Image description
একটু ভাবুন তো!
গ্লোরিয়া জিন্সে বসে কফির অর্ডার দিলেন। কফি এলো। ২ চুমুক দিলেন। আহ অপূর্ব! হঠাৎ কোত্থেকে যেন একটা বিশ্রী পোকা উড়ে পড়লো কফির মগে। এখন কী করবেন? কফিটা খেয়ে নেবেন? নাকি, ফেলে দেবেন? ফেলে দিলে তো টাকাটাও জলে গেলো। কিন্তু একটা মড়া পোকা ভাসছে, এরকম কফি তো খাওয়াও যায় না। কী করা যায়? এতো দামী কফি! টাকা জলে দেয়ার কষ্ট অনেক! ভাবছেন তো ভাবছেনই! সময় কেটে যাচ্ছে, তবু কফির দামের মোহ কাটছে না। এভাবেই কাটলো অনেকটা সময়। ওয়েটার বিল দিয়ে গেলো। বিলটা মিটিয়ে মেজাজ খারাপ করে রাস্তায় হাঁটতে লাগলেন। আজকে শতাব্দীকে পড়াতে যাওয়ার কথা ছিলো, আন্টি আজ বেতন দেয়ার কথা, তার উপর কালকে ওর ম্যাথ সেকেন্ড পার্ট এক্সাম। দেরি হয়ে গেছে, মনমেজাজও ভালো না। আজকেও গেলেন না। গত ৩ দিন ধরেই যাচ্ছেন না। আন্টি ফোনে বলেছেন, বাবা, তুমি না পারলে শতাব্দীর জন্যে একজন ভালো টিচার খুঁজে দাও। সামনেই তো ওর ইন্টার পরীক্ষা। ভাবতে লাগলেন, টিউশনিটা আর থাকবে না বোধ হয়। শালার কফি! পুরোই ফ্রুটলেস! পয়সাও গেলো, সময়ও গেলো। মেজাজ তো খারাপ হলোই। এই বাজারে একটা টিউশনি ম্যানেজ করা যে কী কষ্ট, একে ধরা লাগে, ওকে ধরা লাগে। হাতে ধরে এভাবে কেউ টিউশনি খোয়ায়?! আরেকটু আগে বের হলেই তো টিউশনিটা আর মিস হতো না। নিজের মাথার চুল নিজের হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। থাক, না ছিঁড়ি। চেষ্টা করলে টিউশনি আরেকটা ম্যানেজ করা যাবে, কিন্তু চুল তো আর ম্যানেজ করা যাবে না। হেয়ার প্ল্যান্টেশনে অনেক খরচ! টিউশনির বেতনের ডাবল। শতাব্দীর বাবা অতো টাকা দেবেন না। শালা হাড়কিপ্টা; বেতন বাড়ায়ই না। এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেলেন! ম্যানহোল ছিলো, খেয়াল করেননি। টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না, তাই অনেক চেষ্টা করে দ্বিগুণ দাম দিয়ে দুইটা টিকেট কোনোরকমে ম্যানেজ করলেন। আপনার স্ত্রী সহ মুভি দেখবেন। ব্যাপক হিট মুভি! টিকেটই পাওয়া যায় না। ভালো তো হবেই! মুভিটা সম্পর্কে কোনো রিভিউ না দেখেই তাই ২টা কিনে ফেললেন বউকে সারপ্রাইজ দেবেন বলে! বাসায় ফিরেই চিল্লাচিল্লি করে বউকে বললেন, চোখ বন্ধ! দেখ দেখ কী এনেছি! তুমি কালকে সন্ধ্যায় ফ্রি তো? বউ টিকেট দেখেই অগ্নিশর্মা! তোমার রুচিবোধ এই পর্যায়ে নামলো কবে থেকে? এসব সস্তা মুভি না দেখলে তোমার হয় না? ছিঃ! আমি যাবো না তোমার সাথে। তুমি কোনো সস্তা রুচির মেয়েকে নিয়ে মুভি