Image description

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত ও নিহতের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদানে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন গড়ে তোলা হয়। প্রধান উপদেষ্টার তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকাসহ বিভিন্ন কোম্পানি থেকে অনুদান দেওয়া হলেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। তার পরও নতুন করে সরকারের কাছে অর্থ না চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যাংকের সহায়তায় কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

গত পাচঁ মাসের বেশি সময়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ৩ হাজার ৮শ ব্যক্তি ও পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। এ ছাড়া আরও ৩ হাজার আবেদন প্রক্রিয়াধীন বলে জানা গেছে। ফাউন্ডেশন থেকে যে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে, তা মূলত পরিবারের জন্য। যারা আহত হয়েছেন তাদের সরকারি সহায়তায় চিকিৎসা করানো হচ্ছে। দিন দিন এ সহায়তা চাওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়ছে, তাই যে ফান্ড আছে—তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম।

আর্থিক সহায়তা চাওয়া কিছু পরিবার অসন্তোষ প্রকাশ করে জানায়, প্রায় এক মাসের বেশি সময় আর্থিক সহায়তা চেয়ে সাড়া পাচ্ছে না। এ বিষয়ে অফিসে এসে কয়েকবার যোগাযোগ করলে তাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে সহায়তা প্রদান করা হবে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে, সমস্যার সময় যদি সহায়তা প্রদান করা না হয়, পরে টাকা দিয়ে কী হবে। সরকারিভাবে চিকিৎসা করা হলেও আহত ব্যক্তিকে দ্রুত সুস্থ করার জন্য মানসম্মত খাবারও প্রয়োজন। আহত হওয়া ব্যক্তির পরিবার চালাতে কষ্ট পোহাতে হচ্ছে। আর্থিক সহায়তা পাওয়ার আশ্বাসে ধারদেনা করে পরিবার নিয়ে চলছে, কিন্তু সপ্তাহের পর সপ্তাহ পার হলেও সঠিক সময়ে সহায়তা মিলছে না। যাদের ডাকে সাড়া দিয়ে রাজপথে জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করেছে, এখন বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তাদের কাছে গেলে সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। ঘুরে ঘুরে দেখা পেলেও তেমন সাড়া না দেওয়ার অভিযোগ করেছে তারা।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম নিয়ে গত ২২ জানুয়ারি জাতীয় নাগরিক কমিটি উদ্বেগ জানিয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বরাবর একটি চিঠি দিয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত ও শহীদ পরিবারের সঙ্গে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের আচরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠিতে বলা হয়, মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও অনেক আবেদনকারী আর্থিক সহায়তা পাননি। এই বিলম্ব, আহত ও শহীদ পরিবারের জন্য হয়রানি এবং অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। ফাউন্ডেশনের হেল্প লাইনে বা অফিসে এসে সরাসরি যোগাযোগের সময় অশোভন ও অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণের অভিযোগও পাওয়া গেছে। অনেক আহত ব্যক্তি জানিয়েছেন তারা এমআইএস ভেরিফিকেশন তালিকায় নেই। ফলে তাদের সহায়তা পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে বিভ্রান্তি, দীর্ঘসূত্রতা এবং উদ্বেগ সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া আর্থিক সংকটের কারণে অনেকে হাসপাতালে যেতে কিংবা ওষুধ কিনতে পারছেন না। এ বৈষম্য কী কারণে ঘটছে এবং কীভাবে এগুলো সমাধান করা হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রার্থনা করছি। চিঠিতে আরও বলা হয়, ফাউন্ডেশন চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে এবং আমরা আপনাদের ভূমিকা গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকার করি। তবে এ উদ্বেগগুলোর দ্রুত সমাধান করা অত্যন্ত জরুরি। অফিসে এসে দেখা করে এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ পাব বলে আশা করছি। এ পরিস্থিতিতে কীভাবে আমরা একত্রে আহত এবং শহীদ পরিবারগুলোর জন্য দ্রুত সময়ে সহায়তা নিশ্চিত করতে পারি, তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই।

