Image description

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট—বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ভয়াল, হৃদয়বিদারক ও স্মরণীয় দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেদিনের ঘটনার পর গোটা দেশ কার্যত রূপ নেয় এক রণক্ষেত্রে। একদিকে সরকারবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে সরকারি দলের অস্ত্রধারী কর্মীদের হিংস্র প্রতিক্রিয়া—সব মিলিয়ে একটি জাতি প্রত্যক্ষ করেছিল নির্মমতা, হিংসা আর রক্তপাতের এক বিপজ্জনক প্রতিচ্ছবি।

চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে টানা আন্দোলন ও ‘এক দফা, সরকার পতন’ স্লোগানের জেরে আন্দোলনকারীদের রাস্তায় নামা ছিল বিগত সময়ের আন্দোলনের প্রস্তুতির ফসল। সরকারবিরোধী জোট ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ, মিছিল ও মানববন্ধন চলছিল লাগাতারভাবে। কিন্তু ৪ আগস্টে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়, যখন রাষ্ট্র তার সর্বশক্তি দিয়ে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা চালায়।

সকাল থেকেই রাজধানীতে অস্বাভাবিক উত্তেজনা লক্ষ্য করা যায়। সরকারি দল আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অসংখ্য কর্মীকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে জড়ো হতে দেখা যায়। তাদের অনেকের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র, রড, লাঠিসোঁটা। পুলিশের পাশাপাশি এদেরকেও দেখা যায় বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালাতে।

বেলা বাড়তেই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। রাজধানীর শাহবাগ, পল্টন, গুলিস্তান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ধানমন্ডি, মিরপুর, মতিঝিল—প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় একযোগে হামলা চালানো হয়। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ব্যবহার করে টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, এমনকি গুলি। কিন্তু শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, বেসামরিক পোশাকে থাকা সরকারপন্থী অনেককেও দেখা যায় আন্দোলনকারীদের দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে।

সেদিন ভোর থেকেই শাহবাগ মোড় দখলে নেয়া আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ সাধারণ ছাত্র-জনতা দেখামাত্রই গুলি ছুঁড়ে, দেশীয় অস্ত্র চাপাতি, ছুরি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ছাত্র-জনতাজড়ো হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললে পতিত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, পুলিশসহ আইন-শৃংখলাবাহিনী পিছু হঁটতে থাকে। তারা জনতার প্রতিরোধে কুলিয়ে উঠতে না পেরে পিজি হসপিটালে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি গাড়িতে আগুন দিয়ে হাসপাতাল ভবন ও ছাদে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকেও তারা গুলি করতে থাকে ও ইট পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে নিরস্ত্র জনতার ওপর। জনতা হসপিটাল পর্যন্ত তাদের ধাওয়া করলে তারা হাসপাতালে আগুন দিয়ে ভবনের পেছন দিয়ে পালাতে বাধ্য হয়। সে সময়ে তারা রাজপথ থেকে পরাজিত হওয়ার পর, তাদেরকে আর রাজপথে দেখা যায়নি। তারা দেশ ছেড়ে পালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। 

বিক্ষোভকারীরা জানায়, সেদিন শুধু ঢাকাতেই গুলিতে নিহত হন শতাধিক মানুষ। আহত হন কয়েক হাজার। নিহতদের অনেকে এখনও নিখোঁজ, বহু লাশের খোঁজ মেলেনি। আহতদের অনেকে আশেপাশের ক্লিনিক ও বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নেন; কারণ হাসপাতালগুলো ছিল ভীতিকর পরিস্থিতিতে। সবমিলিয়ে দিনটি রূপ নেয় গণহত্যার এক রক্তাক্ত অধ্যায়ে।

সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে সন্ধ্যার আগেই সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ ঘোষণা করে। একই সঙ্গে ঘোষণা করা হয় তিন দিনের সাধারণ ছুটি। যাতায়াত বন্ধ হয়ে পড়ে, মোবাইল নেটওয়ার্কে জারি হয় সীমাবদ্ধতা। সংবাদমাধ্যমগুলো সরকারি চাপের মুখে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে। সরকার ঘটনাকে ‘জঙ্গি হামলা’ হিসেবে অভিহিত করে এবং দাবি করে, তারা দেশকে ‘সন্ত্রাসমুক্ত’ করতে চূড়ান্ত অবস্থানে যাবে।