দেখে আসো গিয়ে। আপনি বুঝিলেন, ইহা অনুরোধ নহে, ইহা থ্রেট। ড্রেস না ছেড়েই তখুনি নেটে রিভিউ দেখতে বসে গেলেন। আসলেই মুভিটা আপনার রুচির সাথে যায় না। কিন্তু, কী যুদ্ধ করেই না টিকেটটা ব্ল্যাকারের কাছ থেকে ম্যানেজ করলেন! ভাবলেন, ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিই। দেখি, কেউ কিনে কিনা। অ্যাট লিস্ট টিকেটের দামটা অন্তত উঠুক। দিলেন স্ট্যাটাস। আপনার বন্ধুরা আপনাকে পচাতে পচাতে দুর্গন্ধ করে ছেড়ে দিলো। কেউ একজন কমেন্টে লিখলো, শালা খারুজের বাচ্চা! মুভি আর পাস না। তুই এই টিকেটও পয়সা দিয়া কিনসস! আবার কস, ডাবল দামে না বেইচ্যা অরিজিনাল দামে বেচবি! ……. দেখলেন, আপনার স্ট্যাটাসে লাইক ২টা, আর ওই কমেন্টে লাইক ১৮টা! বউ দেখে বললো, এই টিকেট বেচার স্ট্যাটাস দিতে তোমার লজ্জাও করলো না? …….. নারিকেল গাছ খুঁজতে লাগলেন, নারিকেল গাছের আগায় উঠে গলা ছেড়ে কাঁদতে পারলে অন্তত একটু শান্তি লাগতো। নাহ! একটাও নারিকেল গাছ নাই আশেপাশে, সব কয়টা ডাব গাছ। পরেরদিন সন্ধ্যায় একবুক সাহস সঞ্চয় করে বউকে জিজ্ঞেস করলেন, চলো না, না হয় দেখে আসি। বাসায় তো আর তেমন কোনো কাজ নাই। বাসায় রান্না করার দরকার নাই, আজকে আমরা বাইরে ডিনার করবো। বউ টিকেট হাতে নিয়েই ছিঁড়ে ২ টুকরা করে বললো, ওয়াও! গ্রেট! চলো, আজকে বাইরে ব্যুফে খাই! প্যাঁচা প্যাঁচা মুখ করে ভাবতে লাগলেন, হে ধরণী! দ্বিধা হও, আমি গাছে উঠি! শালার সিনেমার গুষ্ঠি কিলাই!! একটু ভাবুন তো! যদি রেস্টুরেন্টে কফিটা ফেলে রেখেই বিলটা দিয়েই উঠে পড়তেন, তাহলে কিন্তু অতো ঝামেলা আর হতো না। টিকেটটা জাস্ট জানালা দিয়ে প্রথমেই ছুঁড়ে ফেলে দিলেই কিন্তু আপনার দুনিয়ার পেইন আর নিতে হতো না। যে টাকাটা জলে গেছে, সেটা তো গেছেই! মানে, জলে ডুবে গেছে। The cost sank. So, it’s a sunk cost. জলে ডুবে যাওয়া টাকার জন্যে মন খারাপ করে থাকতে হয় না। কোচিং সেন্টার বন্ধ করবো করবো করেও করা যায় না। কতো সময় দিয়েছি এটাকে আজকের অবস্থানে আনতে! কী পরিমাণ কষ্ট করে না খেয়ে না ঘুমিয়ে একার হাতে এতো বড়ো একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো! কোনো কাজ শুরু করার সবচেয়ে সহজ উপায় একটাই, কাজটা শুরু করে দেয়া। একটা কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেয়ার একমাত্র উপায়, চিন্তাভাবনা ছাড়াই কোচিং সেন্টারটা বন্ধ করে দেয়া। টিউশনি ছেড়ে কম বেতনে চাকরিতে ঢোকার একটাই উপায়, টিউশনি ছেড়ে দেয়া। ব্যবসা ছেড়ে দেয়াটা