
কৃষকের ছেলে জুলহাস উড়োজাহাজ তৈরি করে ফেলেছে। ইলেকট্রিক টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করা এই ছেলেটি তার একটি বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছে, যার টেকনিক্যাল নাম ওয়ার্কম্যানশিপ। নিঃসন্দেহে এটা প্রশংসার দাবি রাখে! জুলহাসের এই কৃতিত্বকে তুলে ধরতে কেউ কেউ বুয়েট, চুয়েট, কুয়েটসহ দেশের সব বিজ্ঞানী-ইঞ্জিনিয়ারদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে যাচ্ছেন।
জুলহাস যা তৈরি করেছেন, তা মূলত একটি বড় আকারের খেলনা। জুলহাসের এই প্রতিভাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে আমরা ভাবতে পারি। কিন্তু তাকে নিয়ে আমরা অনেকেই যে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি, তা রীতিমতো ভয়ংকর!
সবকিছু যেমন আমরা বিজলির গতিতে পেতে চাই, তেমনি টেম্পোর দামে প্রাইভেট বিমান কিনতে চাই। জুলহাস এমনই একটা স্বপ্ন আমাদের দেখিয়ে ফেলেছে! সেই স্বপ্নে আমরা বিভোর হয়ে পড়েছি! যে যেভাবে পারছে, এই স্বপ্নের তরীতে হাওয়া দিচ্ছে।
টেম্পোর দামে বিমান কিনতে মরিয়া এই ব্রিগেড খবর রাখেন না যে সাবিনা আহমেদ নামে বুয়েটের এক বোন আমেরিকার মিসাইল কোম্পানির বড় হর্তাকর্তা হয়েছেন, তার স্বামী অন্য এক বুয়েটিয়ান নাসার বড় ইঞ্জিনিয়ার। এ রকম আরো অনেক বুয়েট, চুয়েট, কুয়েট থেকে পাস করে পৃথিবীর বড় বড় জায়গায় বসে আছেন। এ দেশটিকে অ্যারোপ্লেন বিল্ডিং ন্যাশন বানাতে হলে প্রথমেই এ সাবিনাদের লাগবে, তারপর জুলহাসদের ওয়ার্কম্যানশিপ কাজে লাগানো সম্ভব হবে। এখন পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকটি দেশ যাত্রীবাহী জাহাজ বানানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে। রাশিয়ার মতো টেকনোলজিতে উন্নত দেশের বিমানে চড়লে এখনো অনেকে স্রষ্টার নাম জপা বাড়িয়ে দেন। রাশিয়া থেকে আনা বিমানবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলোর নাম দেওয়া হয়েছিল উইডো মেকার! স্বপ্ন দেখার আগে এই বাস্তবতাগুলোও স্মরণে রাখতে হবে ব্রাদার।
সে কারণেই বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করার মরাল অবলিগেশন অনুভব করছি। জুলহাসের জন্য এখন সবচেয়ে উপকারী পরামর্শটি হলো, তাকে বুঝতে দেওয়া যে সে কোন বিরাট জিনিসটি করে ফেলেছে আর কোন জিনিসটি করেনি।
বিষয়টি নিয়ে আমরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া বা উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছি, তাতে একজন মেরিটাইম সেইফটি এক্সপার্ট হিসেবে সত্যি প্রমাদ গুনছি! এতে উৎসাহিত হয়ে আরো অনেক জুলহাস যদি এই এক্সপেরিমেন্ট শুরু করে দেয় এবং তাতে যদি দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তখন এর দায়টি কে নেবে? রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের সেই সিম্পল ডিজাইন আসলেই কোনো রকেট সায়েন্স নয়। ইচ্ছে করলে অনেকেই এটা বানাতে পারবে। আমাদের তরুণদের ওয়ার্কম্যানশিপ দক্ষতা অন্য অনেক দেশের তরুণদের চেয়ে বেশি। তিন মাসের ট্রেনিং দিয়ে এ দেশে দক্ষ ৪-জি, ৬-জি মানের ওয়েল্ডার তৈরি করা যায়। সিঙ্গাপুর শিপইয়ার্ডগুলোর অধিকাংশ ওয়েল্ডার বাংলাদেশি!