এর আগে ৩ আগষ্ট এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, 

আমরা রাজপথ ছেড়ে যাব না, যতক্ষণ না দেশের প্রতিটি সন্ত্রাসীকে নির্মূল করা হয়। 

পরদিন থেকে দেশব্যাপী ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হাজার হাজার কর্মীকে রাজপথে অস্ত্রসহ টহল দিতে দেখা যায়। এসব চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলেও সরকার তাদের দায় অস্বীকার করে।

অন্যদিকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক ভিডিও বার্তায় বলেন, 

আমরা এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম। সরকার গণহত্যা চালাচ্ছে, এর প্রতিবাদে আমাদের রাজপথে থাকা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তিনি দলীয় সব স্তরের নেতাকর্মীদের অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলেও এই সহিংসতা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ‘গভীর উদ্বেগজনক’ বলে অভিহিত করেন এবং অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলেন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কয়েকজন সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যৌথ বিবৃতিতে বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর ব্যবহার যেন জনগণের বিরুদ্ধে না হয়। তারা সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, সেনাবাহিনী কখনোই ছাত্র ও তরুণদের রক্তে হাত রাঙানোর হাতিয়ার হতে পারে না। তাদের মতে, দেশ যে দিকেই এগোচ্ছে, তা স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী ও রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি।

৪ আগস্টের রাতেই আন্দোলনের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ঘোষিত হয় এক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি—‘লং মার্চ টু ঢাকা’। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, ৬ আগস্টে সারাদেশ থেকে জনগণ ঢাকার দিকে যাত্রা করার কথা ছিল। কিন্তু রাতেই সিদ্ধান্ত পাল্টে নেওয়া হয় কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে আনার।

আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ এক ভিডিও বার্তায় ঘোষণা দেন, 

৪ আগস্টের গণহত্যার পর আর সময় নেওয়া যাবে না। ৫ আগস্টেই ঢাকার পথে যাত্রা শুরু হবে। এটাই হবে চূড়ান্ত গণজোয়ার।

তার ডাকে সাড়া দিয়ে সারাদেশ থেকে মানুষ রওনা হয় রাজধানীর দিকে।

আরেক আন্দোলন নেতা সারজিস আলম সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, 

কালই লং মার্চ! আর দেরি নয়, এখনই সময়।

অন্যদিকে, সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ তার বক্তব্যে বলেন, 

এই জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হতে যাচ্ছে আগামীকাল। সবাই প্রস্তুত হোন, রাজপথে শেষ লড়াই শুরু হবে এখন।

এই ঘোষণা আন্দোলনের ভেতরে নতুন প্রাণ ফিরিয়ে আনে। একদিকে সরকারের কঠোর দমননীতি, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ—দুটি বিপরীত স্রোত যেন মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ায়। আন্দোলনকারীদের মতে, ৪ আগস্টের ভয়াবহতা একদিকে যেমন দুঃখজনক, তেমনি এটি আন্দোলনের গতিপথে একটি মোড় ঘোরানো ঘটনা।

বলা যায়, ৪ আগস্টের দিনটি ছিল সরকারের দমননীতির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, আর ৫ আগস্ট ছিল গণআন্দোলনের ঐক্য ও শক্তির উত্থানের সূচনালগ্ন। অনেকে মনে করেন, সেই ভয়াবহ দিনটিই জনগণকে আরও ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছে এবং গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনাকে জোরালো করেছে।

বর্তমান সময়ে ইতিহাসবিদরা ৪ আগস্টকে গণহত্যার দিন হিসেবে চিহ্নিত করার দাবি তুলছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনও সেদিনের ঘটনার ওপর তদন্ত দাবি করেছে। আন্দোলনের নেতারা দেশব্যাপী শহীদ দিবস ঘোষণার পক্ষে মত দিচ্ছেন।

যদিও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা কখনোই কাঙ্ক্ষিত নয়, তবু ৪ আগস্টের রক্তাক্ত ঘটনাবলি একটি বিষয় পরিষ্কার করে দেয়—গণতন্ত্র, ন্যায্যতা ও মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য জনগণের জেগে উঠার শক্তিকে সহজে দমন করা যায় না। ইতিহাস হয়তো এই দিনটিকে স্মরণ করবে এক বেদনাবিধুর, কিন্তু প্রয়োজনীয় জাগরণের দিন হিসেবে।

শীর্ষনিউজ