সংস্থা তাদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসতে পারে। তা ছাড়া যৌনকর্মীকে পেশার স্বীকৃতি দিলেও সে কোনো আইনগত সুবিধা পাবে না। কারণ সে সর্বক্ষেত্রে নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র ও নির্যাতনের শিকার। কোনো গ্রাহক প্রটেকশন দেয় না বলেই যৌনকর্মীরা সহজেই এইডস, এসটিডি-সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থাহানির শিকার হয়। তাদের বেশির ভাগ এ পেশা ছেড়ে চলে আসতে চায়। তাদের হয় অপহরণ করা হয়েছে না হয় প্রেমের ফাঁদে ফেলে এভাবে শোষণ করা হচ্ছে। তারা প্রবঞ্চনার শিকার। কেউ স্বেচ্ছায় এসে থাকলে তার সংখ্যা শূন্য শতাংশেরও নিচে। যখন সে প্রৌঢ় হয়ে যায় তখন সে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি আর পারছি না এ পেশায় টিকে থাকতে। তাই পেশার স্বীকৃতি দিয়ে তার কোনো লাভ হবে না।
কুড়ি বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ওয়ার্কশপে গিয়ে সেখানকার একজন সমাজবিজ্ঞানীকে শঙ্কা প্রকাশ করতে দেখেছিলাম। পশ্চিমা সমাজের কোথাও কোথাও ড্রাগ বা পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ নয়; কিন্তু তাদের সমাজবিজ্ঞানীরা স্বীকার করছেন এগুলো তাদের যুবসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ ছাড়া যৌনব্যবসার পেছনে একটা কো-ইন্টারলিংক আছে। সবকিছু বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে চলবে না। ঐচ্ছিক বিষয় বললে হবে না। সারা পৃথিবীতে নারীপাচার বলেন, পর্নোগ্রাফি বলেন আর পতিতাবৃত্তি বলেন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অবৈধ ব্যবসা চলছে। ওরা কোনোদিন চাইবে না যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন করা হোক। নারীর ইজ্জত আব্রু লুণ্ঠন করেই তা হচ্ছে। এই পেশার স্বীকৃতির আড়ালে সার্বিকভাবে নারীদের নিরাপত্তার দিকটি চরমভাবে বিঘিœত হবে। নারীদের জন্যে এটা অসম্মানজনক হবে। পর্নোগ্রাফিতে তখন সহজভাবে নারীদের ব্যবহার করা হবে। এ ধরনের নারীনির্যাতকেন্দ্রিক অবৈধ ব্যবসাগুলো দেশে দেশে, আঞ্চলিকভাবে হোক, আন্তর্জাতিকভাবে হোক কারো নেতৃত্বেই থাকে। কোনো সর্দারণী বা ওরকম। এমন না যে, নারীদের যৌনকর্মকে পেশা স্বীকৃতি দিলে তারা খুব স্বাধীনতা পেয়ে যাবে। তাদের কোনো স্বাধীনতা আদৌ থাকে না। নিতান্তই নির্যাতিত হয়ে, প্রেমের ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা না থাকলে নারী পেটের দায়ে হোক, সন্তানের মুখে আহার তুলে দেয়ার জন্য হোক কোনো রকমে বেঁচে থাকার জন্যে এ ধরনের ঘৃণ্য পেশা নিতে বাধ্য হয় বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাকে বাধ্য করা হয়।
নয়া দিগন্ত : আপনি বলতে চাচ্ছেন যে, এ ধরনের ঘৃণ্য পেশার সাথে আন্তর্জাতিক একটা চক্র জড়িয়ে আছে।
নাসিমা হাসান : পর্নোগ্রাফির সাথে আবার ডিপলি রিলেটেড ড্রাগ অ্যাডিকশনের ব্যাপারটি। মানে একটি অপরাধ আরো ১০টি অপরাধকে টেনে এনে সামাজিক বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে তরুণ-তরুণীদের জীবনে সর্বনাশ ঘটিয়ে দেয়। মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক বিকৃতি দেখা যায়। তারা একের পর এক অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। মাদকাসক্তদের মধ্যে কেসহিসট্রি যেসব চিকিৎসক বিশ্লেষণ করেছেন তারা দেখতে পেয়েছেন তারা পতিতালয়ে যাচ্ছেন, সমকামিতার সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। হোয়াটএভার। তখন তো পারভার্শন চলে আসে তাদের মধ্যে।
নয়া দিগন্ত : পশ্চিমা সমাজে দেখা যায়, পারিবারিক বন্ধন অতটা দৃঢ় না হওয়ার কারণে এ ধরনের সামাজিক অনাচার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখন নারীবিষয়ক সংস্কারে বিভিন্ন সুপারিশের মধ্যে দিয়ে কি তাহলে আমরা আমাদের সমাজে ওই ধরনের আপদ টেনে আনতে যাচ্ছি?