এ ছাড়া, একই দিন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের দায়িত্ব ছাড়েন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। জানা গেছে, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের অফিসে অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এর মধ্যে ২০ জন ভলানটিয়ার আছেন। প্রতিমাসে সবার সম্মানী বা বেতন বাবদ খরচ হয় ৯ লাখ টাকা।

ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ কালবেলাকে বলেন, ৭ হাজারের মতো ভুক্তভোগী পরিবার সহায়তা চেয়ে আবেদন করেছে। প্রায় ৩ হাজার ৮শ ব্যক্তি ও পরিবার সহায়তা পেয়েছে। এর মধ্যে ৬৮৬ শহীদ পরিবার রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকা ফাউন্ডেশনকে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকসহ কিছু কোম্পানিও ফাউন্ডেশনে টাকা দিয়েছে। সব মিলে প্রায় ১১৬ কোটি টাকা ছিল। এর মধ্যে প্রায় ৬১ কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। নতুন করে সরকারের কাছে আমাদের আরও ফান্ড চাইতে হবে না। ব্যাংকসহ কিছু কোম্পানি ও বিদেশ থেকে ফাউন্ডেশনকে ফান্ড দিচ্ছে।

জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) তালিকায় অভ্যুত্থানে শহীদ প্রায় সাড়ে ৮০০, আহত প্রায় ১২ হাজারের কিছু বেশি। সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে যাতে স্বচ্ছতা থাকে, আন্দোলনে জড়িতদের বাইরে অন্য কেউ যাতে তালিকায় ঢুকতে না পারেন এবং বিতর্ক না ওঠে, এ জন্য নানাভাবে যাচাই করা হচ্ছে। ফাউন্ডেশনের কাছে যারা সরাসরি আসছেন, তাদের তথ্য যাচাই করার পাশাপাশি এমআইএসের মাধ্যমেও যাচাই করে তালিকায় নাম উঠানো হয়। শহীদদের ক্ষেত্রে মৃত্যুসনদ লাগবে। যদি তা না থাকে, তাহলে স্থানীয় প্রশাসনের একটি প্রত্যয়নপত্র লাগবে। শহীদের জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদের কপি লাগবে। যিনি নমিনি হবেন, তার পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধনের কপি লাগবে। সন্তানের ক্ষেত্রে বাবা বা মায়ের পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধনের কপি লাগবে। যদি স্ত্রী থাকে, তবে তার পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদের কপি লাগবে। আহত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ফাউন্ডেশনের একটি ফরম পূরণ করতে হবে। যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, সেখানকার চিকিৎসকের সত্যায়িত কপি লাগবে। হাসপাতালে ভর্তির ফরম বা ছাড়পত্র চিকিৎসকের সত্যায়নসহ লাগবে। আহত ব্যক্তি বা নমিনির পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদের কপি লাগবে।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের হেড অব অ্যাডমিন মো. সোহেল মিয়া কালবেলাকে বলেন,যারা সহায়তার জন্য আবেদন করেন, যাচাই-বাছাই করে চারটি ক্যাটাগরি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়। প্রথম ক্যাটাগরিতে ৪ লাখ, দ্বিতীয় ৩ লাখ, তৃতীয় ২ লাখ, চতুর্থ ক্যাটাগরিতে ১ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়। তবে ৯০ শতাংশই চতুর্থ ক্যাটাগরি সহায়তা পেয়েছেন। চেকে বা বিকাশের মাধ্যমে এই আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের অফিস ও স্টাফ বাবদ মাসে ৯ লাখ টাকা খরচ হয়। যারা সহায়তা চেয়ে আবেদন করে, তাদের যথাসময়ে প্রদান করার চেষ্টা করা হয়। তার পরও কিছু লোকের অভিযোগ থাকে। ফাউন্ডেশনের ফান্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার তহবিল ছাড়াও কিছু ব্যাংক ও কোম্পানি এবং বিদেশ থেকে ফাউন্ডেশনে টাকা দিয়েছে। সব মিলে ফাউন্ডেশনের ফান্ড ছিল প্রায় ১১৬ কোটি। ফান্ডে এখন ৫৫ কোটি টাকা আছে।