
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সৃষ্টি হয় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। সেই অনুযায়ী, দলটির বর্তমান বয়স প্রায় ৪৭ বছর। এ দলটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, ক্ষমতায় গিয়ে কখনো দল ও সরকারকে এক করেনি। এর পেছনের কারণ হয়তো দল ও সরকার চালানোর মধ্যে কোনো শক্তিশালী ভারসাম্য রক্ষাকারী থিঙ্কট্যাঙ্ক ছিল।
তাছাড়াও দলটির চেয়ারপারসন ছিলেন ভালো শ্রোতা এবং কম কথা বলার মানুষ। আরেকটি কারণ হতে পারে, এ পর্যন্ত দলটির সব মহাসচিব ছিলেন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা, যেমন প্রথম মহাসচিব একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (১৯৭৮-৮৫), এএসএম মুস্তাফিজুর রহমান (১৯৮৫-৮৬), কেএম ওবায়দুর রহমান (১৯৮৬-৮৮), আবদুস সালাম তালুকদার (১৯৮৮-৯৬), আবদুল মান্নান ভূঁইয়া (১৯৯৬-২০০৭), খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন (২০০৭-২০১১) এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (২০১১-২০২৫)। তবে দলটির বিপর্যয় রোধে শেষোক্ত দুজন মহাসচিবের ভূমিকা দলটিকে মনে রাখতে হবে।
২.
মাত্র ৯ মাসের ভেতর জুলাই ৩৬-এর হিরোদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়েছে। যে বা যারাই করছে, তারা অবশ্যই জেনে-বুঝে কাজটি করছে, যা ছিল পতিত সরকারের প্রধান প্র্যাকটিস। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসআপ, ইউটিউব এবং অন্য মিডিয়াগুলোতে সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাই না করে ভাইরাল হচ্ছে এসব গসিপ। সামনে হয়তো ২০১৪ সালের নির্বাচনে কে বা কারা বিএনপির গোপন তথ্য বাইরে প্রকাশ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে লেখা শুরু হবে। ২০১৮ সালের নিশিরাতের নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্য বিএনপির মহাসচিব কেন শপথ নেননি, এসব প্রশ্নও তোলা হতে পারে। বিএনপির ভেতরকার অনেক নেগেটিভ বিষয় জাতির সামনে তুলে ধরবে আওয়ামী মিডিয়া। এসব বিষয়ে শক্ত অ্যান্টি-ন্যারেটিভ তৈরির কারিগর আছে কি বিএনপিতে? একসময় দেখা যেত, তুখোড় বুদ্ধিজীবী প্রফেসর ড. এম মনিরুজ্জামান মিঞা এবং এমাজউদ্দীন স্যারেরা বিএনপির পোস্ট হোল্ড না করেও বিএনপির কোর সভায় উপস্থিত হয়ে দল ও দেশকে পরামর্শ দিয়েছেন। তারা ছিলেন দলের অ্যাসেট। ২০০১-২০০৬, এ পাঁচ বছরে অনেক ভিসি, ইউজিসি ও পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্য বানিয়েছিল বিএনপি। তাদের কয়জন দলের অ্যাসেট হয়েছেন? বিএনপিকে মনে রাখতে হবে।
জুলাই ৩৬-পরবর্তী সময়ে বিএনপির ব্যানারে যারা অতি লোভনীয় পোস্ট পেয়ে গেছেন, তারা আর দল নিয়ে ভাবছেন না। তারা যে যেভাবে পারছেন, ম্যানেজ করে তার টেনিউর শেষ করার ধান্দায় ব্যস্ত। এখান থেকেও দলকে দেওয়ার মতো সত্যিকার পরামর্শক বের হওয়ার লক্ষণ নেই। এমনকি রাতারাতি তৈরি হওয়ার কোনো মেকানিজমও নেই। আচ্ছা, বিএনপির প্রচার বিভাগ ও মিডিয়া কতটা কভারেজে সক্ষম? বিএনপির ভালো একটা প্রিন্ট মিডিয়া নেই (দিনকাল ছাড়া), ভালো একটা ইলেকট্রনিক মিডিয়া নেই (চ্যানেল ওয়ান এখনো বন্ধ), নামকরা কোনো সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সংস্থা নেই (জাসাস ছাড়া)। ঈদের ছুটিতে বিএনপির একজন দক্ষ, সচেতন ও নিবেদিতপ্রাণ সাবেক উপজেলা সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আমাদের উপজেলার জন্য দিনকাল পত্রিকার মাত্র ৫ কপি বরাদ্দ, এই ৫ কপির ভেতর মনে হয় না, একটি কপি কেউ পড়েছে, রাখতে হয়, তাই রাখে!’ তবে সবাই জনপ্রিয় পত্রিকাগুলো রাখে। আচ্ছা বলেন তো, ওইসব পত্রিকা হাউজ কেন বিএনপির ইন্টিলেকচ্যুয়াল প্রপারটিকে প্রমোট করবে? বিএনপি এর উত্তর দিতে পারলেই বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা, প্রকাশনা, এমনকি দলীয় লিটারেচারের সংখ্যাও বেড়ে যাবে। বিএনপির সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা চর্চা অথবা তৎপরতা কি কখনো কার্যকর ছিল? অথচ সমাজে কালচারাল ডোমিনেশন থাকতে হলে সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক চর্চা এবং জনবান্ধব কর্মসূচিতে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হতে হয়। এসবে কি বিএনপি আছে? এখানে যেহেতু ধান্দা নেই, তাই ধাক্কাধাক্কি কম। কালচারালি ডোমিনেন্ট দল আওয়ামী লীগ বয়ান তৈরি করে কীভাবে তৃণমূলে পৌঁছাতে হয়, তা থেকে শিক্ষা নেবে কি?
৩.
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান ১৯৬৬ সালের ৬ দফার কারিগর ছিলেন। যখন এটা চুরি হয়ে গেল, তিনি কি আর কখনো আওয়ামী লীগ করেছেন? ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল প্রবাসী সরকার মুক্তিযুদ্ধের জন্য যে নিয়মনীতি তৈরি করেছিল, সেটি প্রণয়নে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম সহযোগিতা করেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। এরপর থেকে তাজউদ্দীন আহমদ যতবার শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলেছেন, কখনো কি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শেখ মুজিব একটিবারও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন? করেননি। বাকশালে কি তাজউদ্দীনকে নিয়েছিলেন? না। আমীরুল ইসলামরা কি আর কখনো আওয়ামী লীগ করেছেন? ১৯৭২ সালের শেষদিকে আওয়ামী ছাত্রলীগের র্যাডিকেল গ্রুপ জাসদ গঠন করল। তখন সমগ্র দেশের তরুণ সমাজের কাছে জাসদ করা একটি ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়াল। রাষ্ট্রের সংস্কার ও রাষ্ট্রকাঠামোয় যুবসমাজের অন্তর্ভুক্তি ছিল জাসদের মূল স্পিরিট। নেতৃত্বের সক্ষমতার অভাব ও খামখেয়ালিপনায় জাসদ হিমালয়ের মতো শক্তিশালী আওয়ামী লীগের সামনে দাঁড়াতে পারল না। মাঝখানে একটা তরুণ প্রজন্মকে নিঃশেষ করে দিল আওয়ামী লীগ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়টা ছিল স্বৈরাচার এরশাদের ঘৃণিত অধ্যায়। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য দেওয়া সেই সময়কার সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ‘দশ দফা’ বা তিন জোটের রূপরেখার কি আদৌও অগ্রগতি দেখা গিয়েছিল? এমনকি স্বৈরশাসক এরশাদ বিদায়ের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয় দেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার (ডিসেম্বর ১৯৯০-মার্চ ১৯৯১) এবং তিনি ২৫৫ জন দেশসেরা পেশাদার প্রতিভাবান ব্যক্তির সমন্বয়ে ২৯টি টাস্কফোর্স গঠন করেন। ওই টাস্কফোর্সের প্রধান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের নেতৃত্বে বিনাশ্রমে দুই মাসব্যাপী দিনরাত খেটে ১২০০ পৃষ্ঠার ওপরে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি হয়। ওয়ান-ইলেভেন সরকার প্রায় ১৮৫টি সংস্কার প্রস্তাব রেখে গিয়েছিল। এবারও ১১টি সংস্কার কমিশন হয়েছে, ৬৯১টি প্রস্তাব উঠে এসেছে। যদিও পূর্বেকার সব সংস্কার প্রস্তাবের বাস্তবায়নের দায় হিসাবে রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকে দোষারোপ করা যায়নি; কারণ, তখন এসব দলের কাউকেই অন্তর্ভুক্ত করে সংস্কার প্রস্তাবের রূপরেখা করা হয়নি। কিন্তু এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সংস্কার প্রস্তাবের প্রতিটি বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিএনপির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বসছে সরকার। তাই সংস্কার প্রস্তাবের ব্যর্থতার দায় যেন বিএনপির ঘাড়ে না বর্তায়, সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৪.