নাসিমা হাসান : অবশ্যই আমাদের পারিবারিক বন্ধনের বিরুদ্ধে এসব সুপারিশের কোনো কোনোটি হুমকি। ইসলামিক দৃষ্টিতে তো আমরা বলে ফেললাম যে, যৌনকর্মে স্বীকৃতির প্রশ্নই ওঠে না কারণ এটা কোনো পেশাই না। কোনো ধর্মই যৌনকর্মকে পেশা বলেনি। কারণ এইটা যে শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিতে এটিকে আমরা দেখে অনেকসময় বিষয়টিকে ন্যারো স্পেসের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলি। পাপ-পুণ্য বা গুনাহর বাইরে এই সমাজ, এই দেশেই বা আমরা যে গ্লোবাল ভিলেজে বাস করি তাতে যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও আড়ালে আবডালে, লুকিয়ে অবৈধভাবে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তো স্বীকৃতি দিয়ে আইনগত বৈধতা দিলে এটি সমাজকে কোথায় নিয়ে যাবে তা কল্পনার বাইরে। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার যুক্তিতে বলা হয়েছে এটা না হলে রেপের হার বেড়ে যাবে। ধর্ষণের জন্যে যে শাস্তি রয়েছে সেটি নিশ্চিত করতে হবে কঠোরভাবে। নারীদের শারীরিকভাবে নাজেহাল, নির্যাতন বা রেপ করার মতো যারা মনোভাবসম্পন্ন আছেন তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা শুধু সময়ের দাবি নয়, এটি নারীর সামাজিক নিরাপত্তা ও হেফাজতে রাখার অধিকার। ধর্মতাত্ত্বিকভাবে এটি বললেও এর সামাজিক প্রয়োগ কিন্তু রাষ্ট্রের। সেখানে রাষ্ট্রের কাছে যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মতো সুপারিশ করা হচ্ছে তাও আবার নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের ব্যানারে। সোজা কথা ধর্ষণ হ্রাসে যৌনকর্মের মতো পেশার স্বীকৃতি বা নারীকে পুনর্বাসন না করে এটাকে রেখে দিতে হবে তার কোনো যুক্তি নেই।
নয়া দিগন্ত : বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতরে জোরপূর্বক যৌনসম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশে।
নাসিমা হাসান : এখানে কোনো মেয়ে যদি এ ধরনের অভিযোগ করে আইনি সহায়তা নিতে চায় তাহলে সেটি খুব কঠিন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীরা যখন নির্যাতনের শিকার হয় তখন তারা প্রকাশ্যে তা বলতে পারে না। এখানে ম্যারিটিয়াল রেপের সংজ্ঞাটা খুব জরুরি। পরিষ্কার করে বলতে হবে তা না হলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। নইলে তো স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে কী হয়েছে তা প্রমাণ করা খুব কঠিন। অনেকসময় কোনো নারীও পুরুষকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে দিতে পারে এমন শঙ্কা যেন না থাকে।
নয়া দিগন্ত : কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোতে সমকামী আন্দোলন থেকে শুরু করে এমন অদ্ভুত দাবি উঠছে, যা নৈতিক অবক্ষয়ের চরম সীমায় আমাদের নিয়ে যাচ্ছে।