খুব খুব কঠিন একটা কাজ। একটা দোকান নিজের সন্তানের মতো। কতো যত্ন করে, কতো ত্যাগ স্বীকার করে, কতো সময় আর টাকা ইনভেস্টমেন্ট করে, কতো মানুষের বাঁকা কথা শুনে, কতো নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে হয়! যদি সেটা ছেড়েই দিতে হয়, তবে ঠিক ওই মুহূর্তে ছেড়ে দেয়াই সবচেয়ে ভালো। দেরি করতে করতে বেটার অপরচুনিটি মিস হয়ে যেতে পারে (এবং যায়)। শেয়ার মার্কেটের লাখলাখ টাকা জলে গেলো, আর আমার চোখের জলে অন্য সব স্বপ্নগুলোও ভেসে গেলো। কতোজন থেকে টাকা পাই! জানি ওরা কেউই আর টাকাটা ফেরত দেবে না। তবুও আমি শুধু মন খারাপ করে থাকি, টাকার কথা ভাবতে থাকি। জীবনে যা হতে চেয়েছিলাম, তার জন্যে এতটা পথ এতো কষ্ট করে পাড়ি দিয়ে আজকের দিনে যখন অন্য একটা বেটার সুযোগ পেয়েও শুধু এতোটা কষ্টকে ডুবে যেতে দেবো না ভেবে, ট্র্যাক চেঞ্জ করলাম না, পরে আফসোসে আফসোসে জীবনটা কাটলো। যার সাথে সারাটা জীবন কাটাবো ঠিক করেছিলাম, আমার নিজের জীবনটা প্রতিটি মুহূর্ত আমি হিসেব করে নিয়েছিলাম ওর মতো করে, যদি কখনো দেখি, ওর হাতে অন্য কারোর হাত; সে আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে সেই কবেই, আমি বুঝতে পারিনি এতোদিন; তবুও কি নিজেকে ওর প্রতীক্ষায়ই শেষ করে দেবো, শুধু ওর জন্যে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে বলে? যা চলে গেছে, আর ফিরবেই না, যাকে আঁকড়ে ধরে থাকলে প্রাপ্তি একটাই — কষ্ট, যার জন্যে আমার নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত অচেনা হয়ে যাচ্ছে, যাকে ছুঁড়ে ফেলে না দিলে হয়তো বা সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো আসার আগেই একেবারেই হারিয়ে যাবে, তা হলো সাঙ্ক কস্ট। ডুবে যাওয়া খরচ; হোক সেটা পার্থিব কিংবা অপার্থিব। শুধু প্রেমিকা ছাড়া আমি ওপরের সব ক্ষেত্রেই প্রচণ্ডভাবে অসফল একজন মানুষ। প্রেমিকা আসে-ই তো নি, যাবে কী? আইবিএ’তে ফাইন্যান্সে এমবিএ কোর্সে আমি যা কিছু শিখেছি, তার মধ্যে আমার কাছে বেস্ট কনসেপ্ট মনে হয়েছে, সাঙ্ক কস্ট। আমার জীবন থেকে যে অবিশ্বাস্য রকমের অর্থ আর সময় হারিয়ে গেছে, যেটার যন্ত্রণা আমাকে তাড়া করে ফিরতো দিনরাত সবসময়ই, সেটাকে তাড়িয়ে দিতে এতো সুন্দর যৌক্তিক ব্যাখ্যা আমি আর কোথাও পাইনি। পুরোনো ব্যথা-ক্ষতি-কষ্ট-হতাশা-দুঃখ সবকিছু ভুলে গিয়ে ছেড়েছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সামনের দিকে চলার জন্যে এই সাঙ্ক কস্ট কনসেপ্টটার প্রভাব অসামান্য।