জুলহাসের উড়োজাহাজ নিয়ে যা হচ্ছে, তাকে আমরা বলতে পারি নেটিজেন জেনারেটেড সোশ্যাল মিডিয়া হাইপ। মাঝে মাঝে রাষ্ট্রযন্ত্রও এ রকম হাইপ তৈরি করে। আজ এ দুটো নিয়েই বিশেষ আলোচনা করতে চাচ্ছি।
রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক তৈরি করা আওয়ামী হাইপ-সমুদ্র বিজয়
সমুদ্রসীমা বণ্টনে অধিকতর লাভ হয়েছিল আমাদের প্রতিপক্ষ বার্মা-ইন্ডিয়ার। এমনকি এই দুটি দেশের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের সীমানা এমনভাবে ভেদ করে গেছে যে, আমরা মূলত মাঝখানে বন্দি হয়ে পড়েছি। আমাদের কনটিনেন্টাল সেলফে যেতে হলে যেতে হবে মিয়ানমারের ইইজেডের একটা অংশ দিয়ে অর্থাৎ ওই ব্লকের পানির স্বত্ব মিয়ানমারের, শেলফ বা তলদেশের মাটি আমাদের। আমাদের বাদবাকি কনটিনেন্টাল শেলফে যেতে হলে মিয়ানমার বলবে, তোমরা আমার পানির ওপর দিয়ে যেতে পারবে না। পাত্তাল দিয়ে যাও, ওহে মদন! এটাকে বলা হয়েছে গ্রে এরিয়া। বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে অসুবিধা হবে না। বাঁধাটি আসবে তখন, যখন আমরা খনওব্লুওয়াটার নেভি (Blue Water Navy) করার চিন্তাভাবনা করব কিংবা কনটিনেন্টাল শেলফে যখন মহামূল্যবান সম্পদ পাওয়া যাবে। একটু ভেবে দেখুন, এরা জাতির কী সর্বনাশটিই না করে গেছে! শত শত বছর জাতিকে কপাল চাপড়াতে হবে!
এ রকম একটা মারাত্মক গলার কাঁটা নিয়েই আমরা লাফাচ্ছি! অর্থাৎ আসল জয় হয়েছে মিয়ানমার এবং ইন্ডিয়ার! কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের ইশারায় এবং ইঙ্গিতে নাচানাচি এবং লাফালাফি করলাম আমরা! দীপু মনি যে ভঙ্গিতে সেদিন শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ধরেছিল, তা দেখে মালুম হচ্ছিল যে আসলেই সাংঘাতিক কিছু করে ফেলেছে!
এই কিছিমের অনেক সার্কাস দর্শন করে বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলীর মুখ থেকে বের হয়ে যায়, দেশটা পড়ে গেছে এক বাজিকরের হাতে। কথাটি আঘাত করে আসল জায়গায়! এতে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর নেতৃত্বে সব বুদ্ধিবৃত্তিক পালোয়ানের দল ক্ষেপে উঠেছিলেন । এরা লেগে গেলেন প্রিয় শেলী ভাইয়ের রাজাকারী কানেকশন বের করার কাজে। শেলী ভাই নিজের কথাটিকে একটু ঘুরিয়ে দিলেন। ব্যাখ্যা দিলেন, তিনি এক বচনে বাজিকরের কথা বলেননি, বহুবচনে বাজিকরদের কথা বলেছেন। যে কিছিমে বুদ্ধির খেলায় গোপালভাঁড় নিজের গর্দান রক্ষা করতেন, সবার প্রিয় শেলী ভাইও তাই করেছিলেন!