নাসিমা হাসান : আমাদের সামাজিক চাহিদা পূরণে আমেরিকা-ইউরোপ বা পশ্চিমা সমাজের মতো দেখলে চলবে না। ফ্রিডমের নামে ওই সব দেশে অনেক কিছু হয়। আমাদের সমাজভাবনায় এমন একটা দৃশ্য উপলব্ধি করতে শিখতে হবে যে, বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তির আড়ালে যে চোখের পানি, যে প্রবঞ্চনা, যে কিডন্যাপিং এগুলো দিয়েই নারীকে এ পেশায় আনা হয়, ওকে ওই পেশায় রাখার অর্থই হলো আইনগতভাবে মেনে নেয়া যে, কেউ কিডন্যাপ হয়েছিল, কেউ বিক্রি হয়েছিল এটাকে জায়েজ করে দেয়া। তার মানে এর পেছনে অপরাধগুলোকে আমি জায়েজ করে দিচ্ছি। এটি কোনো মতেই একটি সুস্থ সমাজে ঘটতে পারে না। ইসলাম ধর্মে তো নয়ই।
নয়া দিগন্ত : কিন্তু নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হচ্ছে এটা ঐচ্ছিক বিষয়, যে কেউ কোনো ধর্মের বাইরে এসে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে চাইলে সে এসব সুপারিশ অনুসরণ করবে।
নাসিমা হাসান : ঐচ্ছিক বিষয় বললে তো হবে না। তাহলে কমিশনের প্রস্তাবে যে নৈতিকতা না থাকা বা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে এগুলো দিয়েই আসলে শুরু হয়। ধর্মের যদি কোনো প্রভাব নাই থাকে তো বা কোনো আইনগত ব্যবস্থা না থাকে, বা যে সমাজে ৮৫ শতাংশের বেশি মুসলিম এ রকম একটা সমাজে ঐচ্ছিক বিষয়টি একেবারেই অযৌক্তিক। ঐচ্ছিক মানেই ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধী সুপারিশ বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে জিনিসটি থেমে থাকবে না। জেনারেশনের পর জেনারেশন এই ঐচ্ছিক বিষয়টা চলে যেতেই থাকবে এন্ডলেস হয়ে। একবার যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিলে এটা এমন একটা পথ খুলে দেবে, দেখা যাবে সমকামিতার অধিকার চাওয়া শুরু হবে। গোপনে সমকামিতার মতো জঘন্য প্রবৃত্তির বিকাশ যে হচ্ছে না তা তো না। কিন্তু তারা তখন প্রকাশ্যে তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে চলে আসবে। পত্রপত্রিকায় ছেলে যৌনকর্মীর কথাও দেখি। পরিস্থিতি সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই যৌনকর্ম কখনো পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে না। আবার ঐচ্ছিক আইনের কথা বলে যদি স্বীকৃতি দিতে চান তো সম্পত্তি থেকে শুরু করে ডিভোর্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে সমতা চাওয়া হলে এতটাই ক্যাওয়াটিক সিচুয়েশন তৈরি করবে যে, অসম্ভব একটা সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, তালাক বা সম্পত্তিতে পিতা-মাতার যে ভাগের কথা বলা হচ্ছে, আবার ডিভোর্সের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পদের ভাগাভাগি হবে ফিফটি ফিফটি, এটা ধংসাত্মক হয়ে দাঁড়াবে।
নয়া দিগন্ত : মুসলিম পারিবারিক যে আইন আছে তার বিরুদ্ধে নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পদের সমান ভাগকে অনেকে আগ্রাসন এমন দৃষ্টিতে দেখছেন কেন?
