Image description
 

এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে আমরা কম-বেশি সবাই গোলকধাঁধার মধ্যে আছি। ২০১০ সালের দিকে যখন বিটিআরসিতে কাজ করতাম, তখন আমি নিজেও এই জায়গায় ছিলাম। তখনকার সমস্যাটা ছিল টেলিকম কোম্পানিগুলোর ইন্টারকানেকশন খরচপাতি নিয়ে, যার কারণে গ্রাহকদের কমবেশি পকেট কাটা যাচ্ছিল। একটা ধারণা পেলাম আইটিইউ জেনেভার একটা ওয়ার্কশপে—কীভাবে একটা ফোন কল এবং এসএমএসের ন্যায্য দাম নির্ধারণ করা যায়, তা নিয়ে।

এজন্য দরকার ছিল একটা ইফিশিয়েন্ট মডেল, যেখানে বিটিসিএলসহ সবগুলো কোম্পানির অপারেটিং কস্ট, ইনফ্রাস্ট্রাকচার কস্ট, আন্তঃসংযোগ খরচ, সরকারের খরচ, রেভিনিউ শেয়ারিং সবকিছু যোগ করে বোঝা যাবে, আসলে একটা ফোন কলের ন্যায্য দাম কত হওয়া উচিত। অনেক চেষ্টার পর কিছু গ্র্যান্ট পাওয়া গেল, যা দিয়ে আইটিইউর কয়েকজন কনসালটেন্ট নিয়োগ দিলো বিটিআরসি।

এরপরের দুই বছর ছিল যেন স্বপ্নের মতো। ডেটার অথেন্টিসিটি নিয়ে শুরুতে বেশ কিছু ঝামেলা হয়েছিল। সেই কনসালটেন্টরা আমাকে দেখালেন, কীভাবে স্ট্যাটিসটিক্স ব্যবহার করে বিলিয়ন ডেটা প্যারামিটার বিশ্লেষণ করে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আনা যায়। তখনো 'কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা' শব্দটা এতটা প্রচলিত ছিল না। কিন্তু সেই সময়ের স্ট্যাটিসটিক্স-ভিত্তিক বিশ্লেষণই আজকের 'এআই'র ভিত্তি। আমি বুঝতে পারছিলাম, ভবিষ্যতে শুধু ডেটা জেনারেট করাই যথেষ্ট হবে না, সেই ডেটা থেকে অর্থপূর্ণ ইনসাইট বের করে আনা হবে আসল চ্যালেঞ্জ। আর সেই চ্যালেঞ্জ নিতে হলে মানুষকে নিজেদের দক্ষতা বদলাতে হবে। সরতে হবে পুরোনো ধ্যান-ধারণা থেকে।

আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় আতঙ্কের একটা হলো ফোবো (ফিয়ার অব বিকামিং অবসোলিট)—অপ্রচলিত হয়ে যাওয়ার ভয়। এটা এক ধরনের অস্তিত্ব সংকটের লড়াই। এআই-চালিত অটোমেশন ধীরে ধীরে রিপিটিটিভ কাজগুলো নিজেদের করে নিচ্ছে, ফলে মানুষদের ভূমিকা বদলে যাচ্ছে। এখন শুধু কাজ শেষ করলেই হবে না, বরং ডেটা ব্যাখ্যা করা, স্ট্র্যাটেজিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং টেকনোলজির সঙ্গে কোলাবোরেট করা লাগবে। তাই এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হলে কিছু কৌশল রপ্ত করা জরুরি।

প্রথমত, আপনার ইন্ডাস্ট্রিতে এআই কীভাবে কাজ করছে, সেটা বুঝতে হবে। এআই বিশেষজ্ঞ হতে হবে না। কিন্তু আপনার ফিল্ডে কী ধরনের এআই-পরিবর্তন আসছে, সেটা বোঝাটা খুব জরুরি। এই পরিবর্তনগুলো কীভাবে কাজের ধরন বদলে দিচ্ছে, সেটা বুঝতে পারলে আপনি নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবেন। আমার গত ১০ বছরের বইগুলো পড়লেই আপনি বুঝতে পারবেন কোথায় আমি জোর দিয়েছি।

দ্বিতীয়ত, শেখার আগ্রহ থাকতে হবে। আজকের চাকরির বাজারে সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হলো কন্টিনিউয়াস লার্নিং—অর্থাৎ, নতুন জিনিস শিখতে পারা এবং পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। যারা শেখার মানসিকতা ধরে রাখেন, তারাই ভবিষ্যতে টিকে থাকেন, এমনকি বড় পরিবর্তনের মাঝেও। দেখুন, আমার মাথায় বুদ্ধি কম, কিন্তু প্রযুক্তিকে কামড়ে ধরে রেখেছি বলে হয়তোবা এখনো টিকে আছি।

তৃতীয়ত, মানবিক দক্ষতা বা 'হিউম্যান-সেন্ট্রিক স্কিল' তৈরিতে সময় দিতে হবে। এআই বিশাল ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে। কিন্তু আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা, নেতৃত্ব বা সৃজনশীলতা এখনো মানুষেরই বিশেষত্ব। তাই কমিউনিকেশন স্কিল, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কিংয়ের ওপর জোর দিন। বিভিন্ন টিমের সঙ্গে কাজ করুন, ক্রস-ফাংশনাল প্রজেক্টে যুক্ত হোন, যাতে কাজের অভিজ্ঞতার পরিধি বাড়ে। এই পরিবর্তনের সময় লিডারশিপ দেখান—নতুন প্রযুক্তিকে আতঙ্ক হিসেবে না দেখে, সেটাকে কাজে লাগানোর উপায় বের করুন। বিশ্বাস করুন, বাংলাদেশ টিকে যাবে শুধুমাত্র প্রযুক্তি দিয়ে।

সবশেষে, ক্যারিয়ার গ্রোথের ধরনটাও নতুনভাবে ভাবতে হবে। আগে ক্যারিয়ার মানে ছিল ধাপে ধাপে উপরে ওঠা, করপোরেট ল্যাডার বেয়ে ওপরে যাওয়া। কিন্তু এখন ক্যারিয়ার মানে হলো দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া। এক জায়গায় আটকে না থেকে পাশের ফিল্ডগুলো শিখুন, নতুন স্কিল ডেভেলপ করুন, প্রয়োজন হলে ক্যারিয়ারের দিক পরিবর্তন করুন।

এটাই বর্তমান যুগের নতুন বাস্তবতা—এআই যদি আমাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, আমাদেরও উচিত সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা, নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করা। যারা এই মানসিকতা নিয়ে সামনে এগোবে, তারাই অস্তিত্ব সংকট থেকে বেঁচে যাবেন।

রকিবুল হাসান: টেলিকম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক লেখক এবং লিংক-থ্রি টেকনোলজিস লিমিটেডের চিফ টেকনোলজি অফিসার