
চব্বিশের ৪ আগস্ট বা ৩৫ জুলাই। স্বৈরাচারবিরোধী একদফা আন্দোলনের ঢেউ যখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন উত্তাল ছিল ফেনীর মহিপাল। হাজারো শিক্ষার্থী রাস্তায় নামেন শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে। ছাত্র-জনতা ও পুলিশ-আওয়ামী বাহিনীর সংঘর্ষে হয়ে ওঠে ভয়ংকর যুদ্ধক্ষেত্র। গুলিতে লুটিয়ে পড়েন একে একে সাত তরুণ।
আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে সে বর্ণনা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল থেকে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিয়ে মহিপালে কর্মসূচি করছিল ফেনীর ছাত্র-জনতা। মুখে ছিল একটাই স্লোগান ‘দফা এক দাবি এক, স্বৈরাচার হাসিনার পদত্যাগ’। অন্যদিকে শহরের ট্রাংক রোডে অবস্থান নিয়েছিল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা। সকাল থেকে শান্ত থাকলেও দুপুর হতেই পরিস্থিতি হয়ে উঠে উত্তপ্ত। রাস্তায় দাঁড়িয়েই জোহরের নামাজ আদায় শেষে দুহাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে নির্যাতন ও বৈষম্যের বিচার দিচ্ছিলেন ফেনীর ছাত্র-জনতা।
হঠাৎ করেই পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সেদিন ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফেনীর সাবেক এমপি নিজাম হাজারীর নির্দেশে যুবলীগ-ছাত্রলীগের অতর্কিত গুলিবর্ষণে মুহূর্তেই রক্তাক্ত হয়ে ওঠে রাজপথ। চোখের সামনে একে একে লুটিয়ে পড়ে শ্রাবণ, মাসুদ, সিহাব ও শাহীসহ ৭ জন তরুণ। আহত হন ৪ শতাধিক মানুষ। সেদিনের ফেনীর মহিপাল যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র। আন্দোলনের দেশের অন্যস্থানেও ফেনীর তিন যুবক নিহত হন। মোট নিহতের সংখ্যা ১০ জন। ভয়াল সেই বীভৎস দিনের কথা মনে এলে এখনো গা শিউরে ওঠে প্রত্যক্ষদর্শীদের।
তবে বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে সেসব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। উদ্ধার হয়নি হামলায় ব্যবহৃত সব অস্ত্রও। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। অতি দ্রুত অস্ত্রধারীদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে বিচারের দাবি করছেন তারা।
পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় জেলায় ছয়টি থানায় ৭টি হত্যা মামলা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে। যেখানে এজাহারভুক্ত আসামি রয়েছে ২১৯৯জন ও অজ্ঞাতপরিচয় আসামি ৪ হাজার। গ্রেফতার করা হয়েছে এক হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ১১জন। বাকিদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান চলছে। অপরদিকে আসামি গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে বাদী পক্ষের (শিক্ষার্থীদের) আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া।
তবে গত ৩১ জুলাই একটি মামলায় ২২১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ। চার্জশিটে অভিযুক্তদের মধ্যে ক্ষমতাচ্যূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী, ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসডিয়াম সদস্য মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী রয়েছেন।
মহিপালের এই হত্যাযজ্ঞ, রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের বাইরে কোনো জেলা শহরে একদিনে সর্বোচ্চ রক্তাক্তের ঘটনা।
আন্দোলনকারী আবদুল্লাহ আল-যোবায়ের বলেন, প্রকৃত খুনি ও পরিকল্পনাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত না হলে এ আন্দোলনের বেদনা যেমন থাকবে, তেমনি বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে এমন ঘটনার। দৃষ্টান্তমূলক বিচারই পারে শহীদ পরিবারের অন্তত সামান্য সান্ত্বনা ফিরিয়ে আনতে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জেলার শহীদ ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণের বাবা নেছার আহম্মদ হতাশা ও আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, অনেক আসামি দেশের বাইরে চলে গেছে। আবার অনেকে দেশে থাকা সত্ত্বেও এখনো আইনের আওতায় আসেনি। বিচার নিশ্চিত না হলে আমাদের হাজারো সন্তানের রক্ত ও আত্মত্যাগ বৃথা যাবে। কোটি কোটি টাকা বা অট্টালিকা আমরা চাই না। সন্তানের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারই একমাত্র চাওয়া।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখন আর কোনো আনন্দ নেই। আখিরাতে ছেলের সঙ্গে দেখা হলে সেদিন আনন্দ হবে। বুকে পাথর নিয়ে চলাফেরা করি। কাউকে বলতে পারি না সন্তান হারানোর এই কষ্ট।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের প্রতি হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, উনারা (ছাত্ররা) বিভিন্ন রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। এখন রাজনৈতিক দল নিয়ে এসেছে। শহীদ পরিবারের দিকে কে তাকাবে? এজন্য এখনো বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামতে হয়। আমরা ন্যায্য ও প্রাপ্য অধিকার চাই।
শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার শিউলী বলেন, ৪ আগস্টের পর থেকে সব আনন্দ চলে গেছে। আমাদের গোছানো একটা জীবন অগোছালো হয়ে গেছে। জীবনের সব আনন্দ ওইদিনই শেষ হয়ে গেছে। বড় মেয়েটি সারাক্ষণ একা একা বসে কান্না করে, শ্রাবণই ছিল তার ভাই-বন্ধু। মেয়েটি কাউকে কিছু বোঝাতে পারে না এখনো। ভাইয়ের শোকে কারো সঙ্গে কথা বলে না। আমার আনন্দ বা সুখ-আহ্লাদ সবকিছু আমার ছেলের কাছে রয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, এখন শুধু সুষ্ঠু একটি বিচারই আমাদের চাওয়া। এজাহারভুক্ত আসামিরা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড় বড় আসামিরা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। এ দুনিয়াতে বিচার না হলেও মহান আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। আমি তো সন্তানক হারিয়ে ফেললাম, বিচার আল্লাহ করবে ইনশাআল্লাহ। আমার ছেলে সবসময় ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলত। এসব বিষয়ে ভীষণ আন্তরিক ছিল সে।
ফেনী জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আন্দোলনে ফেনীতে হতাহতের সংখ্যা অন্য জেলার চেয়ে তুলনামূলক বেশি ছিল। ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক, চিকিৎসা সহায়তা ও পুনর্বাসনের জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জেলার ১০টি শহীদ পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে মোট ১ কোটি টাকা সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে ‘এ’ ক্যাটাগরির তিনজনকে ৬ লাখ টাকা, ‘বি’ ক্যাটাগরির ৩০ জনকে ৩০ লাখ টাকা এবং ‘সি’ ক্যাটাগরির ৩৪৩ জনকে ৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব সহায়তার বাইরেও জেলা প্রশাসন, সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে সবমিলিয়ে হতাহতদের এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
ফেনীর পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, জেলায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনায় ২২টি মামলা হয়েছে। তারমধ্যে ৭টি হত্যা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টা মামলা। এসব মামলায় ২ হাজার ১৯৯ জন এজাহারভুক্ত ও ৪ হাজার অজ্ঞাত আসামি রয়েছে। তাদের মধ্যে ১ হাজারের বেশি আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার থাকা ১১ জন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে একটি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।