নাসিমা হাসান : অনেকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার কথা বলছেন। তাহলে নারী ও পুরুষের পারিবারিকভাবে যে খরচ করার বিষয়টি আছে সেটি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলতে শুরু করবে। মুসলিম পারিবারিক আইন বলুন বা ধর্মীয় বিধান বলুন পরিবারে নারীর খরচ করার কোনো বাধ্যবাধকতা তো নেই; বরং তাকে বা তার ছেলে-মেয়েকে সম্পূর্ণ ভরণপোষণের দায়িত্ব কিন্তু পুরুষের। সম্পদ যদি নারী ও পুরুষের মধ্যে সমবণ্টনের কথা বলেন তখন নারীর ওপর ভরণপোষণের দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চাইবে পুরুষ। পুরুষ বলবে যেহেতু সম্পদের সমান ভাগ নিচ্ছ তাহলে খরচও সমান সমান। নারী তার পরিবারকে আগলে রাখবে, রান্নাবান্না সাংসারিক দায়িত্ব সামলাবে না ছেলে-মেয়ের পড়াশুনার দায়িত্ব পালন করবে নাকি আয় করতে ঘরের বাইরে ছুটবে। আর ছুটলেই তো নারীর কর্মসংস্থানের জন্য কোনো বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি করিনি। দুস্থ নারীরাই সে সুযোগ পাচ্ছে না। লাখো তরুণ যে দেশে বেকার সেখানে হুট করে নারীকে ঘরের বাইরে ঠেলে দিলেই তো হবে না তার সম্ভ্রম, তার নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে এবং তা নিশ্চিত করতে হবে। হ্যাঁ, বিয়ের পর যদি নারী ও পুরুষ কোনো সংসারে সমানভাবে ব্যয় করে থাকেন, সম্পদ গড়ে তোলেন তা সমবণ্টনের প্রশ্ন আসতে পারে। কিন্তু স্বামী যেটা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে, নারী যেটা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে তা ভাগ হবে না। নারী-পুরুষের সম্পদ সমবণ্টন করতে গেলে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তো একজন কোটিপতি স্বামী কি তার কোটিপতি স্ত্রীর অর্ধেকটা নিয়ে নেবে।
নয়া দিগন্ত : কিন্তু মুসলিম পরিবার আইনে যা বলা আছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো নারী তার হিস্যা বা নায্য সম্পত্তি পাচ্ছে না। তার পিতা বা তার ভাই তাকে বঞ্চিত করছে।
নাসিমা হাসান : দিচ্ছে না সেটি আইনগতভাবে নিশ্চিত করার ব্যাপার। সামাজিক সংস্কার বা চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। পারিবারিকভাবে এটা নিয়ে কথা বলতে হবে। বোনেরা কথা বলতে চান না সম্পর্ক নষ্ট হবে বলে; কিন্তু এটা তাদের বুঝতে হবে অধিকারের বিষয় সেটি আদায় করে নেয়ার বিষয়। সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দেশে এটা আছে, বাবাই বঞ্চিত করে রেখে যায়। আবার তার অর্থ এটাও নয় যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পদের সমবণ্টন করলে সে বঞ্চিত হবে না। না দেয়ার টেন্ডেন্সি আছে কিন্তু এটি আইনগত প্রয়োগের সমস্যা।
নয়া দিগন্ত : নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পদ বণ্টনে বিদ্যমান আইন অনুসারে তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না আবার বলা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ হবে, বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে নারীকে বেশি দিতে গেলে।
নাসিমা হাসান : দেখেন, নারী পুরুষের সম্পদ সমান বণ্টনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে সঙ্ঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি হবে। ধরেন, একটি পরিবারে ভাইবোনদের মধ্যে কেউ চাইবে মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে, আবার কেউ চাইবে সমবণ্টন। তো সম্পদ নিয়ে এক দেশে দুই আইন থাকলে কোনটি অনুসরণ করবে তা নিশ্চিত করতে যেয়েও হাঙ্গামা লেগে যাবে। আদালতে মামলার জট আরো বাড়বে। এখানে সূক্ষ্ম কতগুলো ব্যাপার আছে, সম্পদের সমান ভাগ করতে গেলে আরো যে উত্তরাধিকার আছে, শুধু কন্যাকে ফোকাস করলে তো হবে না, এই বিষয়টাকে হাইলাইট করা হচ্ছে; কিন্তু সেম ডিস্ট্রিবিউশনের মৃত ব্যক্তির স্ত্রীর কথা আছে, মৃত ব্যক্তির মায়ের কথাও আছে। আপনি বোনকে সমান দিচ্ছেন তো অন্য নারীদের কথা তো ভাবছেন না। আল্লাহ তায়ালা তো ওনার মতো করে ডিস্ট্রিবিউশন করেছেন। তাহলে কন্যাকে পুত্রের সমান বা সে যা পাচ্ছে তার বেশি দেয়ার অর্থটা কি যে একই পরিবারে স্ত্রী বা মায়ের ভাগ তো কমে যাচ্ছে। পুরুষের কাছ থেকে নিয়ে আপনি দুই অনুপাত একে না দিয়ে বেশি দিলেন কিন্তু কুরআন তো অন্য নারীদেরও দিয়েছে তাদের বঞ্চিত করবেন কোন অধিকারে। দেখা যাবে বিয়ের সময় নারীর মতো পুরুষও দেনমোহর দাবি করে বসবে। আসতেই পারে দাবি যখন সম্পদ নারী ও পুরুষের মধ্যে সমবণ্টন করতে যাবেন।
নয়া দিগন্ত : তাহলে এসব বিতর্কের সমাধান কি আলোচনার মধ্যে দিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া?