এখানে স্মর্তব্য আলো স্টার গ্রুপও এই গোপালভাঁড়ীয় টেকনিক অনুসরণ করে নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখত এবং নিজেদের গর্দান রক্ষা করত । এক দিন কোনো সত্য কথা লিখে ফেললে পরের দিন অন্যকিছু দিয়ে খুশি করে ফেলত! তারেক রহমানের প্রসঙ্গ এলেই সেই বিকট গর্দান ও লম্বাটে মুখসংবলিত কার্টুন ছবিটি প্রকাশ করত ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে। অথচ সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘাড় ও চোয়াল তিন গুণ লম্বা করা তো দূরের কথা, তিন মিলিমিটার লম্বা করার হিম্মত দেখাতে পারেনি! এমনকি মাফিয়া রানির ভেগে যাওয়ার পরও মুক্ত স্বাধীন দেশেও তা করছে না! শেখ হাসিনার সমুদ্র বিজয়কে গ্লোরিফাই করে অনেক আর্টিকেল মতি-মাহফুজের আলো-স্টার ছাপিয়েছে, গুগলে গিয়ে সার্চ করলেই তাদের সেসব তৈলাক্ত রচনা দেখতে পাবেন! আর সেই মতি-মাহফুজকে নিয়ে এখনো আমাদের প্রিয় নেতাদের আদর-সোহাগ দেখলে বুকটা আসলেই ‘ফাইট্যা’ যায়!
এই বুক ফাটা আর্তনাদ প্রকাশ করতে ২০১৪ সালের ৮ জুলাই নিচের লেখাটি নিজের পেজে পোস্ট করি।
মদনের কলা ভাগ ও সমুদ্রসীমা নিয়ে আদালতের রায়
সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের রায় প্রকাশের পর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই রায় মেনে নেওয়ার জন্য প্রথমেই ভারতকে স্বাগত জানিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের ভাবখানা এমন যে এই রায়ে ভারত পরাজিত হয়েছে। আমরাই বিজয়ী হয়েছি। বিজয়ী পক্ষ পরাজিত পক্ষকে এই ভঙ্গিতেই স্বাগত জানায়।
২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ পেয়েছে। এমন উৎফুল্ল বা অতিরিক্ত খুশি হওয়ার কারণ এই বিরোধপূর্ণ এলাকার বেশিরভাগ আমরা পেয়েছি, ওরা কম পেয়েছে।
এখন প্রশ্ন, এই বিরোধপূর্ণ জায়গার ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে কি আদতেই বাংলাদেশের অন্যায্য দাবি কিছু ছিল? বরং বলা যায়, আর্বিট্রেশনে বা আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতে সুবিধা নেওয়ার জন্যই ইন্ডিয়া তার পাওনার চেয়ে অনেক বেশি দাবি করেছিল। এখন যতটুকু পেয়েছে, ততটুকুই ইন্ডিয়ার লাভ।
বিষয়টি একটি সহজ উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানো যেতে পারে। মনে করুন, এক মদনের কাছে ২৫টি কলা রয়েছে। জনৈক মধু (Honey) এসে বলল, না এই কলাগুলো আমার। কাজেই আইনের পরিভাষায় এই ২৫টি কলা হয়ে গেল ডিসপুটেড বা বিরোধপূর্ণ কলা । এক সালিশ বোর্ড এসে কলাগুলো সমতার ভিত্তিতে মদন আর মধুর মধ্যে ভাগ করে দিল। মদন পেল ১৯টি কলা এবং মধু পেল ৬টি কলা।
নেহায়েত চাপা ও মেধার জোরে মধু এই ছয়টি কলা অতিরিক্ত পেয়ে গেছে । মদন এখন খুশিতে ডুগডুগি বাজাচ্ছে কারণ সে মধুর চেয়ে ১৩টি কলা বেশি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, এ রায় খুশি মনে মেনে নেওয়ার জন্য মধুর প্রতিক্রিয়া প্রকাশের আগেই মদন তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফেলেছে।
এ সময় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের আদরের দীপু মনি জানান, এ রায়ে জনগণের স্বার্থরক্ষা হয়েছে। তিনি মামলার শুরু থেকে রায় হওয়া পর্যন্ত নিজে এর সঙ্গে জড়িত থাকার কথা জানিয়ে বলেন, এ রায় প্রমাণ করেছে আওয়ামী লীগই পারে, আওয়ামী লীগ পারবে।
তার এই আদুরে কথাটি শুনে দেশবাসী দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বলছে, ঠিক বলছেন আপুমণি, আসলে আওয়ামী লীগই পারে, আওয়ামী লীগই পারবে। অনেক কিছু হারানোর পরও এভাবে বিজয়ের ঢেকুর তুলতে ও প্রতিপক্ষকে এমনভাবে ধন্যবাদ জানাতে একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে।
এ রায় দেশবাসীকে জানানোর স্টাইল বা ভঙ্গি দেখে জনগণ যা বোঝার তা বুঝে গেছে তালপট্টি দ্বীপটি বোধহয় আমরা জীবনের তরে হারিয়ে ফেলেছি। এরপরও যদি সমুদ্র বিজয়ের জন্য নাচানাচি দেখতে হয়, তবে এর চেয়ে কষ্টের বিষয় এই হতভাগা জাতির জন্য আর কী থাকতে পারে?