ষাট বা সত্তরের দশকে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব মেধাবী তরুণ ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ফলে একেকটা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছিল আগামীর মেধাবী রাজনীতিবিদ তৈরির সূতিকাগার। আশির দশকে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তরুণ মেধাবীদের রাজনীতিতে আনার উদ্যোগ নেন। সেজন্য তিনি বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বর্ষের ফার্স্ট-ক্লাস-ফার্স্ট মেধাবীদের একত্রিত করেন এবং তাদের নিয়ে হিজবুল বাহার জাহাজে চড়ে সমুদ্র ভ্রমণে বের হন, যাতে তারা আগামীর বাংলাদেশ বির্নিমাণে এগিয়ে আসেন। তার মৃত্যুর পর সে ধারা ব্যাহত হয়। অন্যদিকে জাসদের বড় ধাক্কায় মেধাবী তরুণরা ভালো চাকরি, ব্যবসা, উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ যাওয়া বা বিদেশে সেটেলড হওয়া, এরকম এক সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েন। এ গ্যাপে রাজনীতি চলে যায় মেধাহীন, মেধাশূন্য, শর্ট-কাট বড়লোক হওয়া বাটপার, চাটুকার, চামচা ও হাইব্রিডদের দখলে। আর মেধাবী ছাত্ররা জড়িয়ে যায় হল দখল, সিট বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ, তদবির, ঘুস এবং মাদক গ্রহণ ও বাণিজ্যে। ফলে ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধ্যান-ধারণা পালটে যায়। ব্যাপারটি এমন ছিল যে, ‘মাছের রাজা ইলিশ, আর জামাইয়ের রাজা ছাত্রলীগ’। এমন প্রেক্ষাপটে আগামীর রাজনীতিতে ছাত্রদলের ভূমিকা কী হবে, তা পরিষ্কার হতে হবে। ছাত্রদল কি পতিত সরকারে ছাত্রলীগের জিন ক্যারি করবে, নাকি সত্যিকার দিন বদলের ভ্যানগার্ড হবে?
সবশেষে একটি বিষয় বিএনপির হাইকমান্ডের কাছে তুলে ধরতে সিনিয়র সাংবাদিক মারুফ কামাল খানের একটি ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করলাম, যেখানে তিনি বলেন, ‘রাজনীতি তো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছি অনেক কাল ধরেই। আমি কখনো বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল একজন আওয়ামী লীগার দেখিনি। এখন আওয়ামী লীগের প্রতি পরম সহানুভূতিশীল বহু বিএনপি দেখতে পাচ্ছি চারদিকেই। এখন বুঝতে পারছি, টানা ষোলটা বছর ধরে আমাদের কেন এতটা নির্যাতন ভোগ করতে হলো। বুঝতে পারছি, কেন বিএনপির সব আন্দোলন শেষ অবধি ব্যর্থ হতো। বুঝতে পারছি, কেন ওরা এত নির্বিঘ্নে ষোলটা বছর ধরে রাজ্যপট চালাতে পেরেছে। বুঝতে পারছি, কেবল পুলিশ, প্রশাসন ও সন্ত্রাসীরা নয়, ওদের ক্ষমতার উৎস তো বিরোধী শিবিরেও ছিল।’
ড. মো. আবুল কালাম আজাদ : গবেষক ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