নাসিমা হাসান : আলোচনায় থাকতেই হবে লিমিটের মধ্যে থেকে। সবসময় যে তর্কবিতর্কের মধ্যে সলিউশন হবে তা কিন্তু না। যারা আইন নিয়ে কাজ করেন বিশেষ করে এখানে যেসব নারী কাজ করছেন তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তারা দেখাতে পারবেন অন্য দেশে কী হচ্ছে, আমাদের সমাজে এর অ্যাফেক্টটা কী, যেমন আমেরিকায় যখন সিভিল ল অনুযায়ী বিয়ে করে তো ডিভোর্স হয়ে গেলে ফিফটি ফিফটি সম্পদের ভাগ পায়। সম্পদের পরিমাণ বেশি বা নারীর চাহিদা বেশি থাকলে তা হতেই পারে; কিন্তু সেটি আমেরিকান সোসাইটির ব্যাপার। ও দেশে তো ছেলেরা বিয়েই করতে চায় না। ছেলেরা বিয়ে বিমুখ হয়ে গেলে তো অন্য সমস্যাগুলো তখন দেখা যাবে। আমেরিকায় নাম করা ব্যক্তিদেরকেও দেখতে পাচ্ছি, ওনারা তো মুসলিম না। ধরেন বিলগেটসের কথা, তার স্ত্রী ভাবতেই পারে এই মুহূর্তে স্বামীর যে সম্পদ আমি পাবো তো ডিভোর্স হয়ে গেলে তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি পাবো। স্বামীর অফুরন্ত সম্পদের কথা বিবেচনা করে কোনো মেয়ে ডিভোর্স দিয়ে দিলে তো পরিবার আবার টেকসই হবে না। ব্রেকিং ফ্যামিলির ছেলে-মেয়েদেরকে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক চাপটা নিতে হয়। এসব সমস্যার মূল্য অর্থসম্পদ দিয়ে করতে পারবেন না। তাহলে শান্তিটা কোথায়?