নেটিজেন জেনারেটেড সোশ্যাল মিডিয়া হাইপ-জুলহাসের উড়োজাহাজ
শত বছর আগে রাইট ভ্রাতৃদ্বয় যে জিনিস আবিষ্কার করেছিলেন, সেই একই জিনিস ইউটিউব থেকে দেখে দেখে জুলহাস তৈরি করে ফেলেছেন। এটাও খুব সহজ কাজ নয়। এটাও জুলহাসের একটা বিশেষ পারদর্শিতা। জুলহাসের এই বিশেষ ট্যালেন্ট বা পারদর্শিতাকে রাষ্ট্র বা সমাজ কাজে লাগানোর কথা ভাবতে পারে।
কিন্তু জুলহাসের এই গুণমুগ্ধ ভক্তরা খবরও রাখেন না যে এভিয়েশন টেকনোলজি আজ কোথায় চলে গেছে। রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের উড়ন্ত বাহন অনেক মডিফিকেশনের পর প্লেইনের অবয়ব পেয়েছিল। প্রথমদিকে একটি করে প্লেইন দুর্ঘটনা হয়েছে আর নতুন করে ডিজাইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রতিবারই নতুন সেইফটি রুল সংযোজিত হয়েছে। কাজেই আজ হঠাৎ করে ১২০ বছর আগের সেই সিম্পল টেকনোলজিতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না।
আইনের শাসনসংবলিত কোনো দেশ এ রকম বাহন উড্ডয়নের অনুমতি দেবে না, যা জনগণ বা সম্পদের জন্য পটেনশিয়াল হ্যাজার্ড হয়ে পড়তে পারে। উৎসুক জনতা এবং সাংবাদিক যেভাবে জুলহাসের উড্ডয়ন প্রত্যক্ষ করেছে, তা রীতিমতো ভয়ংকর ঠেকেছে। মনে হচ্ছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেখার মতো কোনো এভিয়েশন অথরিটি বা অন্য কোনো সংস্থা এ দেশে নেই!
সোশ্যাল মিডিয়া হাইপ যে কত শক্তিশালী ও ভয়ংকর হতে পারে, তা করুণ নয়নে দেখতে পেলাম। এই হাইপে পড়ে ইউএস বাংলার এমডি নিজের এভিয়েশন জ্ঞান (যা মিনিমাম থাকার কথা) পুরোপুরি খুইয়ে ফেলেছেন বলে অনুমিত হচ্ছে! তা না হলে তিনি কীভাবে অঙ্গীকার করেন জুলহাসকে বিমান বানাতে সহায়তা করার? তিনি এক জুলহাসের ওপর ভিত্তি করে দেশে উড়োজাহাজ শিল্প গড়ে তুলবেন? তিনি কি সেই ১২০ বছর আগের বিমান বানানোর কথা বলছেন? ইউএস বাংলার এমডি কি জানেন না যে এসব উড়োজাহাজকে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের ( ICAO) অনুমোদন নিতে হবে? আর সেই গাইডেন্স মেনে একের পর এক সেইফটি ফিচার এবং নেভিগেশনাল ও কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট যোগ করতে করতে সেটি আর টেম্পো জাহাজ থাকবে না, হয়ে পড়বে একটি মডার্ন প্রাইভেট জেট ।
বিলিয়ন ডলারের কার্গোর চেয়ে একজন মানুষের জীবন বেশি মূল্যবান গণ্য করে সব সেইফটি রুলস এবং গাইডেন্স তৈরি করা হয়েছে। কাজেই গ্লোবাল ভাবনা ও আবেগ থেকে আমরা যে কত যোজন যোজন দূরে পড়ে আছি, জুলহাসের ঘটনা তা দেখিয়ে দিয়েছে।