নয়া দিগন্ত : পশ্চিমা সমাজে তো দেখা যায় বয়স্ক ধনাঢ্য ব্যক্তির তরুণী মডেল স্ত্রী, এটা তাদের সংস্কৃতির এক স্বাভাবিক চিত্র।
নাসিমা হাসান : না, কোনো মেয়ে যদি তার স্বামীর সম্পদের দিকেই বেশি নজর দেয় তাহলে কিন্তু পুরুষের উল্টো অ্যাবুউজ হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। ইসলামে বিয়েকে আল্লাহ তায়ালা করেছেন সহজ, তালাকটাকে কঠিন বা সবচেয়ে ঘৃণিত বিষয় মনে করেন তিনি। আর আমরা চাচ্ছি বিয়েটাকে কঠিন এবং সম্পদ ভাগাভাগিটাকে করে দিতে চাচ্ছি সহজ। এতে পরিবার টেকসই হয়ে উঠবে না। এটা একদম খেলো একটা বিষয় যে তালাকেও সমান সমান অধিকার চাওয়া হচ্ছে। আবার সম্পদেও সমবণ্টন। হাফ নিয়ে নেবে। মানে সহজে তালাক দিয়ে অর্ধেক সম্পদ নিয়ে চলে যাবে। এখানেই ইসলামিক আইন নিয়ে অনেক গবেষণার ব্যাপার আছে। ইসলামকে অ্যাড্রেস করতে যেয়ে সামাজিক চাহিদার দিকে নজর দিতে যেয়ে আমাদের ভাষা প্রয়োগেও কিছু সমস্যা আছে, যে কারণে সামাজিকভাবে ইসলামকে সহজে বোঝার ব্যাপারে অনেকে জটিলতা তৈরির সুযোগ খোঁজেন বা পাচ্ছেন। অবশ্যই নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের যে সুপারিশ প্রব্লেøমেটিক রয়েছে তা আলেমসমাজের সাথে বসে আলোচানার ভিত্তিতে সমাধান করে নেয়া উচিত। এ ছাড়া আমরা এ নিয়ে তাণ্ডবকে ঠেকাতে পারব না। কিছুদিন পরপরই এ ধরনের দাবি উঠবে এবং সামাজিক অস্থিরতার শঙ্কা থেকেই যাবে। ডিভোর্স, সম্পদের সমবণ্টন বা যৌনকর্মকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়গুলো বহু বছর ধরেই আমাদের সমাজে ঘুরপাক খাচ্ছে। এটা করা উচিত, এটা হয়ে যাওয়া উচিত, এই উচিত কাজগুলো যে কতটা ঝামেলা সৃষ্টি করবে, এটা কেউ চিন্তা করছে না।
নয়া দিগন্ত : কিন্তু সংস্কারের একটা বিষয় বা চাপ তো সব সমাজেই রয়ে যায়।
নাসিমা হাসান : না, তালাকের বিষয়টা আমরা শুনতে চাই না। যেভাবে তালাক নারীদের দেয়া হচ্ছে, ধর্ম তো সেভাবে বলেনি। মেয়েদের বিরুদ্ধে তালাককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তালাক রাগের মাথায় দেয়ার বিষয় না, গ্যাপ দিয়ে দিতে হয়, মেয়েদের প্রিরিয়ড চলাকালীন দেয়া যাবে না। এগুলো কেউ মানতে চায় না। জীবনবিধান হিসেবে একটা বিশাল স্ট্রাকচার করে দিয়েছে ইসলাম। ওখান থেকে একটা তুলে ভিন্নভাবে বুঝতে চাইলে বিপদ হবে। কারণ এগুলো একটা আরেকটার সাথে রিলেটেড, বিচ্ছিন্ন করলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। দেখুন সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি আমরা সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে দেখছি; কিন্তুআল্লাহ তায়ালা সম্পদ বণ্টনবিধি করেছেন অর্থনীতিক দায়িত্বের বিষয়টি বিবেচনায়, সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে নয়। ওটা যদি হতো তাহলে ইসলামের দৃষ্টিতে মা সবচেয়ে বেশি মর্যাদার। কুরআন বলেন, হাদিস বলেন মা সবচেয়ে মর্যাদার অধিকারী। কিন্তুআল্লাহ তায়ালা মা’কে বেশি সম্পদ দেননি। কারণ মায়ের ওপর সেই অর্থনৈতিক দায়িত্ব নেই। যাদের ওপর অর্থনৈতিক দায়িত্ব বেশি আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সম্পদের ভাগটা বেশি দিয়েছেন। মেয়েদের ওপর অর্থনৈতিক দায়িত্ব হ্রাস করেছেন নানান দিক থেকে। কারণ পুরুষের ওপর তার মা, তার স্ত্রী ও সন্তানরাও অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল। ইসলামী জ্ঞান না থাকার কারণে এটা আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না। ইসলামে পিতা-মাতাকে দেখার দায়িত্ব এ জন্যই দেয়া হয়েছে।